পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়ায় বেক্সিমকোর মালিক সালমান এফ রহমানের অঙ্গপ্রতিষ্ঠান করতোয়া সোলার লিমিটেড কেন্দ্র স্থাপন প্রকল্পটি ৩৬ জুলাই/২৪ এ গুটিয়ে নেয়ার পর ফের ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে। এলাকাবাসী কোম্পানীর হাত থেকে পৈতৃক জমাজমি জবর দখল রক্ষার্থে ফের মামলার আতংকে পড়েছে।
এলাকাবাসী সূত্রে জানা যায় ২০২০ সালের জানুয়ারি মাসে করতোয়া সোলার লিমিটেড (কেএসএল) এর সাথে ৩০ মেগাওয়াট সোলার প্ল্যান্ট স্থাপন ও পাওয়ার ক্রয় চুক্তি স্বাক্ষর করেছে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (বিপিডিবি)। এই চুক্তির ফলে কেএসএলের উৎপাদিত বিদ্যুৎ ক্রয় করবে বিপিডিবি। করতোয়া সোলার লিমিটেড ১৩০ একর জমির উপর এই প্রকল্প বাস্তবায়ন করবে। এ লক্ষ্যে ২০১৭ সালে জমি ক্রয় শুরু করে। স্থানীয় জমি বন্দোবস্তকারী ফঁড়িয়া দালালের মাধ্যমে দুই বছরে প্রায় ২৭৬ একর জমি ক্রয় করেন। কিন্তু কোম্পানিটি দখল পেয়েছে মাত্র ৯০ একর। পতিত স্বৈরাচারি শেখ হাসিনা সরকারের প্রভাব খাটিয়ে বেক্সিমকো কোম্পানি শেখগছ মৌজার কিছু জমাজমি ক্রয় করেন। তখন কোম্পানির জমি ক্রয়ে কাগজপত্রের তেমন সঠিকতার প্রয়োজন মনে করেনি। কোম্পানী ক্ষমতার দাপটে স্থানীয়দের অবিক্রিত আবাদি জমি ফসল নষ্ট করে দখলে নেন। জমি বন্দোবস্তকারীরা ব্যক্তিরা জমির মালিকদের সঙ্গে প্রতারণা করে জমি ক্রয়-বিক্রয় সম্পাদন করেছেন। কোম্পানী প্রকৃত জমির মালিকদের কাছ থেকে জমি ক্রয় না করে দালালের খপ্পরে পড়ে ভুয়া জমির মালিক সাজিয়ে জমি ক্রয় করে। তখন ক্ষমতাশীন মিডিয়া ব্যক্তিরা নিয়মিত দলিল লেখকদের সহযোগিতায় বেক্সিমকো কোম্পানির ভুয়া ওয়ারিশান ও দাখিলার মাধ্যমে বিভিন্ন দলিল সম্পাদন করেন। তৎকালীন পঞ্চগড় জেলা প্রশাসক গত ২০২১ সালের আগস্ট মাসের ১৮ তারিখের ৩১.৪৭.৭৭০০.০১৭.৪২.০০৩.২১.৭০৩ নং স্মারকে করতোয়া সোলার লিমিটেড কর্তৃক ৩০ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন সৌরশক্তি বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনের নিমিত্তে জমি ক্রয়ের পূর্বানুমতির আদেশে শর্তাবলী বেঁধে দেন। কিন্তু তা লঙ্ঘন করে বেক্সিমকো কোম্পানি ‘করতোয়া সোলার লিমিটেড এর নামে জমি ক্রয় না করে ব্যক্তি মালিকানা নামে জমি ক্রয় করেন।
গত মঙ্গলবার সরেজিমন গিয়ে অনুসন্ধানে গেলে উপজেলার দেবনগর ইউনিয়নে বাংলাচন্ডি গ্রামের মৃত বয়জদ্দিনের ছেলে আব্দুল কাদের, মৃত হবিবর রহমানের ছেলে রিজিবুল, সফিজুল ইসলামের ছেলে হাসান, আব্দুল কাদেরের ছেলে নুরল, আব্দুস সামাতের ছেলে এরশাদ ও কলেজ ছাত্র রাব্বি জানান- বেক্সিমকো কোম্পানি একটি করতোয়া সোলার লিমিটেড এর ৩০ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন সৌরশক্তি বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনের জন্য তাদের আবাদযোগ্য ফসলী জমি জবর দখলের অপচেষ্টার অভিযোগ করেন। ভুক্তভোগীরা বলেন, কোম্পানিকে জেলা প্রশাসক মহোদয় আবাদি বা ফসলী জমি ক্রয় করতে নিষেধ করলেও তা মানে নাই। তখন কোম্পানীর উক্ত কর্মকান্ডের বিরুদ্ধে ওই গ্রামের মৃত বয়জদ্দিনের ছেলে আব্দুল কাদের জেলা প্রশাসক পঞ্চগড়সহ বিভিন্ন দপ্তরে লিখিত অভিযোগ দাখিল করেন। