শ্রমিকরাই শুধু গড়বে, তাঁদের গড়বে কে?

মোঃ শামীম মিয়া | প্রকাশ: ১০ আগস্ট, ২০২৫, ০৪:৩৪ পিএম
শ্রমিকরাই শুধু গড়বে, তাঁদের গড়বে কে?
মোঃ শামীম মিয়া
ভোরের আলো ফোটার আগেই তাঁরা ঘর ছাড়েন। কেউ যান নির্মাণস্থলে, কেউ কারখানায়, কেউবা রাস্তায় পণ্য টানার কাজে। তাঁরা কাঁচা ঘামে ভেজান শহরের ইট, মাটি, রড আর সিমেন্ট। এই মানুষেরা কারা? তাঁরা আমাদের শ্রমিক—দেশের অর্থনীতির মৌলিক চালিকাশক্তি। তাঁদের ঘামে গড়ে ওঠে শিল্প, গড়ে ওঠে নগর। অথচ সেই শ্রমিকদের জীবন থেকে আনন্দ হারিয়ে গেছে, স্বাস্থ্য ধ্বংস হয়েছে, নিরাপত্তা হয়েছে কল্পনার বস্তু। এই সমাজে সবাই চায় গড়া, কেউ চায় না গড়তে। শ্রমিকরাই শুধু গড়বে—কিন্তু তাঁদের গড়বে কে? বাংলাদেশে প্রায় ছয় কোটির মতো শ্রমজীবী মানুষ রয়েছেন, যাঁদের অনেকেই অনানুষ্ঠানিক খাতে নিয়োজিত। গার্মেন্টস, নির্মাণশিল্প, পরিবহন, কৃষি, রিকশা চালানো, মাছ ধরা—এসব পেশায় কর্মরত শ্রমিকেরা প্রতিদিনই শারীরিক ও মানসিক ঝুঁকি নিয়ে কাজ করেন। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও)-র তথ্যানুসারে, বিশ্বে প্রতিবছর প্রায় ২.৯৩ মিলিয়ন শ্রমিক পেশাগত দুর্ঘটনা বা রোগে প্রাণ হারান। বাংলাদেশে শুধু ২০২৩ সালেই বিভিন্ন খাতে কর্মরত অবস্থায় মারা গেছেন প্রায় ১,৪৩২ শ্রমিক।”। অথচ এসব মৃত্যু ঠেকানো যেত, যদি সঠিক নিরাপত্তা, সচেতনতা ও দায়িত্বশীলতা থাকত। নির্মাণ শ্রমিকদের ক্ষেত্রেই ধরা যাক—তাঁদের কর্মপরিবেশ অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। মাথার ওপর দিয়ে চলে রড-সিমেন্টবাহী ক্রেন, মেঝে থাকে অসমতল, নিরাপত্তা বেল্ট কিংবা হেলমেট ব্যবহারে অনীহা কিংবা অনুপস্থিতি দেখা যায়। দুর্ঘটনা ঘটলে দায়দায়িত্ব কেউ নেয় না। অনেক ক্ষেত্রেই মালিকপক্ষ দায় অস্বীকার করে। নিহত শ্রমিকের পরিবার থাকে নিঃস্ব, ক্ষতিপূরণ নামে মেলে কিছু টুকরো সমবেদনা। পোশাকশিল্পে নিয়োজিত নারী শ্রমিকদের অবস্থাও উদ্বেগজনক। তাঁরা মাসের পর মাস অতিরিক্ত সময় কাজ করেও সময়মতো বেতন পান না, মেলে না ওভারটাইমের টাকা। অনেকেই নিপীড়নের শিকার হন, কিন্তু বলার মতো পরিবেশ পান না। তাঁদের সন্তানদের শিক্ষার সুযোগ নেই, নেই স্বাস্থ্যসেবার নিশ্চয়তা। এমনকি মাতৃত্বকালীন ছুটিও অনেকে পান না। তবে শুধু নিরাপত্তা নয়, শ্রমিকদের পুষ্টি, বিশ্রাম, স্বাস্থ্য