মাত্র ২৬ বছর বয়সের টগবগে যুবক হাফেজ মাওলানা মুফতী মাহমুদুল হাসান মাহদী। গত বছরের জুলাই-আগষ্টে সরকার পতনের আন্দোলনের প্রথম সারির একজন গর্বিত সৈনিক। কোটা সংস্কার ও এক দফা দাবী আদায়ের জন্য বুক পেতে দিয়েছিলেন তৎকালীন ফ্যাসিস্ট সরকারের পেটুয়া বাহিনীর সামনে। সেইদিন হাত ও বুক কাঁপেনি পাষন্ডদের। ২০২৪ খিষ্টাব্দের ৫ আগষ্ট সন্ধ্যায় ঢাকার উত্তরা থানার সামনে লড়াই করার সময় বুকে গুলিবিদ্ধ হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়েন হাফেজ মাহদী। হাসপাতালে নেয়ার পর অতিরিক্ত রক্তক্ষরণের কারণে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন তিনি। আলেমেদ্বীন মাহদী ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার সরাইল উপজেলার পাকশিমুল ইউনিয়নের ফতেহপুর গ্রামের হাফেজ আব্দুস সাত্তারের (৬২) ছেলে। দীর্ঘ এক বছর পেরিয়ে গেছে। ভালো নেই দেশ প্রেমিক বীর মাহদীর পরিবার। একমাত্র ছেলে উজায়ফার বয়স প্রায় ২০ মাস। পুত্র মাহদীর শোকে গত দুই সপ্তাহ আগে ব্রেইন ষ্ট্রোক করে মারা গেছেন পিতা হাফেজ আব্দুস সাত্তারও। মাহদীর পরিবারের বর্তমান দিনকাল কাটছে খুবই কষ্টে। পরিবারটিকে বাঁচাতে এখন সহায়তা দরকার।
সরজমিন অনুসন্ধান, পরিবার ও স্থানীয় একাধিক সূত্র জানায়, হাফেজ আব্দুস সাত্তারের ৩ ছেলে ও ১ কন্যা সন্তানের মধ্যে মাহদী ছিল সবার বড়। অনেক আশা নিয়ে কষ্টশিষ্ট করে মাহদীকে আলেমেদ্বীন শিক্ষা দিয়েছিলেন। চাকরির সুবাদে ঢাকার আব্দুল্লাহপুরে ভাড়া বাসায় থাকতেন হাফেজ আব্দুস সাত্তার। ৩ ছেলে ১ মেয়ের মধ্যে মাহদী ছিল সবার বড়। মাহদীকে প্রথমে বারিধারা এলাকায় একটি মাদ্রাসায় হাফেজী পড়িয়েছিলেন। পরে কিতাব ও মুফতী বিষয়ে মাহদী মালিবাগ মাদ্রাসায় পড়ালেখা করেন। সফলতার সাথে উভয় বিভাগেই উত্তীর্ণ হন মাহদী। সংসারের আর্থিক অবস্থা তেমন ভাল ছিল না। তাই সংসারের হাল ধরতে চাকরির সন্ধানে নেমে পড়েন। পড়ে কাপাসিয়া চাঁদপুর মসজিদে পেশ ইমাম হিসেবে যোগদান করেন। মাহদীর মাসিক ১০-১২ হাজার টাকা রোজগারে ভাল সহযোগিতা হয়েছিল পরিবারের। তার মা বাবা দু’জনের মুখেই ফুটেছিল সুখের হাসি। মাহদীকে ফতেহপুর গ্রামের মোছা: বুশরা নামের এক মেয়েকে পারিবারিক ভাবে বিয়ে করান। স্ত্রী বুশরা শ্বশুর শ্বাশুড়ির সাথে আব্দুল্লাপুরে থাকতেন। মাঝেমধ্যে কাপাসিয়া থেকে পরিবারের খুঁজ খবর নিতে বাসায় আসতেন মাহদী। মাহদীর একমাত্র পুত্র সন্তানের বয়স তখন ছিল ৯ মাস। তার নাম উজায়ফা। সন্তানের ছুঁয়া পেতে সময়ে অসময়ে বাসায় ছুটে আসতেন মাহদী। উজায়ফাকে বুকে জড়িয়ে ধরে চুমো খেতেন। আব্বু আব্বু বলে আদরে মাতিয়ে তুলতেন মাহদী। পিতার স্পর্শে শিশু উজায়ফা হাসতো মন খুলে। পিতা পুত্রের ভালবাসায় আনন্দে ভাসত গোটা পরিবার। আজ আর সেই আনন্দ নেই মাহদীর পরিবারে। মাহদীর স্ত্রী’র মুখের সুখের হাসি হারিয়ে গেছে। পিতার স্পর্শের কথা আর এখন ভাবতেও পারে না উজায়ফা। গত এক বছর ধরে উজায়ফা আর বাবা ডাকতে পারছে না। অগণিত বাবার মাঝে নিজের বাবাকে আর খুঁজে পাচ্ছে না উজায়ফা। এই দু:খে মা বুশরার চোখের জল গড়িয়ে পড়ছে অধিকাংশ সময়। অল্প বয়সে বিধবার শাড়ি পড়া বুশরা সন্তানের একমাত্র সন্তানকে ধরে বেঁচে আছেন। পিতার অবর্তমানে দাদার আদর স্নেহই ভরসা ছিল