বৃষ্টিপাত ও পাহাড়ি ঢলে বিপর্যস্ত রাঙামাটি: হ্রদের পানি কমলেও বিপদ কাটেনি

নিজস্ব প্রতিবেদক | প্রকাশ: ৮ আগস্ট, ২০২৫, ০৩:৫৬ পিএম
বৃষ্টিপাত ও পাহাড়ি ঢলে বিপর্যস্ত রাঙামাটি: হ্রদের পানি কমলেও বিপদ কাটেনি

টানা বর্ষণ আর উজান থেকে আসা ঢলে রাঙামাটির কাপ্তাই হ্রদের পানির উচ্চতা বিপজ্জনকভাবে বেড়ে যাওয়ায় হুমকির মুখে পড়ে জেলার জনপদ। ফলে গত বৃহস্পতিবার (৭ আগস্ট) সন্ধ্যা ৬টা থেকে কাপ্তাই জলবিদ্যুৎ কেন্দ্রের ১৬টি জলকপাট সাড়ে তিন ফুট করে খুলে দিয়ে পানি ছাড়ার মাত্রা বাড়ানো হয়। এতে প্রতি সেকেন্ডে এক লাখ কিউসেক পানি কর্ণফুলী নদীতে নিঃসরিত হচ্ছে।

শুক্রবার (৮ আগস্ট) সকাল ১০টা পর্যন্ত কাপ্তাই হ্রদের পানির স্তর রেকর্ড করা হয়েছে ১০৮.৭০ ফুট এমএসএল (মিন সি লেভেল)। এর আগের দিন, বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় পানি বেড়ে দাঁড়ায় ১০৮.৮৩ ফুটে। হ্রদের সর্বোচ্চ ধারণক্ষমতা ১০৯ ফুট হওয়ায় এ অবস্থাকে কর্তৃপক্ষ বিপজ্জনক বলে আখ্যা দেয়। জলকপাট খুলে দেওয়ার তিন দিন পর প্রথমবারের মতো পানির স্তরে কিছুটা হ্রাস লক্ষ করা যায়।

কাপ্তাই পানি বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ব্যবস্থাপক মো. মাহমুদ হাসান জানান, পাঁচটি ইউনিট চালু রেখে প্রতিদিন ২২০ থেকে ২২২ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হচ্ছে। বিদ্যুৎ উৎপাদন ও স্পিলওয়ে মিলে প্রতি সেকেন্ডে মোট এক লাখ কিউসেক পানি কর্ণফুলী নদীতে পড়ছে। এর ফলে নদীতে স্রোতের তীব্রতা বেড়ে যাওয়ায় রাঙামাটি-বান্দরবান সড়কে চন্দ্রঘোনা ফেরি চলাচল বন্ধ রয়েছে বৃহস্পতিবার ও শুক্রবার উভয় দিনই।

হ্রদের পানির অতিরিক্ত চাপ সামাল দিতে গেট খুলে দেওয়া হলেও জেলার ভৌগোলিক বাস্তবতায় কাপ্তাই হ্রদের পানি আশপাশের নিম্নাঞ্চলে প্রবেশ করে প্লাবিত করেছে অন্তত চারটি উপজেলা—রাঙামাটি সদর, লংগদু, বাঘাইছড়ি ও নানিয়ারচর। এখন পর্যন্ত ৮১টি গ্রামে পাঁচ হাজার ৭০১টি পরিবার বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন, যাদের সংখ্যা প্রায় ১৮ হাজার ১৪৮ জন। জেলার বরকল, জুরাছড়ি এবং কাপ্তাই উপজেলার কিছু অংশেও পানি ঢুকে পড়েছে।

রাঙামাটি জেলা প্রশাসন জানিয়েছে, বন্যাকবলিতদের জন্য ২৪৬টি আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছে। এর মধ্যে লংগদু ও বাঘাইছড়িতে ১২টি আশ্রয়কেন্দ্রে ৯৩৫ জন আশ্রয় নিয়েছেন। এ ছাড়া ৫৫৪ মেট্রিক টন চাল মজুদ রয়েছে, যা থেকে শুকনো খাবারসহ অন্যান্য সহায়তা পৌঁছে দেওয়া হচ্ছে ক্ষতিগ্রস্তদের কাছে।

তবে শুধু মানুষের ঘরবাড়ি নয়, ক্ষতির শিকার হয়েছে অবকাঠামো, কৃষি এবং শিল্প খাতও। এ পর্যন্ত জেলার বিভিন্ন অংশে ৫৪৮টি ঘরবাড়ি, ৬১টি সড়ক, ৯৮ হেক্টর জমির ফসল, ৪৩টি মৎস্য খামার ও পুকুর এবং ৯টি হাটবাজার বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। রাঙামাটির বিসিক শিল্পনগর এলাকাও পানির নিচে চলে গেছে; এখনো ১৫টি কারখানা এবং তিনটি গুরুত্বপূর্ণ সড়ক ডুবে রয়েছে।

বৃষ্টিপাত ও পাহাড়ি ঢল কমার ইঙ্গিত মিললেও কর্ণফুলী নদীতে স্রোতের তীব্রতা এবং হ্রদের পানির স্তর এখনও বিপৎসীমার কাছাকাছি অবস্থান করছে। ফেরি চলাচলও এখনও শুরু করা সম্ভব হয়নি। রাঙামাটি সড়ক ও জনপথ বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী সবুজ চাকমা বলেন, “ফেরি চলাচল পুরোপুরি নির্ভর করছে পানির প্রবাহের ওপর। যদি পানির নিঃসরণ কমে, তাহলে ফেরি চালু করা সম্ভব হবে।”

স্থানীয়ভাবে পানিবন্দী মানুষদের দুর্ভোগ চরমে পৌঁছেছে। বিহারপুর, মাস্টারপাড়া, খেদারমারা ও আমতলীসহ বিভিন্ন এলাকায় কয়েক শ পরিবার এখনো পানির মধ্যে দিন কাটাচ্ছে। শুধুমাত্র লংগদু উপজেলায় দুই হাজার পরিবার এখনো পানিবন্দী অবস্থায় রয়েছেন।

কাপ্তাই বাঁধ ১৯৬০ সালে নির্মাণের সময় যেভাবে প্রায় ৫৪ হাজার একর কৃষিজমি তলিয়ে গিয়েছিল, ঠিক তেমনিভাবে বৃষ্টির মৌসুমে প্রতিবছর জলাবদ্ধতা ও বন্যার ভয়াবহতা নতুন করে মনে করিয়ে দেয় বাঁধের সামাজিক ও পরিবেশগত প্রভাব।

পরিস্থিতি এখনো পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে আসেনি। প্রশাসনের পক্ষ থেকে সতর্ক নজর রাখা হচ্ছে বলে জানানো হয়েছে। বৃষ্টিপাত আরও কমলে এবং উজান থেকে পানি না এলে পরিস্থিতি উন্নতির দিকে যাবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন সংশ্লিষ্টরা।

আপনার জেলার সংবাদ পড়তে