ইথিওপিয়া থেকে উন্নত জীবনের আশায় সমুদ্রপথে পাড়ি জমাতে গিয়ে ইয়েমেন উপকূলে প্রাণ গেল অন্তত ৫৪ জন শরণার্থী ও অভিবাসনপ্রত্যাশীর। ধারণক্ষমতার অতিরিক্ত যাত্রীবোঝাই একটি নৌকা ইয়েমেনের দক্ষিণাঞ্চলীয় আবিয়ান প্রদেশের শাকরা উপকূলে উল্টে গেলে এ মর্মান্তিক ঘটনা ঘটে।
আবিয়ান প্রদেশের স্বাস্থ্য দপ্তর জানিয়েছে, শনিবার (২ আগস্ট) সন্ধ্যায় আরব সাগরে প্রচণ্ড ঝোড়ো হাওয়ার মুখে পড়ে নৌকাটি ডুবে যায়। পরদিন রোববার (৩ আগস্ট) জাঞ্জিবারের স্বাস্থ্য পরিচালক আবদুল কাদের বাজামিল জানান, সমুদ্রসৈকত এবং আশপাশের এলাকা থেকে এখন পর্যন্ত ৫৪ জনের মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে। ১২ জনকে জীবিত উদ্ধার করে শাকরা হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। এখনও অনেকেই নিখোঁজ, তাদের সন্ধানে উদ্ধার তৎপরতা অব্যাহত রয়েছে।
স্থানীয় প্রশাসনের ভাষ্য অনুযায়ী, ডুবে যাওয়া নৌকাটিতে প্রায় ১৫০ জন আরোহী ছিলেন, যাদের অধিকাংশই ইথিওপিয়ার নাগরিক। আরব সাগরের এই অংশ দিয়ে হর্ন অব আফ্রিকার দেশগুলো থেকে ইয়েমেন হয়ে উপসাগরীয় দেশগুলোর দিকে অভিবাসনপ্রত্যাশীদের চলাচল চলে বহু বছর ধরে। তবে এটি বিশ্বের অন্যতম বিপজ্জনক অভিবাসন রুট হিসেবেই চিহ্নিত।
জাতিসংঘের আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থা (আইওএম) জানিয়েছে, এসব শরণার্থী প্রায়ই পাচারকারীদের মাধ্যমে সমুদ্রপথে যাত্রা করেন। দালালরা নৌকায় গাদাগাদি করে যাত্রী তুলে দেয় এবং অনেক সময় ঝুঁকিপূর্ণ আবহাওয়ার মধ্যেও যাত্রা করায়, যা এমন প্রাণঘাতী ঘটনার জন্ম দেয়।
আইওএম প্রধান আবদুসাত্তোর এসোয়েভ জানান, নিহতদের মধ্যে ১৪ জনের মরদেহ নেওয়া হয়েছে আবিয়ান প্রদেশের রাজধানী জিঞ্জিবারের একটি হাসপাতাল মর্গে। বাকি মরদেহগুলো উদ্ধারের পর স্থানীয়ভাবে দাফনের প্রস্তুতি চলছে।
আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থার বরাতে বিবিসি জানিয়েছে, এই নৌপথ এখনো বিশ্বের ‘সবচেয়ে ব্যস্ত ও ঝুঁকিপূর্ণ’ অভিবাসন রুটগুলোর একটি। কেবল ২০২৪ সালেই এই পথে প্রায় ৬০ হাজার অভিবাসী ইয়েমেন পাড়ি দিয়েছেন। অথচ ২০১৪ সালে ইয়েমেনে গৃহযুদ্ধ শুরুর পর দেশটি নিজেই গভীর মানবিক সংকটে পড়েছে। এরপরও সোমালিয়া, ইথিওপিয়া ও অন্যান্য আফ্রিকান দেশ থেকে হাজার হাজার মানুষ ইয়েমেন হয়ে সৌদি আরব বা উপসাগরীয় দেশগুলোতে যাওয়ার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।
আইওএমের ‘মিসিং মাইগ্র্যান্টস প্রজেক্ট’ এর তথ্য অনুযায়ী, গত এক দশকে হর্ন অব আফ্রিকা থেকে ইয়েমেনে অভিবাসনের পথে ৩,৪০০ জনের বেশি মানুষ মারা গেছেন বা নিখোঁজ হয়েছেন। এর মধ্যে অন্তত ১,৪০০ জনের মৃত্যু হয়েছে নৌকাডুবির কারণে।
চলতি বছর মার্চেও ইয়েমেনের ধুবাব উপকূলে বৈরী আবহাওয়ার মুখে পড়ে দুটি নৌকা ডুবে যায়, যাতে ১৮০ জনেরও বেশি অভিবাসী নিখোঁজ বা মৃত হিসেবে গণ্য হন।
এইসব ঘটনার পুনরাবৃত্তি রোধে আইওএম আরও কার্যকর সুরক্ষা ব্যবস্থার প্রয়োজনীয়তার কথা বলছে। সংস্থাটি জানিয়েছে, “অভিবাসীদের দুর্বলতা ও অসহায়ত্বকে পুঁজি করে অসাধু দালালরা তাদের বিপজ্জনক যাত্রায় ঠেলে দিচ্ছে। এই হৃদয়বিদারক দুর্ঘটনা দেখিয়ে দিয়েছে—নিরাপদ অভিবাসন নিশ্চিত করা কতটা জরুরি।”
যতক্ষণ না বৈধ, সুশৃঙ্খল ও মানবিক অভিবাসন পথ গড়ে তোলা হয়, ততদিন এমন ট্র্যাজেডি হয়তো থামবে না—শুধু সংখ্যাই বাড়বে।