সুনামগঞ্জের যুব উদ্যোক্তা তৃষ্ণা আক্তার রুশনার সংগ্রামের গল্প

এফএনএস (একে কুদরত পাশা; দিরাই, সুনামগঞ্জ) : | প্রকাশ: ১১ আগস্ট, ২০২৫, ০৭:৪৩ পিএম
সুনামগঞ্জের যুব উদ্যোক্তা তৃষ্ণা আক্তার রুশনার সংগ্রামের গল্প

জীবনযুদ্ধে হেরে না গিয়ে দুর্দান্ত লড়াই করে আজ নিজেকে সফল নারী উদ্যোক্তা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছেন সুনামগঞ্জের তৃষ্ণা আক্তার রুশনা। যিনি এক সময় পরিবারে অভাব, সমাজের কটুকথা ও নারী হয়ে ওঠার পথে একের পর এক বাঁধার মুখোমুখি হয়েও হাল ছাড়েননি। আজ তিনি একজন প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী, প্রশিক্ষক ও নারীদের প্রেরণার উৎস।

তৃষ্ণা আক্তারের বাড়ি সুনামগঞ্জের দিরাই উপজেলার ভাটিপাড়া গ্রামে হলেও বর্তমানে তিনি সুনামগঞ্জ শহরের নবীনগরে বসবাস করছেন এবং সেখানেই নিজের পোশাক ব্যবসা পরিচালনা করছেন।

শুরুটা একেবারে শূন্য থেকে। ২০০৬ সালে সিলেট যুব উন্নয়ন অধিদপ্তরে পোশাক তৈরির একটি প্রশিক্ষণ কোর্সে ভর্তি হন। পরিবারিক অস্বচ্ছলতা, সামাজিক প্রতিকূলতা ও বারবার প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও প্রশিক্ষণ শেষ করে ২০০৮ সালে নবীনগরে একটি সেলাই মেশিন নিয়ে নিজের ঘরে সেলাইয়ের কাজ শুরু করেন। প্রথমে দিন-রাত কাজ করে যা আয় হতো, তা দিয়েই সংসার চালাতেন, কখনো কখনো অনাহারে-অর্ধাহারেও থাকতে হতো।

তৃষ্ণার জীবনের শুরু থেকেই ছিল চরম দারিদ্র‍্য ও অস্থিরতা। ভাইয়ের অসুস্থতা ও পারিবারিক জটিলতা তাকে খুব অল্প বয়সেই জীবনসংগ্রামে নামতে বাধ্য করে। স্কুলে নিয়মিত যাওয়া সম্ভব ছিল না; ফলে বারবার লেখাপড়া বিঘ্নিত হয়েছে।

এক পর্যায়ে জীবনের নানামুখী চাপের মুখে পড়েও হাল ছাড়েননি। আত্মসম্মান রক্ষা ও নিজের স্বপ্নপূরণের দৃঢ় সংকল্প তাকে এগিয়ে নিয়ে যায়। সময়ের সাথে সাথে সমাজের নেতিবাচক মন্তব্য আর অবহেলা সহ্য করে, চোখের জল গিলে এগিয়ে গেছেন কেবল আত্মবিশ্বাসের জোরে।

বর্তমানে রুশনার রয়েছে ৭টি সেলাই মেশিন এবং একটি প্রস্তুত পোষাকের নিজস্ব শোরুম। তার অধীনে ১১ জন নারী কাজ করেন, যারা অধিকাংশই তার মতোই আর্থিকভাবে পিছিয়ে পড়া। তাদেরকে রুশনা নিজেই প্রশিক্ষণ দিয়ে কাজের উপযোগী করেছেন।

২০১৮ সালে যুব উন্নয়ন অধিদপ্তর থেকে জেলায় সফল নারী উদ্যোক্তা হিসেবে স্বীকৃতি পান। এরপর ২০২২ সালে সুনামগঞ্জ তৃণমূল নারী উদ্যোক্তা সোসাইটি (গ্রাসরুট) থেকে “উদ্যোক্তা পুরস্কার”এবং ২০২৪ সালে মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তর থেকে “সফল নারী”পুরস্কার পান।

রুশনা নিজের প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি একটি নারী উন্নয়ন সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেছেন। এই সংগঠনের মাধ্যমে তিনি দরিদ্র ও অবহেলিত নারীদের বিনামূল্যে সেলাই, নকশিকাঁথা তৈরি, মুদি দোকান পরিচালনা ও অন্যান্য হস্তশিল্পভিত্তিক প্রশিক্ষণ প্রদান করে থাকেন। এখন পর্যন্ত প্রায় ৪০০ থেকে ৬০০ নারী তার প্রশিক্ষণে উপকৃত হয়েছেন।


তৃষ্ণা আক্তার রুশনার জীবনপথে মসৃণতা ছিল না। পরিবার ও সমাজের অনেকেই তাকে 'খারাপ মেয়ে' বলে আখ্যা দিয়েছিল-শুধু নিজের পায়ে দাঁড়াতে চাওয়ার অপরাধে। এমনকি নিজের মা-ও এক সময় তার সিদ্ধান্তে বিরক্ত ছিলেন। কিন্তু রুশনার কষ্ট ও আত্মনির্ভরতার অদম্য চেষ্টায় আজ সেই পরিবার, সমাজ এবং সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোও তাকে সম্মানের চোখে দেখে।

তিনি বলেন-“যারা আমাকে অবহেলা করেছে, তারাই এখন সম্মানের চোখে দেখে। আমি প্রমাণ করেছি, নারীরাও পারে, শুধু সাহস ও সুযোগের দরকার।”

তৃষ্ণা এখন নিজ এলাকার আরও নারীদের প্রশিক্ষণ দিয়ে স্বাবলম্বী করে তুলতে চান। পাশাপাশি সুনামগঞ্জ শহরে নারীদের জন্য একটি পূর্ণাঙ্গ শিল্প প্রশিক্ষণ কেন্দ্র গড়ে তোলার স্বপ্ন দেখছেন।

তৃষ্ণা আক্তার রুশনা আজ শুধু একজন নারী উদ্যোক্তা নন, বরং তিনি সুনামগঞ্জের নারীদের জন্য এক উজ্জ্বল অনুপ্রেরণা। তার জীবনের গল্প প্রমাণ করে, সাহস, ইচ্ছাশক্তি ও পরিশ্রম থাকলে যে কোনো প্রতিকূলতাকে জয় করা সম্ভব।

আপনার জেলার সংবাদ পড়তে