বাংলাদেশে প্রতিবন্ধী জনগোষ্ঠীকে আজও অনেক ক্ষেত্রে দয়া ও করুণা নয়নে দেখা হয়। অথচ তাদের মাঝেও সুপ্ত রয়েছে অপার মেধা, সৃজনশীলতা ও সম্ভাবনার দীপ্ত আলো, যা সমাজ ও রাষ্ট্রের সঠিক যত্ন ও দিকনির্দেশনায় বিকশিত হতে পারে। উন্নয়নশীল একটি রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশকে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (SDG) অর্জন করতে হলে প্রতিবন্ধীদের সক্ষমতা বাড়ানো এবং তাদের অন্তর্ভুক্তিমূলক অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা সময়ের দাবি। জাতীয় প্রতিবন্ধী নীতিমালার (2013) তথ্যমতে, দেশের মোট জনসংখ্যার প্রায় ১.৩% প্রতিবন্ধী নাগরিক হিসেবে চিহ্নিত, যদিও বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার মতে এ হার প্রায় ৯-১০% পর্যন্ত হতে পারে। UNICEF বাংলাদেশের ২০২৪ সালের সাম্প্রতিক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, প্রতিবন্ধী শিশুদের ৭০%-এর বেশি শিক্ষা ব্যবস্থার মূল স্রোতের বাইরে। এটি শুধু একটি সংখ্যা নয়; এটি হারিয়ে যাওয়া হাজারো প্রতিভার গল্প, যা একটু যত্ন পেলে জাতিকে এগিয়ে নিতে পারত। বাংলাদেশে প্রতিবন্ধী জনগোষ্ঠীর উন্নয়নে ইতিবাচক পদক্ষেপ গ্রহণ করা হলেও, বাস্তবায়নে রয়েছে নানা সীমাবদ্ধতা। এখনো অধিকাংশ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান তাদের জন্য পর্যাপ্ত অবকাঠামো, শিক্ষাসামগ্রী কিংবা প্রশিক্ষিত শিক্ষক সংবলিত নয়। অনেক সরকারি চাকরি পরীক্ষায় এখনো শারীরিক সক্ষমতার মানদণ্ড অযৌক্তিভাবে প্রতিবন্ধীদের বঞ্চিত করে। অথচ সামান্য সহযোগিতা ও প্রযুক্তির সহায়তা দিয়ে একজন দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীও হতে পারে প্রশাসক, শিক্ষক বা গবেষক। আমরা বিশ্বব্যাপী বহু সফল প্রতিবন্ধীর দৃষ্টান্ত দেখতে পাই। যেমন—হেলেন কেলার, যিনি ছিলেন দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী ও বধির, অথচ হয়ে উঠেছেন মানবিক আন্দোলনের এক উজ্জ্বল প্রতীক।
স্টিফেন হকিং যিনি মোটর নিউরন ডিজিজে আক্রান্ত হয়েও হয়ে উঠেছেন পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানী। এই উদাহরণগুলো কেবল বিদেশের জন্য নয়; এগুলো আমাদের সচেতনতা ও নীতিনির্ধারণে অনুপ্রেরণা হতে পারে। বাংলাদেশেও সফল প্রতিবন্ধী মানুষের অভাব নেই। বহু প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থী বিশ্ববিদ্যালয়ে কৃতিত্বের সঙ্গে পড়াশোনা করছে। কেউ হুইলচেয়ারে বসেই ইউটিউব চ্যানেল খুলে হয়েছেন উদ্যোক্তা, কেউবা তথ্যপ্রযুক্তিতে প্রশিক্ষণ নিয়ে হয়েছেন ফ্রিল্যান্সার। তাদের পথ চলার গল্প আমাদের উপলব্ধি করায়—মেধা কখনো শারীরিক সক্ষমতার কাছে পরাজিত হয় না, যদি রাষ্ট্র হয় সহায়ক।