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে কোম্পানীর ব্যক্তিরা আব্দুল কাদেরসহ এলাকাবাসির উপর মিথ্যা মামলায় জড়ায়ে জেল হাজতে পাঠিয়ে তাদের আবাদী জমিগুলো জবর দখলে নেন। তারা জমি উদ্ধারের জন্য জেলা প্রশাসক, পুলিশ সুপার ও উপজেলা নির্বাহী অফিসার এবং স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের কাছেও ধন্যা দিয়ে বিচার সুবিচার পাননি।
মকবুলের স্ত্রী পুদিনা এবং আমিরুলের স্ত্রী শাহেরা জানান শেখ হাসিনা সরকারের সময় কোম্পানীর লোকজন অস্ত্র ও বন্দুক নিয়ে এলাকায় ঘুরেছেন। অন্য এলাকা থেকে ভাড়াটিয়া লোকজন এনে জমাজমি জবর দখল করেন। আমরা বাঁধা দিতে গেলে ভেকু মেশিন (কাকড়া মেশিন) এর ঠোঁট দিয়ে আমাদের মাটির সংগে পুঁতে দেয়ার ভয়ভীতি দেখাইছেন।
শেখগছ গ্রামের শফিকুল ইসলামের ছেলে বাদল বলেন, আমাদের তিন ফসলি জমির উপর কোন সোলার প্রকল্প যেনো বাস্তবায়ন করা হলে আমরা পরিবার পরিজন নিয়ে কিভাবে চলব; কোন জমিতে ফসল উৎপাদন করব। এখন শুনছি কোম্পানী গোপন উপজেলা সহকারি কমিশনার (ভূমি) অফিসে আমাদের অবিক্রিত জমাজমি ভুয়া দলিলের মাধ্যমে তাদের নামে মিউটেশন নাম জারি করে নিচ্ছে। কিন্তু মিউটেশন নাম জারির আমরা কোন নোটিশ পায়নি। প্রয়োজনে জীবন দিব কিন্তু ফসলি জমি নষ্ট করে সোলার প্রকল্প হতে দিব না।
ভুক্তভোগীরা জানান, ৩৬ জুলাই ২০২৪ সালের ছাত্র-জনতার আন্দোলন ও বিপ্লবের মধ্যে দিয়ে পতিত স্বৈরাচার শেখ হাসিনার পতনের পর কোম্পানীর লোকজন গাঁ ঢাকা দেন। তখন কোম্পানীর বেদখল দেয়া ও অবিক্রিত জমাজমি স্থানীয়রা পুনরায় দখলে নিয়ে চাষাবাদ করছেন। কিন্তু অন্তঃবর্তী সরকারের ৪ থেকে ৫ মাস যেতে না যেতেই কোম্পানী বিএনপি’র লোকজন ও লাবুকে নিয়ে পুনরায় সাইনবোর্ড লাগাতে গেলে তারা বাঁধা দেন। এরপরে আরও কয়েক দফায় জমি দখল সহ অফিস ঘর তোলার চেষ্টা করেন। সর্বশেষ গত ৬ জুলাই/ ২৫ রবিবার তেঁতুলিয়া মডেল থানার পিকআপে একদল পুলিশ সহ কোম্পানীর প্রতিনিধি এবং উপজেলা যুবদলের সভাপতি তাহমিদার রহমান লাবুকে নিয়ে সেখানে গেলে স্থানীয় জনতার প্রতিরোধে ফিরে আসেন। ভুক্তভোগী পরিবারগুলোর অভিযোগ আগে আওয়ামীলীগের লোকজন কোম্পানীর হয়ে জমাজমি দখল করেছে। ফলে তাদের মনে পৈতৃক জমা জমি পুনরায় বেদখল সহ কোম্পানীর মামলা মোকদ্দা পড়ার আতংক বিরাজ করছে। তারা এবিষয়ে উপজেলা নির্বাহী অফিসারের আশু দৃষ্টি কামনা করছেন।
