বৈশ্বিক অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা, রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং দেশীয় নানা প্রতিকূলতার মাঝেও ২০২৪-২৫ অর্থবছরে বাংলাদেশের প্রধান সমুদ্রবন্দর চট্টগ্রাম অভাবনীয় অগ্রগতি অর্জন করেছে। কনটেইনার হ্যান্ডলিং, রপ্তানি প্রবাহ এবং রাজস্ব আদায়ের ক্ষেত্রে একাধিক রেকর্ড গড়েছে বন্দর ও সংশ্লিষ্ট কাস্টমস হাউস। চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের তথ্য অনুযায়ী, গত অর্থবছরে বন্দরে হ্যান্ডলিং হয়েছে রেকর্ড ৩২ লাখ ৯৬ হাজার ৬৭টি কনটেইনার এবং ১৩ কোটি ৭ লাখ ২৪ হাজার ৭৮৩ মেট্রিক টন কার্গো। একই সময়ে বন্দরে ভিড়েছে ৪ হাজার ৭৭টি জাহাজ। আগের বছর ২০২৩-২৪ অর্থবছরে কনটেইনার হ্যান্ডলিং হয়েছিল ৩১ লাখ ৬৮ হাজার ৬৯০টি এবং কার্গো হ্যান্ডলিং হয়েছিল ১২ কোটি ৩২ লাখ ৪২ হাজার ৭৪৮ মেট্রিক টন। ২০২২-২৩ অর্থবছরে কনটেইনার হ্যান্ডলিং ছিল ৩০ লাখ ৭ হাজার ৩৭৫টি। এই প্রবৃদ্ধির পেছনে রয়েছে আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার, যেমন ই-গেট পাস, অটোমেটেড কনটেইনার অপারেটিং সিস্টেম এবং উন্নত স্ক্যানিং ব্যবস্থা। বন্দর সচিব মো. ওমর ফারুক জানিয়েছেন, এসব ব্যবস্থার ফলে পণ্য খালাস ও ডেলিভারির গতি বেড়েছে, কাগজপত্রের জটিলতা কমেছে এবং অংশীজনদের সঙ্গে সমন্বয় সহজ হয়েছে। তিনি আরও বলেন, এনবিআরের শাটডাউন কর্মসূচি না থাকলে কনটেইনার হ্যান্ডলিং ৩৩ লাখ ছাড়িয়ে যেত। এদিকে, চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসও এ বছর রেকর্ড ৭৫ হাজার ৪৩২ কোটি টাকার রাজস্ব আদায় করেছে, যা আগের বছরের তুলনায় ৯.৭১ শতাংশ বেশি। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে আদায় হয়েছিল ৬৮ হাজার ৭৫৫ কোটি টাকা এবং ২০২২-২৩ সালে ৬১ হাজার ৩৫০ কোটি টাকা। যদিও লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৮০ হাজার ৪০২ কোটি টাকা, তবু সংশ্লিষ্টরা অর্জনকে ইতিবাচক বলে মনে করছেন। ডেপুটি কমিশনার সাইদুল ইসলাম জানিয়েছেন, ধর্মঘট, আন্দোলন ও পরিবহন সংকটের মধ্যেও রাজস্ব আদায়ে ধারাবাহিকতা বজায় রাখা সম্ভব হয়েছে। অন্যদিকে, রপ্তানির ক্ষেত্রেও চট্টগ্রাম বন্দরে রেকর্ড হয়েছে। বাংলাদেশ ইনল্যান্ড কনটেইনার ডিপোস অ্যাসোসিয়েশন (বিকডা) জানিয়েছে, ২০২৪-২৫ অর্থবছরে বেসরকারি ডিপোগুলো থেকে রপ্তানি হয়েছে ৭ লাখ ৭৭ হাজার ৯৯৪টি কনটেইনার, যা আগের বছরের তুলনায় প্রায় ১৫ শতাংশ বেশি। বিকডা