প্রতিবন্ধী জনগোষ্ঠীর উন্নয়নে এখন সময় এসেছে কাঠামোগত ও মনোভাবগত পরিবর্তনের। প্রথমত, শিক্ষা ব্যবস্থায় বিশেষ সহায়তামূলক ব্যবস্থা (special education support) বাড়ানো জরুরি—যেমন ব্রেইল বই, শ্রবণ সহায়ক যন্ত্র, সাইন ল্যাঙ্গুয়েজ প্রশিক্ষক, এবং শারীরিকভাবে সহজপ্রাপ্য ক্লাসরুম। দ্বিতীয়ত, কর্মসংস্থান ও দক্ষতা উন্নয়নের ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধীদের জন্য কোটার পাশাপাশি বাস্তব প্রশিক্ষণের সুযোগ বাড়ানো উচিত। শুধু চাকরি নয়—উদ্যোক্তা তৈরি, অনলাইন ভিত্তিক আয়ের উৎস, এমনকি খেলাধুলা ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডেও প্রতিবন্ধীদের সম্পৃক্ত করতে হবে। তৃতীয়ত, পরিবার ও সমাজের মানসিকতা বদলানো অত্যন্ত জরুরি।
অনেক সময় পরিবারই প্রতিবন্ধী শিশুকে আড়াল করে রাখে, লজ্জার বিষয় মনে করে; অথচ তাদের উৎসাহ দিলে এবং স্বাভাবিক সুযোগ দিলে তারাই হয়ে উঠতে পারে পরিবারের গর্ব, সমাজের সম্পদ। গণমাধ্যম, সিনেমা, সামাজিক মাধ্যমে প্রতিবন্ধীদের ইতিবাচক গল্প বেশি করে তুলে ধরলে সমাজে তাদের গ্রহণযোগ্যতা ও সম্মান অনেক বাড়বে। চতুর্থত, স্থানীয় সরকার ও সিটি করপোরেশন পর্যায়ে প্রতিবন্ধীবান্ধব অবকাঠামো (ramps, লিফট, শ্রবণ সংকেত ইত্যাদি) নিশ্চিত করা একান্ত প্রয়োজন। শুধু ঢাকায় নয়—উপজেলা, ইউনিয়ন পর্যায়ে স্কুল-কলেজ, অফিস-আদালত, স্বাস্থ্যকেন্দ্রে যেন সহজে প্রবেশযোগ্য হয় সকলের জন্য।
এছাড়া, প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জন্য ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে অংশগ্রহণের সুযোগ তৈরি করাও এখন সময়ের দাবি। অনেক দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী ব্যক্তি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ভিত্তিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে অনলাইন শিক্ষায় অংশ নিচ্ছেন, ব্লগ লিখছেন, এমনকি ফ্রিল্যান্সিং করে পরিবার চালাচ্ছেন। সরকার যদি এইখানে প্রযুক্তিনির্ভর সাপোর্ট দেয়, তাহলে প্রতিবন্ধীরা হয়ে উঠবে ডিজিটাল বাংলাদেশের সহযাত্রী—not burden, but builder. সবশেষে, আমাদের মনে রাখতে হবে—প্রতিবন্ধিতা কোনো অভিশাপ নয়, এটি সমাজের বৈচিত্র্যের অংশ।
তাদের প্রতি সহানুভূতির প্রয়োজন আছে, কিন্তু তার চেয়েও বেশি প্রয়োজন সমান সুযোগ, ন্যায্য অধিকার, এবং সম্মানজনক স্বীকৃতি। তারা কারো বোঝা নয়, তারা হচ্ছে এক একটি সম্ভাবনার আলোকস্তম্ভ—যদি আমরা একটু বিশ্বাস করি, একটু সহায়তা করি, এবং তাদের এগিয়ে যেতে দিই। আজকে যে শিশুটি শোনে না, দেখে না, বা হুইলচেয়ারে বসে—সেই শিশুই হয়তো আগামী দিনের বিসিএস ক্যাডার, দেশের শ্রেষ্ঠ শিক্ষক বা উদ্ভাবক। প্রয়োজন শুধু ভালোবাসা, যত্ন আর সম্মানজনক সুযোগের। তাহলেই সত্য হবে আমাদের স্বপ্ন—“কেউ পিছিয়ে থাকবে না”।