লক্ষ্ণীপুরের রামগতি ও কমলননগর উপজেলার ভুলুয়া নদী পূনঃখনন না হওয়ায় অন্তত ১৫টি গ্রামে দীর্ঘস্থায়ী জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়েছে। এতে এসব এলাকার লক্ষাধিক মানুষ চরম দুর্ভোগে রয়েছেন। ব্যাহত হচ্ছে কৃষিকাজ, ফসলাধি ও রবিশস্য, ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে ঘর-বাড়ি, রাস্তাঘাট, ব্যবস্যা ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসহ সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন স্থাপনা। গত কয়েক দিনের টানা ভারি বৃষ্টিতে এই অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। গত বছরে জুলাই-সেপ্টম্বরে প্রায় আড়াই মাস বৃষ্টি ও বন্যার পানি স্থায়ীভাবে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হওয়ায় এসব এলাকার কয়েক হাজার মানুষকে আশ্রয়কেন্দ্রে সরিয়ে নিতে হয়েছিল। বন্ধ রাখতে হয়েছিল সরকারি-বেসরকারি কয়েকটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান।
জানা যায়, নোয়াখালীর বেগমগঞ্জ থেকে লক্ষ্ণীপুর সদর হয়ে আসা কমলনগরের পুর্বাঞ্চল এবং রামগতি উপজেলার উত্তর-পূর্বাঞ্চল দিয়ে প্রবাহিত হয়ে মেঘনা নদীতে পড়েছে ভুলুয়া নদী। মেঘনার প্রধান শাখা খরস্রোতা ৭৬ কিলোমিটার দীর্ঘ এই নদী জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে প্রাণশক্তি হারিয়ে মরা খালে পরিনত হয়েছে। নদীটি এখন নাব্যতা সংকটে ভুগছে এবং অবৈধ দখলদাদের কারণে এর প্রসস্থতা কমে গেছে। একসময় অথৈই পানি উত্তাল ঢেউ, তীব্র স্রোতের মধ্যে এ নদীর বুকে শোভা পেত পাল তোলা নৌকা। নদীটি পূনঃখনন না হওয়ায় শুষ্ক মৌসুমে হেঁটেই পার হওয়া যায়। আর বর্ষা মৌসুমে এ অঞ্চলের লক্ষাধিক মানুষ থাকে পানিবন্দি।
অবৈধ দখল আর প্রভাবশালীদের মাছ ধরার বাঁধ নির্মাণের কারণে ভুলুয়া নদীতে এখন আর জোয়ার-ভাটা নেই। এতে করে চাষাবাদ করতে পারছেন না কৃষকেরা। আবার বাঁধের কারণে বর্ষায় সৃষ্টি হয় জলাবদ্ধতা। এতে দুই মৌসুমেই ক্ষতির সম্মুখীন হতে হয় এ অঞ্চলের মানুষের। এ ছাড়া ভুলুয়া নদীর শাখা খালগুলোর মূখে স্লুইস গেটের দুই পাশে অবৈধ বাড়ি-ঘর ও দোকান নির্মাণ করে দখল হয়ে আছে।
সরেজমিনে দেখা গেছে, গত কয়েক দিনের টানা ভারি বৃষ্টিতে সৃষ্ট জলাবদ্ধতায় রামগতি-কমলনগরের লক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। টানা বৃষ্টির পানিতে উপজেলার চররমিজ, চরআলগী, চরপোড়াগাছা, চরবাদাম ইউনিয়নের প্রায় ১০টি এবং কমলনগর উপজেলার চর কাদিরা ইউনিয়নের ৫টি গ্রাম জলমগ্ন হয়ে আছে। এর মধ্যে চরপোড়াগাছা ও চরবাদাম ইউনিয়ন পুরোটাই পানির নিচে।
