বাংলাদেশ আজ উন্নয়নের পথে দ্রুত এগুচ্ছে। কিন্তু দেশের সবচেয়ে বড় সম্পদ—শিশু-কিশোরদের শিক্ষার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হওয়ার সমস্যা আজও আমাদের বড় ব্যথার কারণ। অনেক শিক্ষার্থী বিদ্যালয় থেকে ঝরে পড়ে, যা শুধুমাত্র তাদের ব্যক্তিগত উন্নয়নের জন্য নয়, দেশের অর্থনৈতিক ও সামাজিক অগ্রগতির জন্যও ভয়াবহ সংকেত।
বাংলাদেশ শিক্ষা তথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরো (BANBEIS) ও ইউনিসেফের সাম্প্রতিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, প্রাথমিক স্তরে ঝরে পড়ার হার প্রায় ১৪.১৫ শতাংশ এবং মাধ্যমিক স্তরে প্রায় ৩৫.৬৬ শতাংশ। পার্বত্য চট্টগ্রাম, উপকূলীয় এলাকা এবং শহরের বস্তি এলাকায় এই হার আরও বেশি, যা ৪৫ শতাংশ পর্যন্ত পৌঁছায়।
ঝরে পড়ার পেছনের কারণগুলো
একটি শিশুর পড়াশোনা থেকে বিচ্যুত হওয়ার পেছনে রয়েছে বিভিন্ন প্রকার কারণ। আর্থিক সমস্যাই এর প্রধান কারণ। দরিদ্র পরিবারের শিশুরা প্রাত্যহিক জীবনের তাগিদে পড়াশোনা বাদ দিয়ে কাজ করতে বাধ্য হয়। পরিবারের অনেক সময় শিক্ষার চেয়ে জীবিকা নির্বাহ অগ্রাধিকার পায়।
বাল্যবিবাহ ও সামাজিক অনুপ্রবেশও শিক্ষার্থীদের ঝরে পড়ার অন্যতম কারণ। বিশেষ করে মেয়েরা শিক্ষায় অনেকে মধ্যপথেই থেমে যায়, কারণ পরিবারে ও সমাজে মেয়েদের জন্য বাল্যবিবাহ ও গৃহকর্মকে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়।
বিদ্যালয়ের দুরত্ব ও পরিবহন সুবিধার অভাবও একটি বড় সমস্যা। প্রত্যন্ত গ্রাম ও বস্তি অঞ্চলে স্কুল অনেক দূরে, নিরাপদ যাতায়াত ব্যবস্থা না থাকায় শিশুরা নিয়মিত বিদ্যালয়ে যেতে পারে না।
শিক্ষার মান ও পাঠ্যক্রমও প্রভাব ফেলে। ভারী ও একঘেয়ে বইপত্র শিশুদের আগ্রহ কমিয়ে দেয়। আধুনিক শিক্ষণ পদ্ধতির অভাব ও শিক্ষকদের অনিয়মিত উপস্থিতিও সমস্যা বাড়ায়।
সাম্প্রতিক সময়ে প্রযুক্তির অপব্যবহারও উদ্বেগজনক। অনলাইন গেম ও সোশ্যাল মিডিয়ায় সময় কাটানো শিক্ষার্থীদের মনোযোগে ব্যাঘাত ঘটায়, যার প্রভাব পড়াশোনায় পড়ে।
ঝরে পড়ার প্রভাব
একজন শিক্ষার্থী বিদ্যালয় থেকে বিচ্যুত হলে তার ভবিষ্যত সংকুচিত হয়। দক্ষ জনশক্তি হিসেবে তার গড়ে ওঠার সম্ভাবনা কমে যায়। অনেক ঝরে পড়া শিক্ষার্থী শিশু শ্রম, অপরাধ ও অশিক্ষিত জীবনযাপন করে, যা সামাজিক অবক্ষয়ের সূচনা।
দারিদ্র্য ও শিক্ষার অভাবে গড়ে ওঠা এই তরুণ প্রজন্ম দেশের মানবসম্পদকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (ILO) বলছে, দেশের শিশু শ্রমিকদের বড় অংশই ঝরে পড়া শিক্ষার্থীদের মধ্য থেকে আসে।
প্রতিকার ও করণীয়
এই সমস্যার সমাধান একক কোনো প্রতিষ্ঠানের দায়িত্ব নয়, বরং সরকারের, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের, সমাজ ও অভিভাবকের সম্মিলিত উদ্যোগের মাধ্যমে সম্ভব।
প্রথমত, সরকারকে শিক্ষা খাতে বরাদ্দ বৃদ্ধি করতে হবে। দরিদ্র ও সুবিধাবঞ্চিত পরিবারের শিশুদের বিনামূল্যে শিক্ষা, উপবৃত্তি ও পুষ্টিকর খাবার নিশ্চিত করতে হবে।
দ্বিতীয়ত, বাল্যবিবাহ বন্ধে কঠোর আইন প্রয়োগ ও সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধি জরুরি। ধর্মীয় ও স্থানীয় নেতাদের সম্পৃক্ততা বাড়িয়ে মেয়েদের শিক্ষার প্রতি মনোযোগ বৃদ্ধি করতে হবে।
তৃতীয়ত, বিদ্যালয়ের অবকাঠামো উন্নয়ন করতে হবে। নিরাপদ, শিক্ষার্থী বান্ধব পরিবেশ ও প্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে, বিশেষ করে প্রত্যন্ত অঞ্চলে বিদ্যালয়ের সংখ্যা বাড়াতে হবে।
চতুর্থত, শিক্ষার গুণগত মান উন্নয়নে পাঠ্যক্রম আধুনিক ও শিশু বান্ধব করতে হবে। শিক্ষাদানের নতুন পদ্ধতি ও প্রযুক্তির ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে।
পঞ্চমত, ঝরে পড়া শিক্ষার্থীদের পুনর্বহালের জন্য ‘ব্রিজ প্রোগ্রাম’ চালু করতে হবে, যাতে তারা আবার শিক্ষার পথে ফিরতে পারে।
অবশেষে, অভিভাবক ও সমাজের মধ্যে শিক্ষার গুরুত্ব সম্পর্কে সচেতনতা বাড়াতে হবে, যাতে শিশুরা পড়াশোনায় মনোযোগী হয় এবং বাধা পেলে দ্রুত সমাধান পায়।
সামগ্রিক চিন্তা
শিক্ষা থেকে ঝরে পড়া শিক্ষার্থীরা আমাদের দেশের ভবিষ্যত। তাদের হারালে আমরা দেশের অগ্রগতির সম্ভাবনা হারাব। এজন্য সবাইকে মিলে কাজ করতে হবে। সরকারের শক্ত পদক্ষেপের পাশাপাশি সমাজ ও পরিবারকেও দায়িত্ব নিতে হবে। এ পথে এগিয়ে গেলে বাংলাদেশে উন্নয়নের ধারাকে অব্যাহত রাখা সম্ভব হবে।