বাংলাদেশের পরমাণুবিজ্ঞানের পথিকৃৎ শমশের আলীর বিদায়

নিজস্ব প্রতিবেদক | প্রকাশ: ৩ আগস্ট, ২০২৫, ১২:২০ পিএম
বাংলাদেশের পরমাণুবিজ্ঞানের পথিকৃৎ শমশের আলীর বিদায়

বাংলাদেশের বিজ্ঞান গবেষণা ও উচ্চশিক্ষার অঙ্গনে এক উজ্জ্বল নক্ষত্র ছিলেন অধ্যাপক ড. এম শমশের আলী। শনিবার (২ আগস্ট) দিবাগত রাত ২টার দিকে রাজধানীর একটি বেসরকারি হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন এই বিশিষ্ট পরমাণুবিজ্ঞানী ও শিক্ষাবিদ। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৮৭ বছর। রোববার (৩ আগস্ট) ধানমন্ডির বায়তুল আমান জামে মসজিদে বাদ জোহর তাঁর জানাজা অনুষ্ঠিত হবে এবং পরে আজিমপুর কবরস্থানে দাফন সম্পন্ন হবে।

অধ্যাপক শমশের আলী ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের সাবেক অধ্যাপক, বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় (বাউবি) ও সাউথইস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা উপাচার্য এবং বাংলাদেশ বিজ্ঞান একাডেমির প্রাক্তন সভাপতি। বাংলাদেশের পরমাণু গবেষণার অন্যতম পথিকৃৎ এই বিজ্ঞানী শুধু গবেষকই ছিলেন না, ছিলেন উচ্চশিক্ষা বিস্তারে নিবেদিত এক দূরদর্শী চিন্তাবিদ।

১৯৩৭ সালের ২১ নভেম্বর কুষ্টিয়ার ভেড়ামারায় জন্ম নেওয়া অধ্যাপক আলীর শিক্ষাজীবন শুরু হয় যশোর জিলা স্কুলে। এরপর রাজশাহী কলেজ থেকে আইএসসি সম্পন্ন করে তিনি ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগে। সেখান থেকে অনার্স (১৯৫৯) ও এমএসসি (১৯৬০) ডিগ্রি অর্জনের পর উচ্চশিক্ষার জন্য পাড়ি জমান যুক্তরাজ্যে। ১৯৬৫ সালে ম্যানচেস্টার বিশ্ববিদ্যালয় থেকে থিওরেটিক্যাল নিউক্লিয়ার ফিজিক্সে পিএইচডি অর্জন করেন।

শিক্ষাজীবন শেষে ১৯৬১ সালে পাকিস্তান আণবিক শক্তি কমিশনে যোগদানের মাধ্যমে তাঁর কর্মজীবনের সূচনা ঘটে। পিএইচডি শেষে দেশে ফিরে ঢাকার আণবিক শক্তি কেন্দ্রে সিনিয়র সায়েন্টিফিক অফিসার হিসেবে কাজ করেন এবং ১৯৭০ সালে মাত্র ৩৩ বছর বয়সে কমিশনের পরিচালক হিসেবে নিয়োগ পান। ১৯৭৮ সাল পর্যন্ত তিনি এই দায়িত্ব পালন করেন।

বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে তাঁর অবদান বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। ১৯৭৩ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে অনারারি প্রফেসর অব ফিজিক্স হিসেবে বিশেষ সম্মানে ভূষিত করে। পরে ১৯৮২ সালে তিনি পূর্ণাঙ্গ অধ্যাপক হিসেবে নিয়োগ পান এবং ২০০৬ সাল পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করেন। একই সঙ্গে তিনি ১৯৯২ থেকে ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা উপাচার্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। পরবর্তীতে ২০০২ থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত সাউথইস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা উপাচার্য এবং ২০০৪ থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ বিজ্ঞান একাডেমির সভাপতি ছিলেন।

অধ্যাপক শমশের আলীর মৃত্যুতে বাউবি ও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ গভীর শোক প্রকাশ করেছে এবং রোববার বিশ্ববিদ্যালয় দুটিতে এক দিনের সাধারণ ছুটি ঘোষণা করা হয়েছে। বাউবির উপাচার্য অধ্যাপক ড. এ বি এম ওবায়দুল ইসলাম এক শোকবার্তায় বলেন, “অধ্যাপক শমশের আলী ছিলেন বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষা ও বিজ্ঞানচর্চার এক উজ্জ্বল নক্ষত্র। তাঁর জীবনদর্শন আমাদের কাছে চিরকালীন অনুপ্রেরণা হয়ে থাকবে।”

তিনি শুধু একজন বিজ্ঞানী নন, ছিলেন বহুমাত্রিক প্রতিভার অধিকারী। কবিতা, সংগীত, সাহিত্য ও ধর্মচর্চায়ও তাঁর আগ্রহ ছিল গভীর। বিজ্ঞানের পাশাপাশি সমাজকল্যাণেও ছিল তাঁর সক্রিয় ভূমিকা। নিজের কর্মজীবনের শেষদিকে ২০২৪ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি তিনি প্রফেসর ইমেরিটাস হিসেবে আবারও বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে যুক্ত হন, যা ছিল তাঁর প্রতি দেশের উচ্চশিক্ষা ও গবেষণা অঙ্গনের সর্বোচ্চ সম্মান।

অধ্যাপক শমশের আলীর মৃত্যুতে জাতি হারাল এক জ্ঞানতাপস, উচ্চশিক্ষার প্রাতঃস্মরণীয় রূপকার ও বিজ্ঞানচর্চার পুরোধা ব্যক্তিত্বকে।

আপনার জেলার সংবাদ পড়তে