বাংলাদেশের অর্থনীতিতে সাম্প্রতিক সময়ে প্রবাসী আয়ের প্রবাহ যেমন স্বস্তি এনেছে, তেমনি এর প্রভাব পড়তে শুরু করেছে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের ওপরও। রোববার (২৯ জুন) বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক আরিফ হোসেন খান জানিয়েছেন, দেশের বৈদেশিক মুদ্রার মোট রিজার্ভ দাঁড়িয়েছে ৩১ দশমিক ৩১ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে, যা গত ২৮ মাসের মধ্যে সর্বোচ্চ। এর আগে সর্বশেষ ২০২৩ সালের মার্চের শুরুতে রিজার্ভ ৩২ বিলিয়ন ডলারের নিচে নেমেছিল এবং ওই বছরের ১৫ মার্চ তা ছিল ৩১ দশমিক ২৯ বিলিয়ন ডলার। সেই তুলনায় বর্তমানে রিজার্ভের পরিমাণ বেশ কিছুটা বৃদ্ধি পেয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, ২৯ জুন পর্যন্ত দেশের গ্রস রিজার্ভের পরিমাণ ৩১ হাজার ৩১৩ দশমিক ৭৫ মিলিয়ন ডলার। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) বিপিএম-৬ পদ্ধতিতে হিসাব করা রিজার্ভ দাঁড়িয়েছে ২৬ হাজার ৩২৫ দশমিক ৫৬ মিলিয়ন ডলারে, যা আইএমএফ পদ্ধতিতে হিসাব শুরুর পর থেকে সর্বোচ্চ। এর আগে চলতি মাসের ২৬ জুন পর্যন্ত গ্রস রিজার্ভ ছিল ৩০ দশমিক ৫১ বিলিয়ন ডলার এবং আইএমএফ পদ্ধতিতে তা ছিল ২৫ দশমিক ৫১ বিলিয়ন ডলার। একই সময়ে নিট রিজার্ভের পরিমাণ ছিল ১৯ দশমিক ৮০ বিলিয়ন ডলার, যা ২৯ জুনে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২০ হাজার ৩১৯ দশমিক ৮৯ মিলিয়ন ডলারে।
২০২৩ সালের জুন মাস থেকে আইএমএফের বিপিএম-৬ পদ্ধতিতে রিজার্ভের হিসাব প্রকাশ শুরু করে বাংলাদেশ ব্যাংক। সেই বছরের জুনে আইএমএফের পদ্ধতিতে রিজার্ভের পরিমাণ ছিল ২৪ দশমিক ৭৫ বিলিয়ন ডলার এবং গ্রস রিজার্ভ ছিল ৩১ দশমিক ২০ বিলিয়ন ডলার। অথচ ২০২১ সালের আগস্টে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ প্রথমবারের মতো ৪৮ বিলিয়ন ডলারের মাইলফলক অতিক্রম করেছিল। এরপর রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং অর্থনীতির চাপের কারণে ধারাবাহিকভাবে রিজার্ভ হ্রাস পেতে থাকে এবং আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের আগে গত বছরের জুলাই মাস শেষে তা নেমে যায় ২০ দশমিক ৪৮ বিলিয়ন ডলারে। সেই অবস্থা থেকে রিজার্ভ পুনরায় বাড়তে শুরু করেছে।
রিজার্ভ বৃদ্ধির পেছনে বেশ কিছু কারণ কাজ করছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। বিশেষ করে অর্থপাচার রোধে সরকারের কঠোর পদক্ষেপ, প্রবাসী আয় বৈধ চ্যানেলে আনার জন্য নীতিগত সুবিধা এবং আন্তর্জাতিক সংস্থা যেমন আইএমএফ, বিশ্বব্যাংক ও এডিবির কাছ থেকে প্রায় ৫ বিলিয়ন ডলারের ঋণ পাওয়া রিজার্ভ বাড়াতে সহায়ক হয়েছে।
এদিকে, প্রবাসী আয়ের ক্ষেত্রেও এ বছর অভাবনীয় সাফল্য এসেছে। চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের ২৮ জুন পর্যন্ত দেশে এসেছে ৩০ দশমিক ০৪ বিলিয়ন বা ৩ হাজার ৫ কোটি মার্কিন ডলার রেমিট্যান্স, যা দেশের ইতিহাসে এক অর্থবছরে সর্বোচ্চ রেমিট্যান্স প্রবাহের রেকর্ড। এর মধ্যে শুধু জুন মাসের প্রথম ২৮ দিনেই এসেছে ২৫৩ কোটি ৯২ লাখ মার্কিন ডলার, যেখানে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ব্যাংকের মাধ্যমে এসেছে ৫৫ কোটি ৬৪ লাখ ৬০ হাজার ডলার, বিশেষায়িত ব্যাংকের মাধ্যমে এসেছে ৩৬ কোটি ১২ লাখ ৩০ হাজার ডলার, বেসরকারি ব্যাংকের মাধ্যমে এসেছে ১৬১ কোটি ৬১ লাখ ৪০ হাজার ডলার এবং বিদেশি ব্যাংকের মাধ্যমে এসেছে ৫৩ লাখ ৭০ হাজার ডলার।
সব মিলিয়ে, প্রবাসী আয়ের ধারা এবং রিজার্ভ বৃদ্ধির এই চিত্র দেশের অর্থনীতিতে সাময়িক স্বস্তি ফিরিয়েছে। অর্থনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, দীর্ঘমেয়াদে এই ধারা ধরে রাখতে হলে প্রবাসী শ্রমবাজারে বৈচিত্র্য আনা, অর্থ পাচার আরও কঠোরভাবে দমন করা এবং রপ্তানি বাজার সম্প্রসারণের দিকে মনোযোগ দিতে হবে।