বাংলাদেশকে বাঁচাবার জন্য নতুন প্রজন্মের প্রকৃত প্রতিনিধিরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করে। তার প্রমাণ প্রাণ বিসর্জনে দিয়েছেন নির্মম বিমান দূর্ঘটনায় শহিদ তৌফিক ইসলাম। এখানে কোনো ষড়যন্ত্র, অপরিকল্পনা বা ব্যর্থতা আছে কি না সে বিষয়ে আরেকটি লেখা লিখবো আমি। কিন্তু আজ জাতির একজন শ্রেষ্ঠ মায়ের কথা, কয়েকজন প্রভাবশালী লোকের কথা আর রাজনীতিতে থাকা কিছু ছাত্র-যুব-জনতা বিরোধী দল- লোভি ব্যক্তিকে নিয়ে আলোচনা করবো। বিশেষ করে সেই মা, সেই শিক্ষক কোনো নিজস্ব স্বার্থ চিন্তা না করে যিনি নির্মাণ করেছেন নতুন ইতিহাস; তাঁর কথা বলবো। যাকে ঘিরে উচ্চারিত হয়েছে ‘আমি মাহেরীনকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, তুমি তোমার নিজের দুই সন্তানের কথা একবারও ভাবলে না! সে বলেছিল, ওরাও তো আমার সন্তান। ওদের একা রেখে আমি কী করে চলে আসি? অনেক মায়ের সন্তানকে বাঁচিয়ে চলে গেলেন মাহেরীন, ঘরে রইল তার মা-হারা দুই সন্তান।’ নিহত শিক্ষিকা মাহেরীন চৌধুরীর স্বামী মনসুর হেলাল একবুক কষ্ট নিয়ে এ কথাগুলোই বলছিলেন। ভাই মুনাফ চৌধুরী জানান, ওখানে যারা ছিলেন, তারা আমাদের বলেছেন, মাহেরীন ইচ্ছা করলে বের হতে পারতেন, কিন্তু হননি। উনি বাচ্চাদের আগে বের করার চেষ্টা করেন। ঘড়ির কাঁটায় যখন সোমবার দুপুর সোয়া ১টা, রাজধানীর উত্তরার দিয়াবাড়ি এলাকায় মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে বিকট শব্দ করে আছড়ে পড়ে বিমানবাহিনীর যুদ্ধবিমানটি। মুহূর্তেই প্রতিষ্ঠানটির ‘হায়দার আলী’ ভবন দাউদাউ করে জ্বলে ওঠে। আগুনের লেলিহান শিখা গ্রাস করে নেয় শ্রেণিকক্ষে থাকা ছোট ছোট শিশুদের। তাদের বেশির ভাগই ছিল তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির শিক্ষার্থী। আর সেই শিক্ষার্থীদের অভিভাবক হিসেবে বাংলাদেশের একজন সচেতন নাগরিক হিসেবে, একজন মা হিসেবে ভয়াবহ পরিস্থিতিতেও তিনি প্রমাণ দিয়েছেন- মানুষ শুধু দেখতে মানুষ হলেই মানুষ হয় না; মনে-প্রাণে-কর্মে মানুষ হতে হয়। মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের ভবনের উপর এত ক্ষিপ্র গতিতে বিমানটি আছড়ে পড়ে যে, আশপাশের এলাকাও কেঁপে ওঠে। সোমবার দুপুরের এ বিভীষিকায় মুহূর্তেই প্রাণ হারায় অনেক শিশু। তাদের সঙ্গে মারা যান তাদেরই প্রিয় শিক্ষিকা মাহেরীন চৌধুরী, যিনি মাইলস্টোনের ওই শাখায় সমন্বয়ক ছিলেন। সেখানে থাকা এবং পরে তাকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া ব্যক্তিরা বলেন, শিক্ষার্থীদের বাঁচাতে গিয়ে মাহেরীন নিজে বের হতে দেরি করেন।
