বিশ্বজুড়ে আবারও ইতিহাসের নতুন অধ্যায় লিখল দক্ষিণ কোরিয়ার বিখ্যাত ওয়েব সিরিজ ‘স্কুইড গেম’। প্রথম সিজন মুক্তির পরই যে ঝড় তুলেছিল বিশ্ববাজারে, সেই ধারাবাহিকতায় শুক্রবার (২৭ জুন) মুক্তি পেল এর তৃতীয়, তথা শেষ সিজন। আর মুক্তির ঠিক একদিনের মধ্যেই গড়ে ফেলল নতুন রেকর্ড।
শনিবার (২৮ জুন) ফ্লিক্সপ্যাট্রলের প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, ‘স্কুইড গেম সিজন ৩’ নেটফ্লিক্সের ইংরেজি ও অ-ইংরেজি—উভয় বিভাগের মধ্যে সবচেয়ে বেশি দেখা সিরিজে পরিণত হয়েছে। শুধু তাই নয়, রোববার (২৯ জুন)-ও শীর্ষস্থান ধরে রাখে সিরিজটি। বিশ্বব্যাপী ৯৩টি দেশের টপ চার্টে এক নম্বর অবস্থানে উঠে যাওয়া কোনো কোরিয়ান সিরিজের জন্য এবারই প্রথম ঘটনা। যেখানে প্রথম সিজনকে এক সপ্তাহ সময় লেগেছিল শীর্ষে যেতে, আর দ্বিতীয় সিজন ৮০টি দেশের তালিকায় জায়গা করেছিল, সেখানে তৃতীয় সিজন মাত্র একদিনেই পৌঁছে গেছে আরও বড় মাইলফলকে।
সিরিজটির মূল কাহিনি আবর্তিত হয়েছে আর্থিক সংকটে জর্জরিত কিছু মানুষের চারপাশে, যারা প্রলুব্ধ হয় বিপজ্জনক খেলার প্রতিযোগিতায়। যেখানে পরাজয়ের অর্থ মৃত্যু। পরিচালক হোয়াং দং-হিউক শুরু থেকেই এই গল্পকে শুধু বিনোদনের মাধ্যমে উপস্থাপন করেননি, বরং এর ভেতর লুকিয়ে দিয়েছেন পুঁজিবাদী সমাজের কঠোর বাস্তবতা, বৈষম্য, এবং মানবিক টানাপোড়েনের বার্তা।
তৃতীয় সিজনের মুক্তির পর দর্শকের প্রতিক্রিয়াও চমকপ্রদ। ইউটিউবে এক দর্শক মন্তব্য করেছেন, “আমার মনে হচ্ছে ‘স্কুইড গেম ৩’ কোরিয়ান সমাজের প্রকৃত অনুভূতি এবং অন্তর্নিহিত অস্থিরতা ফুটিয়ে তুলেছে।” আরেকজন লিখেছেন, “সিরিজটি বাস্তবতাকে এত সুন্দরভাবে প্রতিফলিত করে যে, মনে হয় জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রেই যেন কঠিন প্রতিযোগিতা আর নির্মমতা ঘিরে রেখেছে আমাদের।”
সিরিজটির প্রেক্ষাপটের বাস্তবিক ছোঁয়া রয়েছে দক্ষিণ কোরিয়ার শ্রম-আন্দোলনের ইতিহাসেও। যেমন, প্রধান চরিত্র সিওং গি-হুন-এর গল্প অনুপ্রাণিত হয়েছে ২০০৯ সালে স্যাংইয়ং মোটর কারখানার শ্রমিক আন্দোলন থেকে, যেখানে বড় আকারের ছাঁটাইয়ের বিরুদ্ধে শ্রমিকরা ধর্মঘটে নেমেছিলেন। এছাড়া, সিরিজের বিভিন্ন চরিত্র যেমন মাসিক বেতনে চাকরি করা ব্যক্তি, অভিবাসী শ্রমিক বা ক্রিপ্টোকারেন্সি প্রতারক—সবই কোরিয়ান সমাজের পরিচিত চেহারা।
সিরিজটির সামাজিক-রাজনৈতিক তাৎপর্য এতটাই গভীর যে, দক্ষিণ কোরিয়ার রাজনৈতিক নেতারাও এটিকে জাতীয় পরিচয়ের অংশ হিসেবে দেখছেন। নতুন প্রেসিডেন্ট লি জে-মিয়ং এই জনপ্রিয় সিরিজ, বিটিএস এবং অস্কারজয়ী ‘প্যারাসাইট’কে পুঁজি করে ‘কে-কালচার’ আরও বিশ্বব্যাপী রপ্তানি করতে চান।
তৃতীয় সিজনের সাফল্যে রেটিংও বেশ ভালো। IMDb-তে এটি পেয়েছে ৮.০/১০, আর রটেন টমেটোজে ৮৩% অ্যাপ্রুভাল রেটিং। যদিও সমাপ্তি এবং কিছু দৃশ্য নিয়ে দর্শকদের মধ্যে মতভেদ রয়ে গেছে, তবুও এ সিরিজের জনপ্রিয়তায় কোনো ভাটা পড়েনি।
মুক্তির ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই ‘স্কুইড গেম ৩’ নিয়ে টিকটক, গুগল ট্রেন্ডস, এবং এক্স (সাবেক টুইটার) সহ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বয়ে গেছে রিভিউ, মিম এবং প্রতিক্রিয়ার ঝড়। সিউলের রাস্তায়ও শনিবার (২৮ জুন) আয়োজন হয়েছিল বিশাল শোভাযাত্রার, যেখানে দেখা যায় সিরিজের বিখ্যাত কিলার ডল, মুখোশধারী গার্ড এবং ট্র্যাকস্যুট পরিহিত ভিন্ন ভিন্ন চরিত্রের মডেল।
এই অসাধারণ সাফল্যের রেশ কাটতে না কাটতেই নেটফ্লিক্স ঘোষণা দিয়েছে, ‘স্কুইড গেম’-এর একটি আমেরিকান রিমেক তৈরি হচ্ছে। ধারণা করা হচ্ছে, এই নতুন সংস্করণে দেখা যেতে পারে হলিউডের জনপ্রিয় সব তারকাকে। ফলে দক্ষিণ কোরিয়ার এই সিরিজ যে বিশ্বব্যাপী এক গ্লোবাল ব্র্যান্ডে পরিণত হচ্ছে, তাতে আর কোনো সন্দেহ নেই।