সচিব রুহুল আমিন শিকদার বলেন, বৈদেশিক মুদ্রার সংকট কমে আসা, এলসি নিষ্পত্তির গতি বৃদ্ধি এবং বৈশ্বিক বাজারে তৈরি পোশাকসহ রপ্তানিমুখী পণ্যের চাহিদা বৃদ্ধির ফলে এ সাফল্য এসেছে। তবে ব্যবসায়ীরা কিছু চ্যালেঞ্জের কথাও তুলে ধরেছেন। চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সহ-সভাপতি এএম মাহবুব চৌধুরী বলেন, অবরোধ ও কাস্টমস অচলাবস্থার কারণে অনেক ব্যবসায়ী সময়মতো পণ্য পাঠাতে না পেরে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। এমনকি চারগুণ জরিমানা দিতে হয়েছে অনেককে। তিনি ব্যবসাবান্ধব পরিবেশ গড়তে নীতিগত স্থিতিশীলতা ও সমন্বিত উদ্যোগের ওপর জোর দিয়েছেন। উল্লেখ্য, বর্তমানে দেশের আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যের প্রায় ৯২ শতাংশ এবং কনটেইনার পরিবহনের ৯৮ শতাংশই হয় চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে। এই পরিসংখ্যান শুধু একটি সংখ্যার বহিঃপ্রকাশ নয়, বরং বাংলাদেশের অর্থনীতির মূল স্রোতধারার প্রতিচ্ছবি। চট্টগ্রাম বন্দরের যাত্রা শুরু হয়েছিল ১৮৮৮ সালে মাত্র দুটি মুরিং জেটি নিয়ে। স্বাধীনতার পর ১৯৭৭ সালে প্রথমবারের মতো কনটেইনার হ্যান্ডলিং শুরু হয়, যখন এমভি বাঙাল প্রোগ্রেস নামে একটি জাহাজ বন্দরে আসে। সে বছর হ্যান্ডলিং হয়েছিল মাত্র ৩৪ হাজার ৪৮টি টিইইউ কনটেইনার। এরপর সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বন্দরটি আধুনিকায়নের পথে এগিয়েছে। ১৯৯০-এর দশকে ১৮০ মিটার লম্বা জাহাজ ভিড়ানোর সক্ষমতা থাকলেও, ২০২৩ সালে প্রথমবারের মতো ২০০ মিটার লম্বা ও ১০ মিটার ড্রাফটের বড় জাহাজ সরাসরি জেটিতে বার্থিং নিতে শুরু করে। এতে করে বহির্নোঙরে লাইটারেজের প্রয়োজন কমে যায়, সময় ও খরচ উভয়ই হ্রাস পায়। সদ্য সমাপ্ত ২০২৪-২৫ অর্থবছরে চট্টগ্রাম বন্দরে রেকর্ড কনটেইনার হ্যান্ডলিং হয়েছে, যা আগের বছরের তুলনায় ৪ শতাংশ বেশি। একই সময়ে যে রাজস্ব আদায় হয়েছে, তা পূর্ববর্তী বছরের তুলনায় প্রায় ৯.৭১ শতাংশ প্রবৃদ্ধি। বিশ্বের ব্যস্ততম বন্দরের তালিকায় চট্টগ্রাম এখন ৬৭তম অবস্থানে রয়েছে। অথচ ১৯৮০-এর দশকে এই বন্দরে বছরে গড়ে ১ লাখের কম কনটেইনার হ্যান্ডলিং হতো। চট্টগ্রাম বন্দর শুধু একটি অবকাঠামো নয়, এটি বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সক্ষমতার প্রতীক। অতীতের সীমাবদ্ধতা পেরিয়ে আজকের এই অগ্রগতি দেশের বাণিজ্যিক ভবিষ্যতের জন্য এক আশাব্যঞ্জক দৃষ্টান্ত।