মাহেরীনের ভাই গণমাধ্যমকে বলেছেন, তার মনের জোর ছিল অনেক। জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে তারা যাওয়ার পরও জীবিত ছিলেন তার বোন। কথাও বলছিলেন। তবে তার অবস্থা খুবই খারাপ ছিল। আগে বের হওয়ার সুযোগ থাকলেও মাহেরীন বের হননি। ওখানে যারা ছিলেন, তারা আমাদের বলেছেন, তিনি তো আসলে আগে বের হতে পারতেন। তিনি আগে বের হননি। তার শিক্ষার্থী যারা ছিল, তিনি তাদের আগে বের করার জন্য চেষ্টা করেছেন। এতে যেটা হয়েছে, তিনি এত বেশি ধোঁয়া আর আগুনে আচ্ছন্ন হয়ে গিয়েছিলেন যে, তার শ্বাসনালি পুরোপুরি পুড়ে গিয়েছিল। পরে আইসিউতে নেওয়ার পর নিশ্চিত হতে পারি যে, তার শ্বাসনালি পুড়ে গেছে। দগ্ধ হওয়ার পর তাকে আশঙ্কাজনক অবস্থায় জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে ভর্তি করা হয়। চিকিৎসকরা জানান, তার শরীরের শতভাগই দগ্ধ হয়েছিল। আইসিইউতে মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করছিলেন তিনি। সোমবার রাত ১০টা ১০ মিনিটে আইসিউতেই মৃত্যুকে বরণ করে নেন মাহেরীন।
একজন মাহেরীন মায়ের মত নিজের জীবন উৎসর্গ করে যে জাতিকে ঋণী করেছেন, সেই জাতি তাকে দেখে অন্তত যেন শেখে যে, যখনই আসবে বিপদ, দাঁড়াতে হবে বিপদকে রুখে দিতে। তাহলে জীবন গেলেও আসবে বিশ্বময় অবাক করা শ্রদ্ধাসন। সেই শ্রদ্ধা থেকেই মাহেরীন আপনাকে স্যালুট যেভাবে বাংলাদেশ জানাচ্ছে, তেমনি ভাবে ভয়ংকর ঘৃণা জানাচ্ছে-অবরুদ্ধও করছে সরকারের সর্বোচ্চ ক্ষমতাসীনসহ বিভিন্ন দায়িত্বে থাকা উপদেষ্টা-সচিব-আমলা এমনকি দলীয় নেতৃবৃন্দকে। কারণ জনগণ ধারণা করছে ছাত্র-যুব-জনতার বৈষম্যমুক্ত বাংলাদেশ গড়ার অঙ্গীকার নিয়ে ৮ আগস্ট ২০২৪ সালে ক্ষমতায় আসা শিক্ষার্থী বা অন্তবর্তী সরকারের পক্ষ থেকে এমন কোনো উদ্যেগই নেয়া হয়নি কোথাও যাতে করে সংকট-সমস্যার উত্তরণ হয়। তারই ধারাবাহিকতায় অতিতের ফ্যাসিস্টের নিয়মতান্ত্রিকভাবে বাংলাদেশ বিমানের পথচলা চলতে থাকে। আর সেই পথচলায় উত্তরায় বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর প্রশিক্ষণ বিমানটি মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের একটি ভবনে বিধ্বস্ত হয়েছে। যতদূর জেনেছি, ঘটনার সময় মাইলস্টোন স্কুল ও কলেজে শ্রেণি কার্যক্রম চলছিল। হঠাৎ বিকট শব্দে বিমানটি ভেঙে পড়লে শিক্ষার্থী ও স্থানীয়দের মধ্যে আতঙ্ক দেখা দেয়। স্কুলের অভিভাবকরা খবর পেয়ে দিকবেদিক ছুটেছেন সন্তানদের খোঁজ নিতে। অনেকেই উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন। স্কুলের দোতলা ভবনের প্রবেশ মুখে বিমানটি বিধ্বস্ত হয়। তখন স্কুল ছুটি হয়ে গেছে। কিছু শিক্ষার্থী বের হয়ে গেছে, অনেকে ভেতরেই ছিল। বিমানটি বিধ্বস্ত হওয়ার পরপরই আগুন ধরে যায়। মুহূর্তেই ধুয়ার কণ্ডুলী বের হতে থাকে। আশপাশের এলাকা অন্ধকার হয়ে উঠে। ঘটনাস্থলে থাকা লাকি আক্তার নামে একজন অভিভাবক বলেছেন, তার দুই সন্তান এখানে পড়তেন। বড় সন্তানকে বের করতে পরেছেন। তবে ছোট সন্তান এখনও আটকে রয়েছেন। তার সঙ্গে কোনো যোগাযোগ করতে পারছেন না তিনি।
