নওগাঁর মহাদেবপুরে খাদিজা খাতুন (২৪) নামে এক সুন্দরী যুবতী খুন হবার প্রায় দুই মাসেও তার হত্যা রহস্য উদঘাটন করতে পারেনি পুুলিশ। ওই যুবতী সম্পর্কে নানান চাঞ্চল্যকর তথ্য জানা গেলেও তার হত্যা রহস্য উদঘাটনে নেই তেমন কোন অগ্রগতি। ফলে এলাকার একটি স্বার্থন্বেষী মহল এ হত্যাকান্ডের দায় থেকে বেঁচে যেতে পারে বলে স্থানীয়রা আশংকা প্রকাশ করেছেন। প্রাপ্ত তথ্যের ধারাবাহিক অনুসন্ধানের মাধ্যমে প্রকৃত দোষীদের শনাক্তের দাবি তাদের।
ঘটনার বিবরণ :
আলোচিত যুবতী উপজেলার চাঁন্দাশ ইউনিয়নের বাগডোব নীচপাড়া সরদারপাড়া গ্রামের রিক্সাচালক খোকন হোসেনের মেয়ে। গত ১৯ জুন সকালে স্থানীয়রা উপজেলা সদরের বকের মোড়-উপজেলা পরিষদ সড়কের খড়হাটি এলাকায় তার মরদেহ পড়ে থাকতে দেখে থানা পুলিশে খবর দেন। পুলিশ মরদেহ উদ্ধার করে ময়নাতদন্ত শেষে স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করে। নিহতের পিতা বাদি হয়ে মহাদেবপুর থানায় অজ্ঞাতনামাদের বিরুদ্ধে একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন। আরজিতে তিনি এ হত্যাকান্ডের জন্য খাদিজার কথিত স্বামী আমিনুল ইসলামকে সন্দেহ হয় বলে উল্লেখ করেন। থানা পুলিশ আমিনুলকে গ্রেপ্তার করতে সক্ষম হয়নি।
যেভাবে খোঁজ মেলে :
উপজেলা সদরের খড় হাটির জায়গাটায় কয়েকটি খড়ের পালা রাখায় এর কিছুটা অংশ আড়াল হয়ে থাকে। পশ্চিমপাশ দিয়ে সরকারি ডাবলওয়ে রাস্তা থাকলেও রাস্তা থেকে এই অংশটা দেখা যায়না। মানুষ মূলত মূত্রত্যাগের জন্য এই স্থান ব্যবহার করে থাকেন। এই রাস্তা দিয়ে টহল দেন বণিক সমিতির নিয়োগ করা নৈশ প্রহরীরা। সকালে একজন পথচারি এখানে মূত্রত্যাগ করতে গেলে মরদেহটি পড়ে থাকতে দেখেন। এর পশ্চিম পাশে রাস্তার ওপারে ইসলামী ব্যাংকের শাখা, কয়েকটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান আর প্রাণিসম্পদ হাসপাতাল, পূর্বে কয়েকটি বহুতল বসতবাড়ি, টিএন্ডটি ভবন ও সওজ এর ভবন, উত্তরে সাবেক সোনালী ব্যাংক এবং দক্ষিণে নির্বাচন অফিস ও উপজেলা পরিষদ কমপ্লেক্স। এসব ভবনের প্রায় প্রত্যেকটিতে সিসি ক্যামেরা সচল রয়েছে।
মরদেহ উদ্ধারে পুলিশ :
খবর পেয়ে মহাদেবপুর থানা পুলিশ ঘটনাস্থলে পৌঁছে মরদেহের সুরতহাল রিপোর্ট ও জব্দ তালিকা তৈরি করে। পুলিশ মরদেহ উদ্ধার করার সময় তার প্যান্টের পকেটে রাখা ইয়াবা, হেরোইন, ট্যাপেন্ডাডল প্রভৃতি সেবনের জন্য তৈরি করা পাইপ ও গ্যাস লাইটার জব্দ করে। কিন্তু তার কাছ থেকে কোন মোবাইলফোন পাওয়া যায়নি। সকালে পুলিশ অজ্ঞাত হিসেবে মরদেহ উদ্ধার করে। পরে বিকেলে তার পিতা মরদেহ শনাক্ত করেন। পুলিশ ময়নাতদন্ত শেষে মরদেহ স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করে। নিহতের পিতা বাদি হয়ে এব্যাপারে থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন।
