রাষ্ট্রীয় সম্প্রচারমাধ্যম বিটিভিতে সোমবার (২ জুন) বিকেলে অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদের ঘোষণায় বাংলাদেশের ২০২৫-২৬ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেট উপস্থাপন করা হয়। মোট আকার ধরা হয়েছে সাত লাখ নব্বই হাজার কোটি টাকার (৭,৯০,০০০ কোটি টাকা) একটি বৃহৎ বাজেট, যা দেশের অর্থনীতি ও সামাজিক নিরাপত্তায় নতুন অধ্যায়ের সূচনা হতে পারে।
বাজেটের প্রধান আকার-প্রসঙ্গ
প্রস্তাবিত বাজেটে বাজেট ঘাটতি ধরা হয়েছে দুই লাখ ছিয়াশি হাজার কোটি টাকা (২,৬৬,০০০ কোটি টাকা), যা জিডিপির প্রায় ৩ দশমিক ৬ শতাংশ। প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা রাখা হয়েছে ৫ দশমিক ৬ শতাংশ এবং মূল্যস্ফীতির হার অনুমান করা হয়েছে ৬ দশমিক ৫ শতাংশ। বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে দুই লাখ তিরিশ হাজার কোটি টাকারও বেশি।
করব্যবস্থায় উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন
২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেটে করমুক্ত আয়ের সীমা অপরিবর্তিত থাকলেও ন্যূনতম কর নির্ধারণ করা হয়েছে পাঁচ হাজার টাকা, আর নতুন করদাতাদের জন্য তা এক হাজার টাকা। একই সঙ্গে ব্যাংকে তিন লাখ টাকা পর্যন্ত জমায় আবগারি শুল্ক ছাড়ের ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে, যা মধ্যবিত্ত ও নিম্ন মধ্যবিত্ত শ্রেণির জন্য সুবিধাজনক প্রমাণিত হতে পারে।
কর কাঠামোর কিছু ক্ষেত্রে বিশেষ ছাড় ও শুল্ক প্রত্যাহারের মাধ্যমে পণ্যের মূল্য নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করা হয়েছে। যেমন, ১১০ পণ্যের আমদানি শুল্ক সম্পূর্ণ প্রত্যাহার করা হয়েছে। তবে এলপিজি থেকে শুরু করে ব্লেডসহ বেশ কিছু পণ্যে শুল্ক ও ভ্যাট বাড়ানো হয়েছে, যা সাধারণ মানুষের নিত্যপ্রয়োজনীয় খরচে প্রভাব ফেলতে পারে।
মূল্যস্ফীতি ও পণ্যের দাম
বাজেটে বিশেষভাবে যেসব পণ্যের দাম কমার আশঙ্কা করা যায়, তাদের মধ্যে রয়েছে বাস ও মাইক্রোবাস, তরল দুধ, স্যানিটারি ন্যাপকিন, চিনি, কম্পিউটার মনিটর, বলপয়েন্ট কলম, আইসক্রিম, বিদেশি মাছ ও মাংস, বিদেশি পোশাক, বাটার, ইলেকট্রিক ও হাইব্রিড গাড়ি, কৃষি যন্ত্রপাতি ও ক্যান্সারের ওষুধ ইত্যাদি। এসব পণ্যের ওপর ভ্যাট ও শুল্ক কমানো হয়েছে, ফলে বাজারে দাম কমে আসার সম্ভাবনা রয়েছে।
অপর দিকে, মোবাইল ফোন, হোম অ্যাপ্লায়েন্স, প্লাস্টিকের তৈজসপত্র, এলপিজি সিলিন্ডার, বিদেশি চকলেট ও প্রসাধনী, ব্লেড ও শেভিং সামগ্রী, নির্মাণ সামগ্রী, অনলাইন ব্যবসায় ভ্যাট বৃদ্ধি এবং কিছু কাগজজাত পণ্যের আমদানি শুল্ক প্রত্যাহারের কারণে এসব পণ্যের দাম বেড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
সামাজিক সুরক্ষা ও উন্নয়ন বরাদ্দ
বাজেটে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর বিনামূল্যে স্বাস্থ্য সেবায় বরাদ্দ রাখা হয়েছে চার হাজার একশত ছিয়ষ কোটি টাকার বেশি (৪,১৬৬ কোটি টাকা)। গৃহহীন ও শহীদ পরিবারের জন্য বিশেষ বরাদ্দ ধরা হয়েছে ৪০৫ কোটি ২০ লাখ টাকা। বয়স্ক ভাতা সহ একাধিক ভাতার পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়েছে, যা সামাজিক নিরাপত্তায় ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে।
প্রাথমিক ও গণশিক্ষা খাতে বরাদ্দ কম হলেও কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষায় বাড়তি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। নারীদের উদ্যোক্তা হিসেবে উৎসাহ দিতে বাজেটে ১২৫ কোটি টাকার আলাদা বরাদ্দের প্রস্তাব রয়েছে। এছাড়া, কৃষিক্ষেত্রে আয় ৫ লাখ টাকা পর্যন্ত করমুক্ত করার প্রস্তাবও রয়েছে, যা কৃষকদের জন্য দারুণ স্বস্তির।
অর্থনীতির নতুন দিক ও নীতি
বাজেটে ‘ব্লু ইকোনমি’ ও গবেষণায় বরাদ্দ রাখা হয়েছে ২০০ কোটি টাকা, যা দেশের সামুদ্রিক সম্পদ ব্যবস্থাপনা ও উন্নয়নে গুরুত্ব বহন করে। স্টার্ট-আপ সেক্টরের জন্য ১০০ কোটি টাকার তহবিলের ঘোষণা নতুন উদ্যোক্তাদের জন্য দারুণ সুযোগ সৃষ্টি করবে।
সরকারি কর্মচারীদের জন্য বিশেষ সুবিধা বৃদ্ধি এবং খাতে খাতে নিম্নতম মজুরি নির্ধারণের প্রস্তাব বাজেটের মানবিক ও সামাজিক দিককে শক্তিশালী করবে।
বিশেষজ্ঞদের মতামত ও বাস্তবায়ন চ্যালেঞ্জ
অর্থনীতিবিদরা বলেন, কর কাঠামোর এই পরিবর্তনগুলো ভোক্তা ও উৎপাদনকারী উভয়ের জন্য সুফল বয়ে আনবে, তবে বাজারে দর নিয়ন্ত্রণের জন্য তদারকি বাড়ানো জরুরি। কিছু ক্ষেত্রে দাম কমাতে হলে সরাসরি বাজার নজরদারি ও জনসচেতনতা বৃদ্ধি প্রয়োজন।
রাজনৈতিক বাস্তবতায় পরিবর্তনের কারণে বাজেটটি সংসদের বাইরে বিশেষভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে, কিন্তু আগামী ৩০ জুন সংসদে পাস হওয়ার কথা রয়েছে এবং ১ জুলাই থেকে এটি কার্যকর হবে।