স্থানীয়রা জানান, জেএসডির সভাপতি আ স ম আবদুর মন্ত্রী থাকাকালীন তার প্রচেষ্টায় ১৯৯৮ সালে ভুলুয়া নদী প্রথম খননের পর এসব এলাকায় চাষাবাদ, মানুষের চলাচলসহ বাড়িঘর গড়ে উঠে। কয়েক বছর যেতে না যেতেই প্রভাবশালী একটি সিন্ডিকেট ভুলুয়া নদী দখল করে বাড়ি-ঘর ও দোকানঘর নির্মাণ, অবৈধভাবে বাঁধ দিয়ে মাছ ধরা, মাছের ঘের তৈরি, নদীসংলগ্ন শাঁখা খাল দখল, খালে পানিপ্রবাহ বন্ধকারী জাল বসানো, ব্রীজ ও কালভার্টের মুখে বাঁধ দিয়ে পানির প্রবাহ বন্ধ করে দেয়। এতে পানি চলাচলে প্রতিবন্ধকতা থাকায় বৃষ্টি হলেই জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হচ্ছে।
স্থানীয় ইউপি সদস্য নাজিম উদ্দিন দালাল জানান, নদীটি পূনঃখনন না করার কারণে এই অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। গত বছরে প্রায় আড়াই মাস বৃষ্টি ও বন্যার পানি স্থায়ীভাবে জলাবদ্ধতা থাকায় এসব এলাকার কয়েক হাজার মানুষকে আশ্রয়কেন্দ্রে রাখা হয়েছিল। সেই দুর্ভোগ এখন আবার শুরু হয়েছে।
গত বছর বন্যা ও অতিবৃষ্টির পানিতে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়ে এসব এলাকার ৫শ’ হেক্টর জমির বীজতলা সম্পুর্ন নষ্ট হয়ে গেছে। এতে এসব এলাকার কৃষকদের প্রায় সাড়ে ৭ কোটি টাকা ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে বলে জানায় উপজেলা কৃষি বিভাগ।
চর পোড়াগাছা ইউনিয়নের চর কলাকোপা স্লুইস গেট এলাকার কৃষক আবদুল মালেক জানান, গত বছর ৪৮ শতাংশ জমিতে তিনি বিভিন্ন জাতের প্রায় দেড় মন ধানের বীজতলা করেছেন। এতে বীজতলা তৈরী করতে জমিচাষ ও বীজসহ প্রায় ৩০ হাজার টাকা খরচ হয়েছে। টানা বৃষ্টিতে জলাবদ্ধতায় তাঁর সব বীজতলা নষ্ট হয়ে গেছে। এতে তিনি আর ধান চাষ করতে পারেনি। এর আগে আবদুল মালেক প্রায় ১৩ একর জমিতে বিভিন্ন জাতের আমন ধানের চাষ করতেন।
ভুলুয়া নদীর বাঁধ অপসারণ করে জলাবদ্ধতা নিরসনে বিভিন্ন সময়ে মানববন্ধন, স্মারকলিপি প্রদান ও সভা-সমাবেশ করেছে এলাকাবাসী। এছাড়া ভুলুয়া নদীতে বাঁধ অপসারণে উচ্চ আদালতের নির্দেশনা থাকলেও আজও কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নেয়নি সংশ্লিষ্ট দপ্তর।
লক্ষ্ণীপুর পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী নাহিদ-উজ-জামান খান জানান, গত বছরের ৪ জুন ভুলুয়া নদী পূনঃখননের একটি প্রকল্পের প্রস্তাবনা উর্ধ্বতন কতৃপক্ষের বরাবরে পাঠানো হয়েছে। এছাড়া ভুলুয়া নদীটি খননের বিষয়ে একটি সমন্বিত স্টাডি চলছে। নদীটি খনন করা গেলে লক্ষ্ণীপুর সদর, কমলনগর ও রামগতি উপজেলার বিস্তীর্ণ এলাকা জলাবদ্ধতার হাত থেকে রক্ষা পাবে। একই সঙ্গে মিষ্টি পানি ধরে রাখার মাধ্যমে কৃষি কাজকে প্রমোট করা যাবে। বরাদ্দ পেলে এলাকার মানুষের উপকারের জন্য, কৃষি ভুমির উপকারের জন্য শিগগিরই নদী খননের কাজ শুরু করা হবে জানান এই কর্মকর্তা।