দ্রুজ সংখ্যাগরিষ্ঠ সিরিয়ার সুইদা প্রদেশে এক সপ্তাহের রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের পর অবশেষে যুদ্ধবিরতিতে সম্মত হয়েছে সিরিয়া ও ইসরায়েল। শুক্রবার (১৮ জুলাই) তুরস্কে নিযুক্ত যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত টম ব্যারাক সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্স-এ দেওয়া এক পোস্টে এ তথ্য নিশ্চিত করেন। তার এই ঘোষণার মধ্য দিয়ে মধ্যপ্রাচ্যের এক নতুন ভূরাজনৈতিক সমীকরণ উন্মোচিত হলো, যেখানে কূটনৈতিক প্রচেষ্টায় যুক্ত হয়েছে যুক্তরাষ্ট্র, তুরস্ক, জর্ডানসহ আরও কিছু প্রতিবেশী রাষ্ট্র।
দ্রুজ, বেদুইন ও সুন্নি সম্প্রদায়ের মধ্যে সংঘর্ষে রক্তাক্ত হয়ে উঠেছে সিরিয়ার দক্ষিণাঞ্চলীয় সুইদা প্রদেশ। সিরিয়ান নেটওয়ার্ক ফর হিউম্যান রাইটস জানিয়েছে, রোববার (১৩ জুলাই) থেকে শুরু হওয়া সংঘর্ষে এখন পর্যন্ত ৩২১ জন নিহত হয়েছে, যাদের মধ্যে নারী, শিশু ও চিকিৎসাকর্মীরাও রয়েছেন। আহত হয়েছেন পাঁচ শতাধিক, বহু পরিবার বাস্তুচ্যুত হয়ে পড়েছে। সিরিয়ার জরুরি পরিষেবা মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, আহতদের চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে এবং শত শত পরিবারকে নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে।
সংঘাত শুরু হয় সিরিয়ার সরকারি বাহিনী এবং স্থানীয় দ্রুজ ও বেদুইন গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে মুখোমুখি অবস্থান থেকে। স্থানীয়দের অভিযোগ, সরকারি বাহিনী শান্তি প্রতিষ্ঠার বদলে দ্রুজ সম্প্রদায়ের ওপর সহিংস অভিযান চালায়। পাল্টা প্রতিক্রিয়ায় ইসরায়েল বুধবার (১৬ জুলাই) রাজধানী দামেস্ক এবং সুইদায় সিরিয়ার সরকারি বাহিনীর ওপর ব্যাপক বিমান হামলা চালায়। ইসরায়েলের দাবি, তারা শুধু দ্রুজ সম্প্রদায়কে রক্ষার জন্যই এই হামলা চালিয়েছে। ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু দ্রুজদের ‘ভ্রাতা’ আখ্যা দিয়ে বরাবরই তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিতের প্রতিশ্রুতি দিয়ে আসছেন।
শুক্রবার (১৮ জুলাই) ইসরায়েলের একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করে জানান, চলমান উত্তেজনার প্রেক্ষিতে ইসরায়েল ৪৮ ঘণ্টার জন্য সিরিয়ার নিরাপত্তা বাহিনীকে সুইদা জেলায় সীমিতভাবে প্রবেশের অনুমতি দিয়েছে। তবে সতর্ক করে বলা হয়, এই প্রবেশাধিকার কেবল সহিংসতা থামিয়ে স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনার প্রয়াসে ব্যবহার করতে হবে। একইসঙ্গে সিরিয়ার প্রেসিডেন্টের কার্যালয় থেকে জানানো হয়, ওই এলাকায় একটি বিশেষ বাহিনী মোতায়েন করা হচ্ছে যাতে রাজনৈতিক ও নিরাপত্তামূলক পদক্ষেপের মাধ্যমে শান্তি ফিরিয়ে আনা যায়।
তুরস্কে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত টম ব্যারাক এক্সে দেওয়া পোস্টে বলেন, “আমরা দ্রুজ, বেদুইন ও সুন্নিদের অস্ত্র নামিয়ে রাখতে এবং অন্যান্য সংখ্যালঘুদের সঙ্গে মিলে একটি নতুন ও ঐক্যবদ্ধ সিরিয়ান পরিচয় গড়ে তোলার আহ্বান জানাচ্ছি।” এই বক্তব্য যুদ্ধবিরতির রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটেও একটি ইঙ্গিত বহন করে—জাতিগত বিভাজন নয়, বরং সামগ্রিক জাতিসত্তার দিকে এগিয়ে যাওয়ার বার্তা।
তবে সংঘাত থামছে—এমন ইঙ্গিত এখনো স্পষ্ট নয়। শুক্রবারও হাজার হাজার বেদুইন যোদ্ধাকে সুইদায় প্রবেশ করতে দেখা গেছে। স্থানীয় সংবাদমাধ্যম সুইদা টোয়েন্টিফোরের প্রধান রায়ান মারুফ জানিয়েছেন, প্রদেশটির উত্তর ও পশ্চিমাংশে এখনো সংঘর্ষ অব্যাহত আছে। বিদ্যুৎ, পানি ও খাদ্যের তীব্র সংকটে ভুগছে স্থানীয় বাসিন্দারা। ২৮ বছর বয়সী মুদার নামের এক বাসিন্দা জানিয়েছেন, “চার দিন ধরে বিদ্যুৎ নেই, জ্বালানি নেই, খাবার নেই, পানীয় নেই—কোনো কিছুই নেই। আমরা খবরও সহজে পাচ্ছি না কারণ ইন্টারনেট ও ফোন সংযোগ কার্যত বিচ্ছিন্ন।”
এদিকে জাতিসংঘের মানবাধিকার দপ্তর সিরিয়ার অন্তর্বর্তী সরকারের বিরুদ্ধে বিচারবহির্ভূত হত্যা, অপহরণ এবং নির্বিচার সহিংসতার অভিযোগের নির্ভরযোগ্য তদন্ত নিশ্চিতের আহ্বান জানিয়েছে। মঙ্গলবার (১৫ জুলাই) সিরিয়ার একটি পারিবারিক সমাবেশে গুলিবর্ষণে অন্তত ১৩ জন নিহত হয় বলে জানানো হয়েছে জাতিসংঘের পক্ষ থেকে।
জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থাও জানিয়েছে, চলমান সংঘাত তাদের মানবিক সহায়তা কার্যক্রমকে মারাত্মকভাবে বাধাগ্রস্ত করছে। সংস্থাটি সব পক্ষকে মানবিক সহায়তা নিশ্চিত করতে পথ উন্মুক্ত করার আহ্বান জানিয়েছে।
বিশ্লেষকদের মতে, এই যুদ্ধবিরতি বাস্তবায়ন দীর্ঘমেয়াদে টিকিয়ে রাখা না গেলে সিরিয়ার দক্ষিণাঞ্চলীয় অস্থিতিশীলতা আরও জটিল আকার ধারণ করতে পারে। দ্রুজ সম্প্রদায়কে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা এই সংকট শুধু সিরিয়ার অভ্যন্তরীণ বিষয় নয়, বরং এটি মধ্যপ্রাচ্যের শক্তি-সমীকরণকেও নতুন করে সংজ্ঞায়িত করতে পারে।