জাতীয় পার্টির ভেতরে দীর্ঘদিন ধরে চলা মতপার্থক্য, অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব ও নেতৃত্বের প্রশ্নে ধোঁয়াশার পর এবার ‘ঐক্য’ ও ‘গণতান্ত্রিক নেতৃত্বের পুনর্গঠন’– এই বার্তা নিয়ে ঢাকায় অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে জাতীয় সম্মেলন। শনিবার রাজধানীর গুলশানের ইমানুয়েল কনভেনশন সেন্টারে এ সম্মেলনের আয়োজনের ঘোষণা দিয়েছেন দলের প্রবীণ নেতারা।
এই ঘোষণার পেছনে রয়েছে এক গুরুত্বপূর্ণ সাংগঠনিক পটপরিবর্তন। ৩১ জুলাই আদালত জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জিএম কাদের ও যুগ্ম দপ্তর সম্পাদক মাহমুদ আলমের সাংগঠনিক কার্যক্রম পরিচালনার ওপর অস্থায়ী নিষেধাজ্ঞা জারি করে। এই রায়ের ভিত্তিতে দলের আগে অব্যাহতি পাওয়া জ্যেষ্ঠ নেতারা নতুন করে সংগঠনের দায়িত্ব নেওয়ার প্রস্তুতি নেন।
এরই ধারাবাহিকতায় শুক্রবার (৮ আগস্ট) গুলশান এভিনিউয়ের হাওলাদার টাওয়ারে আনুষ্ঠানিকভাবে সম্মেলনের ঘোষণা দেন সাবেক কো-চেয়ারম্যান আনিসুল ইসলাম মাহমুদ, এ বি এম রুহুল আমিন হাওলাদার ও মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু। তারা জানান, দলীয় গঠনতন্ত্র অনুযায়ী আনিসুল ইসলাম মাহমুদ এখন জাতীয় পার্টির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন এবং এই সম্মেলন হবে ঐক্যের প্রতীক।
মুজিবুল হক চুন্নু জানান, “এই সম্মেলন শুধু আনুষ্ঠানিকতা নয়, এটি আত্মশুদ্ধি ও তৃণমূল কর্মীদের জাগরণের দিন। গণতান্ত্রিক নেতৃত্ব পুনর্গঠনের শপথ নেবে দল।” তিনি আরও বলেন, জাতীয় পার্টি কোনো ব্যক্তিকেন্দ্রিক দল নয়, বরং এটি একটি আদর্শিক সংগঠন।
তারা দাবি করেন, সম্প্রতি যারা বিভ্রান্তি ছড়াচ্ছেন তাদের কোনো ভিত্তি নেই। সম্মেলনের আয়োজন করা হচ্ছে আদালতের নির্দেশনা অনুযায়ী এবং নির্বাচন কমিশনকে জানিয়ে, তাদের প্রতিনিধিদের উপস্থিতিতে। সম্মেলনে দেশের প্রতিটি জেলা থেকে দলীয় নেতাকর্মীদের অংশগ্রহণের প্রত্যাশাও ব্যক্ত করা হয়।
সংবাদ সম্মেলনে রুহুল আমিন হাওলাদার অভিযোগ করেন, জিএম কাদেরের সঙ্গে একাধিকবার দল পরিচালনায় যৌথ নেতৃত্বের প্রস্তাব দেওয়া হলেও তিনি সেটি মেনে নেননি। বরং একক নেতৃত্বের মাধ্যমে দলকে আরও বিভক্ত করে তুলেছেন। এই প্রেক্ষাপটেই নতুন নেতৃত্ব ঐক্যবদ্ধ দল গঠনের উদ্যোগ নিয়েছে।
আনিসুল ইসলাম মাহমুদ বলেন, “আমরা গণতন্ত্র দেশে প্রতিষ্ঠা করতে চাই, অথচ নিজের দলে যদি গণতন্ত্র না থাকে তবে সেটা গ্রহণযোগ্য নয়। জাতীয় পার্টির গঠনতন্ত্র পরিবর্তনের মাধ্যমে ভবিষ্যতে যেন কোনো চেয়ারম্যান একক সিদ্ধান্তে কমিটি ভাঙতে না পারেন, সেই ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”
তিনি আরও জানান, রওশন এরশাদ ও আনোয়ার হোসেন মঞ্জুর সঙ্গেও যোগাযোগ হয়েছে এবং তারা সম্মেলনে অংশগ্রহণ করবেন। এর মাধ্যমে অতীতের বিভক্ত অংশগুলোকে একীভূত করে জাতীয় পার্টিকে আবার ঐক্যবদ্ধ করা হবে বলে আশা প্রকাশ করেন তিনি।
জাতীয় পার্টির ইতিহাসে এর আগে একাধিকবার বিভক্তি দেখা গেছে—১৯৯০ সালে এরশাদের পতনের পর, এরপর ১৯৯৭, ১৯৯৮, ২০০১, ২০১৩ এবং সর্বশেষ ২০২৪ সালের এপ্রিলেও বিভাজন হয়। এসব ভাঙনের অবসান ঘটিয়ে এবার একটি ঐক্যবদ্ধ, আদর্শিক এবং গণতান্ত্রিক জাতীয় পার্টির পথে হাঁটার অঙ্গীকার নিয়ে সামনে এগিয়ে যেতে চায় নতুন নেতৃত্ব।
এই ঐক্য সম্মেলনের মধ্য দিয়ে জাতীয় পার্টি আবারও দেশে একটি দায়িত্বশীল বিরোধী শক্তি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করতে চায়—যেখানে দলীয় স্বার্থ নয়, বরং আদর্শ, গণতন্ত্র ও জনগণের প্রত্যাশাই হবে মূল চালিকাশাশক্তি।