এবং মানসিক স্বস্তির প্রতিও রাষ্ট্রের দায় রয়েছে। অথচ এখানে সেই দায় অনেকটা কাগজে-কলমে সীমাবদ্ধ। সরকার শ্রমিকদের জন্য নানা পরিকল্পনা নিলেও সেগুলোর বাস্তবায়ন হয় খুবই সীমিত আকারে। শ্রমিক কল্যাণ তহবিল গঠিত হলেও এর কার্যকারিতা প্রশ্নবিদ্ধ। যেসব কর্মস্থলে আইন অনুযায়ী চিকিৎসা বা বিশ্রামের ব্যবস্থা থাকার কথা, সেখানে প্রায় কিছুই নেই। শ্রমিকদের স্বাস্থ্যব্যবস্থাও একটি বড় সংকট। নির্মাণ শ্রমিক, রিকশাচালক, গার্মেন্টস শ্রমিকদের অধিকাংশই দীর্ঘ সময়ের কায়িক পরিশ্রমের ফলে পেশাগত রোগে ভোগেন। ঘাড়ব্যথা, হাড়ক্ষয়, চর্মরোগ, চোখের সমস্যা, শ্বাসকষ্ট—এসব তাঁদের নিত্যসঙ্গী। কিন্তু তাঁরা এসব রোগের চিকিৎসা নিতে পারেন না সময়, অর্থ বা সুযোগের অভাবে। একটি রাষ্ট্রের উন্নয়ন তখনই টেকসই হয়, যখন তার মূল শ্রমশক্তি সুস্থ, সচেতন ও সুরক্ষিত থাকে। বাংলাদেশ যদি ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত দেশে পরিণত হতে চায়, তাহলে শ্রমিকদের আর অবহেলা করা যাবে না। সঠিক প্রশিক্ষণ ও দক্ষতা উন্নয়নের মাধ্যমে শ্রমিকদের ক্ষমতায়ন করতে হবে। প্রশিক্ষণহীন শ্রমিক যেমন নিরাপত্তার জন্য হুমকি, তেমনি তাঁর কর্মক্ষমতা ও উৎপাদনশীলতাও কম হয়। একটি দক্ষ শ্রমিক জাতির সম্পদ—এই চিন্তা রাষ্ট্রীয় নীতিতে দৃঢ়ভাবে প্রতিফলিত হওয়া জরুরি। বাংলাদেশের বিপুল রেমিট্যান্স আয়ের পেছনে বড় অংশজুড়ে রয়েছেন বিদেশে থাকা শ্রমিকেরা। মধ্যপ্রাচ্য, মালয়েশিয়া, ইউরোপ, সিঙ্গাপুরে বিপুলসংখ্যক বাংলাদেশি নির্মাণ, কৃষি, হোটেল কিংবা পরিচ্ছন্নতাকর্মে নিয়োজিত। তাঁদের পাঠানো টাকা আমাদের বৈদেশিক মুদ্রার প্রধান উৎস। কিন্তু এইসব শ্রমিক বিদেশে কাজ করতে গিয়ে হয়রানি, প্রতারণা ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের শিকার হন। অনেক সময় দেখা যায়, তাঁরা প্রবাসে মারা গেলেও লাশ দেশে ফেরে না, আর পরিবার পায় না কোনো ক্ষতিপূরণ। এখানে প্রয়োজন রাষ্ট্রীয় কূটনৈতিক সক্রিয়তা এবং বিদেশগামী শ্রমিকদের জন্য সুশৃঙ্খল, নিরাপদ ও স্বচ্ছ অভিবাসনব্যবস্থা। একটি প্রবাসী শ্রমিক যদি বিদেশে গিয়ে সঠিকভাবে রেমিট্যান্স পাঠান, তাহলে তিনি কেবল নিজের পরিবারই নয়, দেশকেও অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ করেন। সেই কর্মীকে রাষ্ট্র কেবল ‘মজুর’ হিসেবে