উপজেলা বিএনপি’র সেক্রেটারী মো. রেজাউল করিম শাহীন বলেন, কোম্পানীর কেনা জমি তারা নিবে এখানে বিএনপি’র কোন লোকজন সহযোগিতা করে না। বরং যারা জমাজমি বিক্রি করেছে তারাই বিএনপি’র লোক। আমরা চাই কোম্পানী যেসমস্ত জমাজমি কিনেছে তা সার্ভে করে প্রতিষ্ঠানটি স্থাপিত হোক এবং এলাকার লোকজনের কর্মের সুযোগ সৃষ্টি হোক।
উপজেলা যুবদলের সভাপতি তাহমিদার রহমান লাবু বলেন, আমি কোম্পানীর কোন প্রতিনিধিত্ব করি না। আমাদের জমাজমি ওই প্রকল্পের পাশে আছে। তা দেখার জন্য গেলে লোকজন মনে করে কোম্পানীর হয়ে গেছি।
দেবনগড় ইউনিয়নের ৫নং ওয়ার্ডের বর্তমান জনপ্রতিনিধি (মেম্বার) মো. ওবায়দুল হক বলেন, এলাকার মানুষ কিছু জমাজমি কোম্পানীর কাছে বিক্রি ও বায়না করেছে। অপরদিকে কোম্পানীর লোকজন তখন ক্ষমতার দাপটে কারো জমি জবর দখল করেছে। আমি এসবের প্রতিবাদ করে জেল খেটেছি। হাসিনা সরকারের পতনের পর কিছুদিন শান্ত ছিল। এখন কোম্পানীর লোকজনের আনাগোনায় এলাকার জনমনে ফের মামলার অস্থিরতা ও অশান্তি বিরাজ করছে। আমি চাই প্রশাসনিকভাবে এই জটিলতা নিরসন করা হোক।
এবিষয়ে মুঠোফোনে জানতে চাইলে করতোয়া সোলার লিমিটেড (কেএসএল) এর স্থানীয় প্রজেক্ট অর্ডিনেটর মো. জহিরুল ইসলাম বলেন, ৩০ মেগাওয়ার্ট প্রকল্প স্থাপনের জন্য ১১০ একর জমি লাগে। উক্ত জমি কেনার জন্য সম্ভাবত ২২-২৩ জন মালিকের কাছে ২ কোটি টাকা বায়নাপত্র দলিল ও চুক্তি হয়েছে। কিন্তু ৫ আগস্ট/২৪ এর পর হাসিনা সরকার পতনের বেক্সিমকোর মালিক সালমান এফ রহমানের কোম্পানী মনে করে বিক্রিত জমি মালিকরা বেদখল দেয়ার চেষ্টা করছে। এখন কোম্পানি সেখানে না আসলে সেই টাকাও দিতে হবে না। এই নিয়ে কোম্পানীর সংগে জনসাধারণের মত বিরোধ রয়েছে। কিন্তু মানুষ বুঝে না কোম্পানী স্থাপন হলে এলাকার অনেক মানুষের কর্মের সুযোগ হবে এলাকার উন্নয়ন হবে।
এবিষয়ে মুঠোফোনে জানাতে চাইলে তেঁতুলিয়া মডেল থানার অফিসার ইনচার্জ মো. মুসা মিঞা বলেন, গত ৬ জুলাই/২৫ তারিখে ৯৯৯ এ ফোন পেয়ে সমস্যার কথা শুনে পিকআপ নিয়ে পুলিশের একটি দল করতোয়া সোলার কোম্পানী লিমিটেড কেন্দ্র এলাকায় গেছিল।
উপজেলা সহকারি কমিশনার (ভূমি) তেঁতুলিয়া (অতিরিক্ত দায়িত্ব) মোহন মিনজি বলেন, করতোয়া সোলার লিমিটেড (কেএসএল) এর জমাজমি ক্রয়-বিক্রয় নিয়ে এলাকায় সমস্যার কথা শুনেছি। এখনো উক্ত জমাজমির মিউটেশন (নাম জারির) বিষয়ে কোম্পানীর কোন প্রতিনিধি বা স্থানীয় কেউ আসেনি। যদি কোন অভিযোগ আসে তবে প্রকৃত মালিকানার কাগজপত্র যাচাই-বাছাই করে যথারীতি মিউটেশন প্রক্রিয়া সম্পাদন করা হবে।
উপজেলা নির্বাহী অফিসার মো. আফরোজ শাহীন খসরু বলেন, করতোয়া সোলার লিমিটেড কেন্দ্র স্থাপনের জমাজমি সংক্রান্ত বিষয়ে কোম্পানীর সংগে মামলা মোকদ্দমা নিয়ে স্থানীয় লোকজন নতুন করে আতংকে এমন অভিযোগ পাইনি। এলাকাবাসী কর্তৃক কোন অভিযোগ পেলে বিষয়টি তদন্ত করে শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় রাখতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।