নিহতের পরিবারের দাবি :
বিষয়টি জানতে সরেজমিনে নিহতের গ্রামের বাড়িতে গেলে তার পিতা খোকন হোসেন জানান, দীর্ঘদিন ধরে খাদিজা তাদের বাড়ি যাননি। খাদিজা উপজেলা সদরে বসবাস করতেন। তার কথিত স্বামী আমিনুল ইসলাম তাকে হত্যা করে থাকতে পারেন।
নিহতের মা রেহেনা বেগম জানান, তার মেয়ে মাসের পর মাস তাদের সাথে যোগাযোগ রাখেনি। একটি প্রভাবশালী চক্র তার সুন্দরী মেয়েকে খারাপ করেছে বলেও অভিযোগ তার। তিনি বলেন, পোরশা উপজেলার জফির ডাক্তারের মেয়ে হাসিনা বেগমের সাথে তার মেয়ে খাদিজা মহাদেবপুরে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন ভাড়া বাসায় থাকতো। হাসিনা মেয়েটি খুবই খারাপ, তার মেয়েকেও সে খারাপ করেছে। হাসিনার স্বামী মহাদেবপুর উপজেলার হাতুড় ইউনিয়নের চকশ্রীপুর গ্রামের মো: আলম। তিনিও খারাপ কাজ করেন। কিছুদিন আগে তারা তার মেয়েকে নিয়ে মহাদেবপুর লিচুতলায় জননী ক্লিনিকের পশ্চিম পাশের ছয়তলা বিল্ডিংয়ের দোতালায় ভাড়া থাকতো। সেখানে রেহেনা বেগমের সামনেই আলম খাদিজাকে মাদক খাইয়ে দিয়েছে। সবশেষ তারা শিবগঞ্জের মোড়ে ব্যুরো বাংলাদেশ নামের এনজিও অফিসের পূর্বপাশের এক বাসায় ভাড়া থাকতো। খাদিজা হত্যাকান্ডের পর হাসিনা-আলম দম্পতি পত্নীতলা উপজেলা সদরে একটি ক্লিনিকে থাকছেন বলেও জানান তিনি। রেহেনা বেগম জানান, এসব কথা তিনি থানা পুলিশকে জানিয়েছেন। কিন্তু দুমাসেও তারা কেউ আটক না হওয়ায় তিনি হতাশ হয়ে পড়েছেন। তিনি এখন তার মেয়ের হত্যাকারিদের খুঁজে বের করে শাস্তির জন্য দ্বারে দ্বারে ধর্না দিচ্ছেন।
আমিনুলের সাথে যত কান্ড :
সংশ্লিষ্টরা জানান, ২০১৮ সালে খাদিজা যখন এসএসসি পরীক্ষার্থী তখন তিনি গর্ভবতী হয়ে পড়েন। বিষয়টি জানাজানি হলে খাদিজার পিতা বাদি হয়ে ২০১৯ সালের ৯ এপ্রিল নওগাঁর নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে একটি মামলা দায়ের করেন। মামলায় একমাত্র আসামী করা হয় বাগডোব নীচপাড়া গ্রামের আহম্মদ আলীর ছেলে আমিনুল ইসলামকে। মামলায় অভিযোগ করা হয় যে, ২০১৮ সালের ৭ মে খাদিজাকে বাড়িতে একা পেয়ে প্রতিবেশী আমিনুল তাকে বিয়ের প্রলোভন দিয়ে ধর্ষণ করে। ধর্ষণের দৃশ্য মোবাইলফোনে ধারণ করে রাখে। ওই দৃশ্য ফাঁস করে দেয়ার ভয় দেখিয়ে ও বিয়ের প্রলোভন দিয়ে নওগাঁয় হোটেলে ও বিভিন্ন স্থানে নিয়ে গিয়ে আমিনুল খাদিজাকে বার বার ধর্ষণ করে। ফলে খাদিজা কখন গর্ভবতী হয়ে পড়ে তা তিনি নিজেও বুঝতে পারেননি। মামলা দায়েরের সময় তিনি আট মাসের অন্তঃসত্ত্বা ছিলেন। আদালত মামলাটির তদন্তভার দেন মহাদেবপুর থানা পুলিশকে। এরই মধ্যে খাদিজা একটি মেয়ে সন্তানের জন্ম দেন। মামলার সাক্ষ্য পর্যায়ে