সিরিয়ার সওয়েইদা প্রদেশে সংঘাতে নিহত ৫৯৪, সেনা প্রত্যাহার সত্ত্বেও চলছে ইসরায়েলি হামলা

নিজস্ব প্রতিবেদক | প্রকাশ: ১৮ জুলাই, ২০২৫, ১২:১১ পিএম
সিরিয়ার সওয়েইদা প্রদেশে সংঘাতে নিহত ৫৯৪, সেনা প্রত্যাহার সত্ত্বেও চলছে ইসরায়েলি হামলা

সিরিয়ার দক্ষিণাঞ্চলীয় সওয়েইদা প্রদেশে সাম্প্রদায়িক সহিংসতায় প্রাণ হারিয়েছেন অন্তত ৫৯৪ জন। ছয় দিনব্যাপী এই সংঘাতে মুখোমুখি হয়েছে দেশটির সংখ্যালঘু দ্রুজ গোষ্ঠী ও সুন্নি বেদুইন যোদ্ধারা। চলমান সহিংসতার মাত্রা আরও বাড়বে—এমন আশঙ্কায় বৃহস্পতিবার (১৭ জুলাই) অঞ্চলটি থেকে সেনা প্রত্যাহার করেছে সিরিয়ার অন্তর্বর্তী সরকার। তবুও থামেনি ইসরায়েলের বিমান হামলা। এই সংঘাতের কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে গোষ্ঠীগত বিরোধ, বিদেশি হস্তক্ষেপ এবং ভেঙে পড়া নিরাপত্তা কাঠামো।

রোববার (১৩ জুলাই) সওয়েইদায় নতুন করে সংঘর্ষ শুরু হয়। দ্রুত তা ছড়িয়ে পড়ে পুরো প্রদেশে। সিরিয়ান অবজারভেটরি ফর হিউম্যান রাইটস (SOHR) জানিয়েছে, সংঘর্ষে নিহতদের মধ্যে রয়েছে ৩০০ জন দ্রুজ, যাদের মধ্যে ১৪৫ জন যোদ্ধা এবং বাকিরা বেসামরিক নাগরিক। সরকারি বাহিনীর ২৫৭ জন এবং বেদুইন গোষ্ঠীর ১৮ জন যোদ্ধাও নিহত হয়েছেন বলে জানিয়েছে সংস্থাটি। এছাড়া ইসরায়েলি বিমান হামলায় নিহত হয়েছেন সিরিয়ার ১৫ জন সেনা সদস্য।

সহিংসতার তীব্রতা দেখে সওয়েইদা ছেড়ে পালিয়েছে প্রায় দুই হাজার পরিবার। প্রদেশটির প্রধান শহর এখন কার্যত জনশূন্য। সাংবাদিকদের বরাতে জানা গেছে, শহরের রাস্তায় রক্তাক্ত মরদেহ পড়ে আছে, দোকানপাট লুট হয়েছে এবং বাড়িঘরে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়েছে।

এমন পরিস্থিতিতে বৃহস্পতিবার রাতে এক টেলিভিশন ভাষণে অন্তর্বর্তী প্রেসিডেন্ট আহমেদ আল-শারা বলেন, সওয়েইদার নিরাপত্তার দায়িত্ব স্থানীয় সম্প্রদায় নেতাদের হাতে হস্তান্তর করা হবে। তিনি জানান, "জাতির চূড়ান্ত স্বার্থ সুরক্ষায় এই পদক্ষেপ জরুরি।" তিনি আরও আশ্বস্ত করেন, দ্রুজ সম্প্রদায়ের অধিকার ও নিরাপত্তা তার সরকারের সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার।

তবে পরিস্থিতি সামাল দিতে সরকারের এই উদ্যোগ প্রত্যাখ্যান করেছেন দ্রুজদের প্রভাবশালী ধর্মীয় নেতা শেখ হিকমত আল-হাজরি। তিনি ঘোষণা দিয়েছেন, যতক্ষণ না সরকারি বাহিনী পুরোপুরি সওয়েইদা ছাড়ছে, ততক্ষণ লড়াই চলবে। ধারণা করা হচ্ছে, তার নেতৃত্বাধীন যোদ্ধারা ইসরায়েলের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ার চেষ্টায় রয়েছেন। যদিও দ্রুজদের অপর একটি অংশ এখনো সরকারের প্রতি আনুগত্য বজায় রেখেছে।

ইসরায়েল এই সংঘাতকে একটি কৌশলগত সুযোগ হিসেবে দেখছে বলে ধারণা পর্যবেক্ষকদের। দেশটি সিরিয়ার দক্ষিণাঞ্চলে সেনা মোতায়েন ঠেকাতে এবং দ্রুজদের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে বিমান হামলা চালিয়ে যাচ্ছে। ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু বলেন, “আমরা সিরিয়ার সেনাবাহিনীকে দক্ষিণে প্রবেশ করতে দেবো না। দ্রুজদের কোনো ক্ষতি হতে দেবো না।”

ইসরায়েলি বাহিনী ইতিমধ্যে দামেস্কের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়সহ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনায় হামলা চালিয়েছে। এমনকি প্রেসিডেন্ট প্রাসাদের আশপাশেও বিস্ফোরণের শব্দ শোনা গেছে। ইসরায়েলের এসব পদক্ষেপকে ‘অযাচিত হস্তক্ষেপ’ হিসেবে আখ্যা দিয়েছে সিরিয়ার সরকার। প্রেসিডেন্ট কার্যালয় থেকে দেওয়া এক বিবৃতিতে বলা হয়, “ইসরায়েলের আগ্রাসী ভূমিকাই অঞ্চলকে আরও অস্থির করে তুলছে।”

এদিকে, সিরিয়ার সরকারি সংবাদ সংস্থা সানা জানিয়েছে, সেনা প্রত্যাহারের পরও ইসরায়েলি বাহিনী সওয়েইদার শহরতলিতে হামলা চালিয়েছে। পাল্টা বিবৃতিতে প্রশাসন দ্রুজ যোদ্ধাদের 'দুষ্কৃতিকারী' হিসেবে চিহ্নিত করে তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধবিরতি লঙ্ঘন ও বেসামরিকদের ওপর সহিংসতার অভিযোগ এনেছে।

এখন প্রশ্ন হলো, বহুপক্ষীয় এই সংঘাত কোথায় গিয়ে থামবে? ধর্মীয় বিভাজন, আঞ্চলিক শত্রুতা, আন্তর্জাতিক হস্তক্ষেপ ও অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব মিলিয়ে এই সংকট কেবল আরও জটিল হয়ে উঠছে। সাময়িক সেনা প্রত্যাহার বা বক্তব্যে শান্তির প্রতিশ্রুতি যতই দেওয়া হোক, মাঠের বাস্তবতা বলছে, সওয়েইদার সংকট এখনই কাটছে না।