উজায়ফার। সর্বশেষ সেই ভরসার জায়গাটুকুও চিরদিনের জন্য শেষ হয়ে গেল। গত দুই সপ্তাহ আগে মাহদীর বাবা পুত্র শোকে ব্রেইন ষ্ট্রোক করে মারা গেছেন। উজায়ফার মাথার উপরের শেষ ছায়াটুকুও হারিয়ে গেল। স্বামীর পর শ্বশুরের মৃত্যুতে আরো অসহায় হয়ে পড়লেন মাহদীর স্ত্রী বুশরা। সব মিলিয়ে জুলাই-আগষ্টের যোদ্ধা বীর মাহদীর পরিবারের দিনকাল কাটছে খুবই কষ্টে। স্থানীয় উপজেলা পরিষদ ও প্রশাসন শহীদ মাহদীর পরিবারকে আর্থিক সহযোগিতা করেছেন। ২ লাখ টাকা অনুদান দিয়েছেন বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলাম। মাহদীর পরিবার ও স্থানীয় একাধিক ব্যক্তি বলেন, দেশের ও দেশের মানুষের জন্য নিজের জীবন বিলিয়ে দিলেন মাহদী। পিতা মাতা হারালেন সন্তান। আর চিরদিনের জন্য বিধবা হলেন স্ত্রী বুশরা। সারা জীবনের জন্য এতিম হলো শিশু উজায়ফা। সবশেষে শোকে পরপারে চলে গেল মাহদীর পিতা সাত্তার। বীর শহীদ মাহদীর পরিবারকে দেশ কি দিল? এখন তাদের কষ্টের সাথী তো কেউ হচ্ছেন না। শিশু উজায়ফার অনিশ্চিত ভবিষ্যতের নিশ্চয়তা দেয়া দেশ ও জাতীর দায়িত্ব। তারা আজকে মাহদীর মুত্যু দিবসে তার পরকালীন মুক্তি কামনার পাশাপাশি একমাত্র সন্তান উজায়ফার সকল দায়িত্ব নেয়ার দাবী রাখেন সরকারের কাছে। সরাইল উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. মোশারফ হোসাইন বলেন, জুলাই-আগষ্টের বীর শহীদদের কাছে জাতী চিরদিনই ঋণী থাকবে। সরাইলের সকল বীর শহীদদের পরিবারকে সরকারের পক্ষ থেকে একাধিকবার আথিক সহযোগিতা করা হয়েছে। ভবিষ্যতে হয়ত আরো করা হবে। আজ ( ৫ই আগষ্ট) উপজেলার ফতেহপুরের মাহদীর মুত্যু বার্ষিকীতে তার আত্মার মাগফিরাত কামনা করছি।
প্রসঙ্গত: পরিবারের কেউ জানে না। জানে না উজায়ফা। হাফেজ মাহদী প্রথমে সরকার বিরোধী কোটা সংস্কার আন্দোলনে অংশ গ্রহন করেন। লড়াই করেছেন সফলতার সাথে। পড়ে নেমে পড়েন এক দফা দাবী আদায়ের সংগ্রামেও। তখন কিন্তু পুলিশ ছিল অনেকটা মারমুখি। ৫ আগষ্ট সোমবার সন্ধ্যায় শিক্ষার্থীদের মিছিলের অগ্রভাগে ছিলেন মাহদী। মিছিলটি ঢাকার উত্তরা থানার সামনে যাওয়ার পরই পুলিশের সাথে মুখোমুখি হয়ে পড়ে। শুরূ হয় ধাওয়া পাল্টা ধাওয়া। এ সময় পুলিশের ছুঁড়া একটি বুলেট মুফতী মাহদীর বুকের বামপাশে আঘাত করে। সাথে সাথে মাটিতে লুটিয়ে পড়েন তিনি। মাহদীকে উদ্ধার করে দ্রূত উত্তরা ৬ নম্বর সেক্টরের কুয়েত বাংলাদেশ মৈত্রী সরকারী হাসপাতালে নেয়া হয়। অতিরিক্ত রক্তক্ষরণের কারণে সেখানে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন মাহদী। একমাত্র ভরসা ও আলো নিভে যায় মাহদীর পরিবারের। মাহদীর মৃত্যুর সংবাদে মুহুর্তের মধ্যে থেমে যায় তার পরিবারের সকল আনন্দ ও কোলাহল। পরিবার ও স্বজনদের কান্না আহাজাড়িতে ভারী হয়ে ওঠে ওই মহল্লার পরিবেশ। কয়েক ঘন্টার মধ্যে জড়ো হয়ে পড়েন সহপাঠি ও অন্যান্য পরিচিত আলেম ওলামারা। সেই দিন অঝরে কাঁদছিলেন সবাই। এমন দু:খের সাগরে শান্তনা দেওয়ার ভাষা ছিল না কারো। স্ত্রী বুশরা আর মা কুলসুম চিৎকার দিয়ে জ্ঞান হারিয়েছিলেন প্রতি মূহুর্তে। মুফতী মাহদীর অনাকাঙ্খিত নির্মম মৃত্যুর খবরে শোকের ছাড়া নেমে এসেছিল গোটা ফতেহপুর গ্রামে। সেই হৃদয় বিদায়ক দু:সহ স্মৃতি আজও তাড়া করছে মাহদীর পরিবার ও স্বজনদের।