নয়, একজন গর্বিত রাষ্ট্রদূত হিসেবে দেখুক—এমনটাই প্রত্যাশা। শ্রমিকদের একটি বড় সমস্যা হলো সংগঠিত হওয়ার সুযোগের অভাব। যদিও শ্রম আইন তাঁদের সংগঠন করার অধিকার দেয়, বাস্তবে অনেক ক্ষেত্রেই সংগঠন করা নিষিদ্ধ বা নিরুৎসাহিত করা হয়। ফলে তাঁরা তাঁদের অধিকার আদায়ে এককভাবে লড়তে বাধ্য হন, যা প্রায়শই ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। এখানে মালিকশ্রেণির মনোভাব পরিবর্তনও প্রয়োজন। শ্রমিককে কেবল উৎপাদনযন্ত্র মনে না করে একজন মানুষ হিসেবে দেখতে হবে। শ্রমিকের হাসি-আনন্দ, পারিবারিক সময়, শারীরিক বিশ্রাম—সবই গুরুত্বপূর্ণ। কোনো শ্রমিক যদি অসুস্থ হন বা সন্তানকে হাসপাতালে নিয়ে যেতে হয়, তাঁর যেন সেই অধিকার থাকে। কোনো শ্রমিক যদি ন্যায্য মজুরি দাবি করেন, তাঁকে যেন চাকরি হারানোর ভয় না পেতে হয়। রাষ্ট্রের বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পে হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যয় হয়, মেগা প্রকল্পগুলো ধাপে ধাপে বাস্তবায়িত হয়, কিন্তু একই সময় হাজারো শ্রমিক পা ফাটিয়ে কাজ করেও একটি ভাতের থালা ঠিকভাবে জোটাতে পারেন না—এটা কি সভ্য সমাজের পরিচয় হতে পারে? একটি উন্নত বাংলাদেশ গড়তে হলে উন্নয়নের ভিতরেই মানবিকতা বসাতে হবে। শ্রমিকদের অধিকার শুধু মে দিবসের ব্যানারে সীমাবদ্ধ রাখলে চলবে না। চাই ৩৬৫ দিনের কর্মপরিকল্পনা—যেখানে শ্রমিকের হাসি থাকবে, থাকবে তাঁর সন্তানের শিক্ষার অধিকার, থাকবে একটুখানি ছুটি, একটুখানি সম্মান। শ্রমিকেরা শুধু ঘর বানান না, তাঁরা গড়ে তোলেন জাতি। তাঁদের ছাড়া কোনো অগ্রগতি সম্ভব নয়। অথচ আজও এই শ্রেণির মানুষগুলো চরম অবহেলা, দারিদ্র্য, অনিশ্চয়তা আর নিরাপত্তাহীনতার মাঝে বাস করছেন। কেউ যদি শহরের রাজপথের পিচ বিছান, কেউ যদি ইট-রডের ভার টানেন, কেউ যদি গভীর রাতে রিকশা চালান—তবে তাঁর জীবনে অন্তত একটু স্থিতি, একটু স্বস্তি, একটু সম্মান প্রাপ্য নয় কি? শেষ কথা, উন্নয়নের চাকা তখনই বৃত্ত হয়ে ঘুরবে, যখন তার কেন্দ্রবিন্দুতে থাকবে মানুষ। আর মানুষ মানেই শ্রমিক। এই শ্রমিকের ঘামে মিশে আছে দেশের ভবিষ্যৎ। তাই প্রশ্ন থেকেই যায়—শ্রমিকরাই যদি শুধু গড়বেন, তবে তাঁদের গড়বে কে?

এই প্রতিবেদনটির তথ্য, বক্তব্য ও সকল দায়-দায়িত্ব লেখকের। এর জন্য সম্পাদক দায়ী থাকবেনা