প্রবাসীদের রেমিট্যান্সে ইতিহাস গড়ল বাংলাদেশ, এক বছরে এলো ৩০ বিলিয়ন ডলার

নিজস্ব প্রতিবেদক | প্রকাশ: ২৯ জুন, ২০২৫, ০৭:২২ পিএম
প্রবাসীদের রেমিট্যান্সে ইতিহাস গড়ল বাংলাদেশ, এক বছরে এলো ৩০ বিলিয়ন ডলার

বাংলাদেশের অর্থনীতিতে রেমিট্যান্স দীর্ঘদিন ধরেই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরে প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স নতুন এক ইতিহাস গড়েছে। রোববার (২৯ জুন) বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ তথ্যে জানা গেছে, অর্থবছর শেষ হতে এখনও দুদিন বাকি থাকতে দেশের মোট রেমিট্যান্সের পরিমাণ ৩০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ছাড়িয়ে গেছে। দেশীয় মুদ্রায় এর পরিমাণ প্রায় তিন লাখ ৭০ হাজার কোটি টাকা, যা দেশের ইতিহাসে একক অর্থবছরে সর্বোচ্চ রেমিট্যান্সপ্রবাহের রেকর্ড।

বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র আরিফ হোসেন খান এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন। এর আগে, ২০২০-২১ অর্থবছরে সর্বোচ্চ ২৪ দশমিক ৭৮ বিলিয়ন ডলার রেমিট্যান্স এসেছিল। চলতি অর্থবছরে সেই রেকর্ডও অতিক্রম করেছে প্রবাসীদের আয়।

চলতি বছরের জুন মাসের প্রথম ২৮ দিনেই দেশে এসেছে ২৫৩ কোটি ৯২ লাখ ডলার রেমিট্যান্স। প্রতি ডলার ১২২ টাকা ধরে এর টাকার পরিমাণ দাঁড়ায় প্রায় ৩০ হাজার ৯৭৮ কোটি টাকা। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, রাষ্ট্র মালিকানাধীন ব্যাংকের মাধ্যমে এসেছে ৫৫ কোটি ৬৫ লাখ ডলার, বিশেষায়িত ব্যাংকের মধ্যে কৃষি ব্যাংকের মাধ্যমে এসেছে ৩৬ কোটি ১২ লাখ ডলার, বেসরকারি ব্যাংকের মাধ্যমে এসেছে ১৬১ কোটি ৬১ লাখ ৪০ হাজার ডলার এবং বিদেশি ব্যাংকের মাধ্যমে এসেছে ৫৩ লাখ ৭০ হাজার ডলার।

তবে জুনের প্রথম ২৮ দিনে আটটি ব্যাংকের মাধ্যমে কোনো রেমিট্যান্স আসেনি। এ তালিকায় রয়েছে রাষ্ট্র মালিকানাধীন বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক ও বিশেষায়িত রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংক। বেসরকারি খাতের মধ্যে রয়েছে কমিউনিটি ব্যাংক, সিটিজেনস ব্যাংক, আইসিবি ইসলামী ব্যাংক এবং পদ্মা ব্যাংক। বিদেশি ব্যাংকের মধ্যে কোনো রেমিট্যান্স আসেনি ন্যাশনাল ব্যাংক অব পাকিস্তান এবং স্টেট ব্যাংক অব ইন্ডিয়ার মাধ্যমে।

২০২৪-২৫ অর্থবছরের মাসভিত্তিক রেমিট্যান্স প্রবাহের দিকে তাকালে দেখা যায়, জুলাইয়ে এসেছে ১৯১ কোটি ৩৭ লাখ ৭০ হাজার ডলার, আগস্টে ২২২ কোটি ১৩ লাখ ২০ হাজার ডলার, সেপ্টেম্বরে ২৪০ কোটি ৪১ লাখ ডলার, অক্টোবরে ২৩৯ কোটি ৫০ লাখ ডলার, নভেম্বরে ২২০ কোটি ডলার এবং ডিসেম্বরে ২৬৪ কোটি ডলার। ২০২৫ সালের জানুয়ারিতে এসেছে ২১৯ কোটি ডলার, ফেব্রুয়ারিতে ২৫৩ কোটি ডলার, মার্চে সর্বোচ্চ ৩২৯ কোটি ডলার, এপ্রিলে ২৭৫ কোটি ডলার এবং মে মাসে এসেছে ২৯৭ কোটি ডলার। একক মাসে দেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ রেমিট্যান্স এসেছে মার্চে, যা ৩৩০ কোটি ডলার ছাড়িয়ে গেছে।

বিশ্লেষকরা মনে করছেন, রেমিট্যান্স প্রবাহে এই উল্লম্ফনের পেছনে রয়েছে হুন্ডি প্রতিরোধে সরকারের কঠোর পদক্ষেপ, প্রবাসীদের বৈধ ব্যাংকিং চ্যানেলে টাকা পাঠাতে উৎসাহিত করা, প্রণোদনা বৃদ্ধি এবং ডিজিটাল পেমেন্ট ব্যবস্থার উন্নয়ন। বাংলাদেশ ব্যাংক জানিয়েছে, এই বিপুল রেমিট্যান্স বৈধ ব্যাংকিং চ্যানেলের মাধ্যমেই এসেছে, যা দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে স্বস্তি এনে দিয়েছে।

গবেষণা সংস্থা চেঞ্জ ইনিশিয়েটিভের রিসার্চ ফেলো ও অর্থনীতিবিদ এম হেলাল আহমেদ জনি বলেছেন, রেমিট্যান্সপ্রবাহে বাংলাদেশের এই অভূতপূর্ব সাফল্য শুধু পরিসংখ্যানগত অর্জন নয়, এটি দেশের সামষ্টিক অর্থনীতির স্থিতিশীলতার জন্য শক্ত ভিত্তি তৈরি করছে। তাঁর মতে, সরকারি প্রণোদনা, হুন্ডি প্রতিরোধে প্রযুক্তিনির্ভর উদ্যোগ এবং প্রবাসীদের জন্য সহজতর ব্যাংকিং সেবা একত্রে রেমিট্যান্স বৃদ্ধির মূল চালিকাশক্তি।

তবে বিশ্লেষকরা সতর্ক করেছেন, দীর্ঘমেয়াদে এই ধারা ধরে রাখতে হলে প্রবাসী শ্রমবাজার আরও বহুমুখীকরণ, অভিবাসন প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা এবং প্রবাসীদের দক্ষতা বৃদ্ধিতে রাষ্ট্রীয় বিনিয়োগ বাড়ানো জরুরি। কারণ রেমিট্যান্স কেবল বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের উৎস নয়, এটি বাংলাদেশের অর্থনীতিকে টেকসই প্রবৃদ্ধির পথে এগিয়ে নেওয়ার একটি কৌশলগত হাতিয়ার।

সব মিলিয়ে, ২০২৪-২৫ অর্থবছরে বাংলাদেশের প্রবাসী আয় এক নতুন উচ্চতা ছুঁয়েছে, যা দেশের অর্থনীতিকে আরও দৃঢ় ভিত্তির ওপর দাঁড় করাবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

আপনার জেলার সংবাদ পড়তে