কিছুটা সময় অতিবাহিত হওয়ার পরই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পোস্ট করা ভিডিওতে দেখা যায় ভবন থেকে পোড়া শরীর নিয়ে দৌড়ে বের হচ্ছেন একের পর এক দগ্ধ। তবে এদের বেশির ভাগই শিক্ষার্থী। সেনাবাহিনীর গাড়িতে করে অনেককে উদ্ধার করে নিয়ে যেতে দেখা গেছে। সেখানে কতজন শিক্ষার্থী আহত হয়েছে, তা দেখার জন্য নিজেই উত্তরায় গিয়েছিলাম, গিয়েছিলাম জাতীয় বার্ন ইন্সটিটিউটের তথ্য বিভাগে। আমার দ্বারা যাতে ইনফেকশন যেন না ছড়ায় এজন্য কোনো বেড বা কেবিনে না গিয়ে তথ্য নিয়ে জেনেছি - যে ভবনটিতে বিমান বিধ্বস্ত হয় সেখানে দ্বিতীয় শ্রেণি থেকে পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের ক্লাস হতো। ভেতরে প্রায় ২০০ থেকে আড়াইশ জন শিক্ষার্থী ছিলেন। অনেকে হতাহত হয়েছেন। এমন একটা সময়ে এসে সরকারের সর্বোচ্চ ক্ষমতাধর ড. ইউনূসের চেয়েও প্রভাবশালী হিসেবে বাংলাদেশের মানুষের কাছে পরিচিত এএফপির সাবেক রিপোর্টাও শফিকুল ইসলাম আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুলকেসহ অবরুদ্ধ হয়েছিলেন নয় ঘন্টারও বেশি সময়। কারণ কি? প্রশ্ন যখন জনগণের মুখে মুখে, তখন মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজ পরিদর্শনে গিয়ে অবরুদ্ধ থাকার কারণ জানিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম। নিজের ফেসবুক আইডিতে দেওয়া এক পোস্টে লিখেছেন, মঙ্গলবার আমরা ৯ ঘণ্টা ধরে স্কুলে ছিলাম। চাইলে তার আগেও চলে আসতে পারতাম, কিন্তু উপদেষ্টারা সংকট সমাধানে শান্তিপূর্ণ পন্থা অবলম্বন করতে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ ছিলেন। তারা বলেছিলেন, যতক্ষণ দরকার, ততক্ষণ থাকবেন। আমরা কেবল তখনই স্কুল ত্যাগ করেছি, যখন সেটি প্রাসঙ্গিক ছিল। শাক দিয়ে মাছ ঢাকার মত করে তিনি লিখেছেন- স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে মাইলস্টোন কলেজে একটি ‘কন্ট্রোল রুম’ স্থাপনের নির্দেশ দিয়েছেন দায়িত্বপ্রাপ্ত দুই উপদেষ্টা। এই কন্ট্রোল রুমে প্রতিদিন নিহত ও আহতের সংখ্যা হালনাগাদ করা হবে এবং তা কলেজ রেজিস্ট্রার বইয়ের সঙ্গে মিলিয়ে দেখা হবে। উপদেষ্টারা পরামর্শ দিয়েছেন, এই প্রক্রিয়ায় কলেজের বর্তমান শিক্ষার্থী ও প্রাক্তন ছাত্রছাত্রীদেরও সম্পৃক্ত করতে হবে। কন্ট্রোল রুমটি বুধবার থেকেই পুরোপুরি চালু হওয়ার কথা রয়েছে।
