বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সময় গুলিবিদ্ধ শিক্ষার্থী তোফাজ্জলের শরীর থেকে তিনটি রাবার বুলেট বাহির করা হলেও এখনো ১৬/১৭ টি রাবার বুলেট শরীরের পিঠের বাম পাশে ও ডান পায়ে রয়ে গেছে। স্বাভাবিকভাবে কোন কাজকর্ম করতে পারেনা । এমনকি একটু হাঁটা-চলা করলে ব্যথা হয়। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন শুরু হওয়ার পর থেকেই মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জ উপজেলার এম,এ,ওয়াব উচ্চ বিদ্যালয়ের দশম শ্রেণির শিক্ষার্থী তোফাজ্জল হোসেন (১৭) মনে উত্তাল আন্দোলনের ঢেউ লাগে । গত বছরের জুলাইয়ে আন্দোলন শুরুর পরবর্তী ৪ আগষ্ট পরিবারের কাহাকেও না জানিয়ে মৌলভীবাজার জেলা শহরে আন্দোলনের মিছিলে অংশগ্রহণ করতে চলে যায়। ছাত্রদের মিছিলে গিয়ে দফায় দফায় পুলিশের ছোঁড়া রাবার বুলেট তার শরীরে বিদ্ধ হয়। আলাপ কালে তোফাজ্জল " আমার দেশ " কে জানান, ৪ আগস্ট ঘটনার দিন সকাল সাড়ে ৯টার দিকে বাড়ীতে কাউকে কিছু না জানিয়ে তোফাজ্জল মৌলভীবাজার শহরের রওনা দেয়। আগেই সে খবর পেয়েছে সেখানে ছাত্ররা মিছিল করছে। দুপুরে মৌলভীবাজার সরকারি কলেজ থেকে বের হওয়া ছাত্র মিছিলে সে যোগ দেয়। মিছিলটি শহরের সাকুরা মার্কেট এলাকায় পৌঁছলে পুলিশ প্রথমে কিছু শিক্ষার্থীকে জিজ্ঞাসাবাদ করে। এরপর মিছিলটি যখন শান্তিপূর্ণভাবে চৌমুহনী এলাকায় যায়, তখন পুলিশ হটাত করে রাবার বুলেট ও টিয়ার গ্যাস ছোড়ে এবং লাঠিচার্জ শুরু করে। এ সময় তার চোখের সামনেই কয়েকজন শিক্ষার্থী রক্তাক্ত হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। তোফাজ্জল বলেন, তখন দুপুর দেড়টা থেকে দুইটা। হঠাৎ করে তার নিজের শরীরেও ৬-৭টি রাবার বুলেট এসে লাগে। সে দৌড়ে একটি বাসার বারান্দায় আশ্রয় নেয়। কিছু সময় পরে আবারও মিছিল শুরু হলে মিছিলে যোগ দিয়ে চাঁদনীঘাটের ব্রিজে পৌঁছলে পুলিশ আবারো গুলি ছোড়ে। তখন তোফাজ্জলের শরীরের বিভিন্ন অংশে- হাতে, পায়ে পর পর কয়েক রাউন্ড গুলি লাগে। সে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। কিছুক্ষণ পর জ্ঞান ফিরে পেলে একটি অটোরিকশার পেছনে গিয়ে লুকিয়ে পড়ে। একটু শক্তি ফিরে পেলে সে টলমল পায়ে একটি ফার্মেসিতে গিয়ে প্রাথমিক চিকিৎসা নিয়ে সন্ধ্যায় সিএনজিতে করে ৩৫ কিলোমিটার দূরের নিজ গ্রাম আদমপুর ইউনিয়নের কাউয়ারগলা গ্রামের নিজ বাড়িতে রক্তাক্ত অবস্থায় রাতে বাড়ি পৌঁছায়। আক্ষেপ করে বলে তার স্বপ্ন ছিল লেখাপড়া শিখে চাকুরী করে সংসারের অভাব অনটন দূর করবে।
তার সেই স্বপ্ন ধ্বংস হয়ে গেছে।
তোফাজ্জলের বাবা ইউছুফ আলী (৫৬) সবজি বিক্রয় করে সংসার চালান। মা সিতারা বেগম(৪১) জানান, তাদের চার সন্তানের মধ্যে তোফাজ্জল সবার ছোট। সে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় এসএসসি পরীক্ষা দিয়েছে। অভাবের কারণে বড় সন্তানদের লেখাপড়া বন্ধ হয়ে গেছে। মেয়ে রিমা আক্তার এসএসসি পাস করার পর আর পড়তে পারেনি।
তোফাজ্জলের বাবা ইউছুফ আলী জানান, ঘটনার পর পুলিশের ভয়ে প্রথমে ছেলেকে হাসপাতালে নিতে পারেননি। কয়েক দিন বিনা চিকিৎসায়
বাড়িতেই কষ্টে কাটাতে হয়। পরে ধার-দেনা করে ছেলের চিকিৎসার
জন্য ঢাকা-সিলেট দৌড়াতে হয়। কমলগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সেরর পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. মাহবুবুল হক ভূঁইয়ার রেফারেন্সে
তাকে ঢাকার সম্মিলিত সামরিক হাসপাতাল (সিএমএইচ) তাকে ভর্তি করে করানো হয় এবং বিনামূল্যে চিকিৎসা করে তোফাজ্জলের শরীর
থেকে দুটি দুটি গুলি বের করা এবং স্থানীয় এক পল্লী চিকিৎসক
আরও একটি গুলি বের করেন।
তোফাজ্জলের বাবা আরও জানান, গত ৮ মে মৌলভীবাজার
জেলা প্রশাসকের সম্মেলন কক্ষে জেলা প্রশাসক মোঃ ইসরাইল
হোসেন আর্থিক অনুদানের ১ লাখ টাকার চেক তোফাজ্জলকে
প্রদান করেন। এর আগেও জেলা প্রশাসক মোঃ ইসরাইল
হোসেন, তোফাজ্জলকে নগদ ১৫ হাজার টাকা দেন। এই
অর্থে পরিবারের ধারদেনা শোধ ও ছেলের লেখাপড়ার খরচ
চালিয়েছেন বলে জানান ইছুব আলী। তবু তোফাজ্জলের শরীরে
অন্তত ১৬-১৭টি রাবার বুলেট রয়ে গেছে। ব্যথার কারণে প্রায় সময়
ছটপট করে বিছানায় পরে থাকে। তিনি দূঃখ করে বলেন, আমার ও
ছেলের মায়ের এই ছেলেকে নিয়ে অনেক আশা ভরসা ছিল।
পড়ালেখা করে অনেক বড় হবে। চাকুরী করে সংসারের হাল ধরবে,
পরিবারের সবার মুখে হাসি ফুঁটাবে। আমাদের সব আশা ভরসা শেষ
হয়ে গেছে। ছেলের ভবিষ্যত নিয়ে চিন্তা করে রাতে ঘুমাতে পারিনা।
ছেলের চিকিৎসা করার মতো সামর্থ্য আমার নাই। ছেলে বেঁচে
থাকার জন্য চিকিৎসা ও কর্মসংস্থানের ব্যবস্থার জন্য সরকারের
কাছে আবেদন জানাই ।