রোজকার মতো আজও বিকেলটা নেমে এসেছিল ধূসর চুপচাপ এক আকাশের নিচে। ঘরজোড়া নিঃশব্দতা, দেওয়ালের ক্যালেন্ডারে দিন শুধু পাল্টায়, সময় যেন নয়। রুমা জানালার ধারে বসে চা খাচ্ছিলেন। মুঠোফোনে বাজছিল রবীন্দ্রসঙ্গীত— “সে যে একা পথ চলে...”
এই একাকিত্বটাই তার সঙ্গী গত পনেরো বছর ধরে। স্বামী হারানোর পর সমাজ তাকে যে ভূমিকা বেঁধে দিয়েছিল, সে এক অবাক কারাগার। গরাদের নাম সংসার, দায়িত্ব, সন্তানের ভবিষ্যৎ। ভালোবাসা, সৌন্দর্য, নিজেকে ভালো লাগার অধিকার—সব যেন কুয়াশার মত হাওয়ায় মিলিয়ে গিয়েছিল।
রুমার বয়স এখন পঁইত্রিশের ঘরে। বয়স নয়, বিষণ্নতা যেন মুখে বয়সের রেখা ফুটিয়ে তুলেছে। সারাদিন স্কুলে পড়ান, সন্ধ্যায় পড়ার টেবিলের সামনে বসে থাকেন। আর রাতে… রাত্রি এসে বুকের মাঝখানে রেখে যায় এক দীর্ঘশ্বাসের আয়না।
এভাবেই চলছিল দিন, হঠাৎ একদিন স্কুলে এলেন একজন নতুন শিক্ষক—তাহসিন আহমেদ। সাহিত্য পড়ান। বয়সে রুমার চেয়ে সামান্য কম, মুখে সদাহাস্য, চোখে বোঝার গভীরতা।
প্রথম দেখা যেন ছিল না, যেন কোনো পুরোনো কাহিনির পুনরাবৃত্তি। তাহসিন ক্লাসরুমে কবিতা পড়াচ্ছিলেন—জীবনানন্দের “আবার আসিব ফিরে”। রুমা দরজার পাশে দাঁড়িয়ে ছিলেন। মুহূর্তটা থমকে ছিল—তাহসিন বললেন, “মৃত্যুর চেয়ে বেশি জীবনের প্রতি ভালোবাসা—এটাই তো আমাদের প্রত্যাবর্তনের আকুতি।”
সেই সন্ধ্যায় স্টাফ রুমে রুমাকে প্রশ্ন করেছিলেন তাহসিন, “আপনি কি লেখেন না?”
রুমা হেসে বলেছিলেন, “আগে লিখতাম, এখন শুধু জমা রাখি।”
“জমা রাখলে একদিন আত্মা বোঝা হয়ে পড়ে,” বলেছিলেন তাহসিন, মৃদুস্বরে।
তারপর থেকে দু’জনের মাঝখানে গড়ে উঠল এক অদৃশ্য সেতু—নতুন কিছু নয়, এক ধরনের গভীর বোঝাপড়া। কথা হতো সাহিত্যের, স্মৃতির, রাত্রির নিঃসঙ্গতার। প্রেমের নাম কেউ উচ্চারণ করত না, কিন্তু তার অনুপস্থিতিও অনুভবযোগ্য ছিল না।
তবে রুমার মনে দ্বন্দ্ব ছিল।
বিধবা নারী—তাও মধ্যবয়স্ক। সমাজ তাকে আর প্রেম করতে দেয় না। চোখ, ঠোঁট, হাসি—সবই যেন নিষিদ্ধের তালিকায়। অথচ তাহসিনের চোখে সে নিজেকে দেখত আলাদাভাবে—একজন নারী হিসাবে, মানুষ হিসাবে—not ‘একজন বিধবা’ হিসাবে।
একদিন সন্ধ্যায় রুমা ছাদের ধারে দাঁড়িয়ে ছিলেন। পেছনে এসে দাঁড়ালেন তাহসিন।
“আপনার চুলে চাঁদের আলো পড়েছে,” তিনি বললেন, “এমন করে কে দেখে আপনাকে?”
রুমা চুপ করে ছিলেন।
তাহসিন আবার বললেন, “আমি কি ভুল কিছু বললাম?”
রুমা ধীরে বললেন, “তুমি ঠিক বলো, কিন্তু আমি ভুল মানুষ।”
“ভালোবাসায় ভুল হয় না, রুমা আপা,” তাহসিনের গলা তখন নিঃশব্দ।
এরপর একদিন তাহসিন হঠাৎ স্কুলে এলেন না। সপ্তাহ কেটে গেল। রুমা জানলেন, তাহসিনের মা অসুস্থ। তার ঠিকানা সংগ্রহ করে গেলেন দেখতে। তাহসিনের ছোট্ট বাসায় গিয়ে তিনি দেখলেন, এক কোণায় রাখা আছে সেই ক্যানভাস—রুমার মুখ আঁকা হয়েছে জলরঙে।
তাহসিন কেঁদে বলেছিল, “আপনার ভেতরে আমি বসন্ত খুঁজে পাই, আপা। আপনি তো জানেন না, আপনি নিজেই একটা ঋতু।”
রুমা সেদিন প্রথমবার তাহসিনের হাত ছুঁয়ে বলেছিলেন, “আমার জীবনকে কেউ কোনোদিন ঋতু বলে দেখেনি। আমি কি পারি, আবার বিশ্বাস করতে, আমি বেঁচে আছি?”
তাদের মাঝে কোনো চুম্বন ছিল না, কোনো উচ্চারিত প্রেমের বাক্য ছিল না। কিন্তু ছিল একটা অটুট অঙ্গীকার—মরার আগেও ভালোবাসা জীবিত রাখা যায়।
সময় গড়ায়। সমাজের চোখে তারা অপরাধী হয়। স্কুলের অভিভাবকরা চিঠি লেখে, “এক বিধবা শিক্ষিকার এত অশোভন সম্পর্ক কাম্য নয়।”
প্রতিবাদে তাহসিন চাকরি ছেড়ে চলে যান অন্য শহরে। রুমা একা হয়ে যান আবার।
তবে এইবার সেই একাকিত্বে বিষাদ ছিল না। হৃদয়ের ভিতর খেলা করত সেই নীরব সম্পর্কের স্মৃতি। তাহসিনের দেওয়া একটি বইয়ের পাতায় লেখা ছিল এক লাইন:
"তোমার নিঃশব্দ চোখেই আমি বসন্তের মুখ দেখেছি—"
তার পাশে সই: “ত. আহমেদ”
রুমা জানেন, এই জীবন যেমন হোক, ভালোবাসা তার হয়েছে। তা সমাজ মানুক বা না-মানুক, চুলে পাক ধরুক, বয়স হোক পঁয়তাল্লিশ বা ষাট, হৃদয়ের ভিতর যদি বসন্ত বাঁচে, তবে জীবন কখনো মরেনা।
শেষ।