ভিডিওতে তাদেরকে অবরুদ্ধে করে রাখার তথ্য থাকলেও প্রেস সচিব লিখেছেন, মঙ্গলবার আপনাদের প্রার্থনা ও সহানুভূতির জন্য ধন্যবাদ জানাচ্ছি। আমরা মাইলস্টোন কলেজ পরিদর্শন করেছি। আমরা শোকাহত পরিবারগুলোর সঙ্গে দেখা করতে এবং সেইসব শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের সঙ্গে কথা বলতে, যারা এখনো এই মর্মান্তিক ঘটনার ধাক্কা সামলে উঠতে পারেননি। পুরো পরিবেশ ছিল শোক ও ক্ষোভে ভারাক্রান্ত। অনেক শিক্ষার্থী নিজের চোখে দেখা ঘটনার বর্ণনা দিয়েছেন এবং মৃত্যুর প্রকৃত সংখ্যা নিয়ে বিভিন্ন তথ্যভ্রান্তির বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেন। তিনি লেখেন, ২০০২ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত আমি অসংখ্য বড় দুর্ঘটনার সংবাদ কভার করেছি। সেই অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, বাংলাদেশে প্রাণহানির প্রকৃত সংখ্যা গোপন রাখা প্রায় অসম্ভব। সাধারণত দুর্ঘটনার পরপরই পরিবারগুলো প্রিয়জনকে নিখোঁজ হিসেবে জানায়। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে হাসপাতাল ও প্রশাসনিক সূত্র থেকে তথ্য সংগ্রহের মাধ্যমে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই নিখোঁজদের অবস্থান শনাক্ত করা যায়। এ ঘটনাতেও মাইলস্টোন কলেজ কর্তৃপক্ষ চাইলে প্রতিদিনের উপস্থিতি তালিকা (অ্যাটেনডেন্স রেকর্ড) বিশ্লেষণ করে এখনো যাদের খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না, তাদের সুনির্দিষ্টভাবে শনাক্ত করতে পারবে। তিনি আরও লেখেন, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ব্যক্তিদের অবস্থা সম্পর্কে নিয়মিত তথ্য দিচ্ছে। সামরিক বাহিনীও এই প্রচেষ্টায় সহায়তা করছে। আমি নিশ্চিতভাবে বলতে পারি, সরকারের পক্ষ থেকে প্রাণহানির সংখ্যা গোপন বা কম দেখানোর কোনো কারণ নেই।’
যদি তা-ই হবে! তাহলে কেন সুষ্ঠু তদন্তের মাধ্যমে মৃতের তালিকা তৈরি করে গণমাধ্যমের সামনে, অভিভাবকদের সামনে নিয়ে আসা থেকে সরে গিয়ে কেবল একের পর এক কথার মালা গেঁথে যাচ্ছেন। দয়া করে দ্রুত সময়ে মধ্যে দেশের শীর্ষ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নির্মম দূর্ঘটনায় আহত ও নিহতদের পূর্ণাঙ্গ তালিকা প্রকাশে সর্বোচ্চ ব্যবস্থা করাটা সময়ের দাবি বলেই আমি মনে করছি। সেই সাথে আগামী সাত দিনের মধ্যে বিমান বাহিনীর প্রশিক্ষণ স্থান ও রুট পরিবর্তন করলে চলমান প্রশ্নগুলো আর আঙ্গুল তুলতে পারবে না বলেও চাই এই পথে হাঁটুক বাংলাদেশ, শেষ হোক কষ্টসময়...