বাদি ও বিবাদি উভয়পক্ষের পৃথক আবেদনের প্রেক্ষিতে পৃথক ডিএনএ টেষ্ট করা হয়। কিন্তু দুবারই আমিনুলের সাথে খাদিজার গর্ভজাত সন্তানের মিল পাওয়া যায়নি। ঢাকার ফরেনসিক ডিএনএ ল্যাবরেটরি অব পুলিশ আদালতে দেয়া ২০১৯ সালের ৪ সেপ্টেম্বর ও ২০২১ সালের ৬ জানুয়ারি ডিএনএ এক্সামিনার দীপংকর দত্ত স্বাক্ষরিত একই রকম অভিমতে বলা হয়, ‘‘আমিনুল ইসলাম খাদিজা খাতুনের গর্ভজাত নবজাতক কন্যা সন্তানের জৈবিক পিতা নয়।” মামলাটি এখনও চলমান রয়েছে।
আমিনুলের পরিবারের ভাষ্য :
নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের মামলায় জামিনে থাকলেও খাদিজার মরদেহ পাওয়ার পর থেকে আমিনুল বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে আছেন। তাদের বাড়িতে গেলে আমিনুলের ছোট ভাই শাহাদৎ আলী জানান, আমিনুলের বিরুদ্ধে মামলায় জিততে পারবেনা এটা বুঝতে পেরে প্রতিপক্ষরা ২০২০ সালের ১৩ জুলাই রাতে আমিনুলকে অপহরণ করে সিএনজিযোগে নওগাঁয় নিয়ে যায়। সেখানে একটি বাড়িতে তাকে আটকে রেখে মারপিট করে, হত্যার হুমকি দিয়ে খাদিজার সাথে আমিনুলের বিয়ে পড়িয়ে দেয়। আমিনুল এ ব্যাপারে খাদিজা, তার বাবা, মা ও অন্যদের বিরুদ্ধে কোর্টে মামলা দায়ের করেন। সেই মামলাও এখন চলমান।
আমিনুলের স্ত্রী আলেয়া পারভীন দাবি করেন, খাদিজা মহাদেবপুরে ভাড়া বাসায় একাই থাকতো। আমিনুল কোন দিনও তার কাছে যাননি।
মোবাইলের সূত্র ধরে একজন আটক :
খাদিজা হত্যাকান্ডের তিন দিন পর গত ২২ জুন থানা পুলিশ হাসিনার মোবাইলফোনের সূত্র ধরে খাজুর গ্রামের মোজাম্মেল হকের ছেলে শাহজাহান আলীকে (৩৬) আটক করে। মহাদেবপুর থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) শাহীন রেজা জানান, রেহেনা বেগমের কাছ থেকে খাদিজার মোবাইলফোন নম্বর নিয়ে ট্যাগ করলে তা বন্ধ পাওয়া যায়। পরে তথ্যপ্রযুক্তির সহায়তায় ওই নম্বর যে মোবাইলসেটে ব্যবহার হতো তার লোকেশন ট্যাগ করে এক ব্যক্তির কাছে সেটি পাওয়া যায়। তিনি জানান, দুদিন আগে তিনি সেটটি শাহজাহানের নিকট থেকে কিনেছেন। শাহজাহান জানান, নিহত খাদিজার সাথে তার সম্পর্ক ছিল। দুদিন আগে তিনি খাদিজার বাসায় গিয়ে সময় কাটান। আসার সময় তার মোবাইলফোনটি চুরি করে নিয়ে আসেন।
স্থানীয়দের ভাষ্য :
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক স্থানীয় কয়েকজন প্রভাবশালী জানান, মহাদেবপুর উপজেলা সদর, মাতাজীহাট, পাঁঠাকাঠা প্রভৃতি স্থানে একটি প্রভাবশালী চক্র দীর্ঘদিন ধরে মাদকের আখড়া গড়ে তুলেছেন। মাদকের সাথে তারা নারীদেহেরও জমজমাট আসর বসায়। একই সাথে ইয়াবা, হেরোইন সেবন আর বিকৃত গ্রুপ সেক্সেরও আসর চলে। প্রতিদিন লক্ষ টাকার মাদক বিক্রি হয় এসব স্পটে। প্রায়ই বিভিন্ন সংস্থার সদস্যরা এদের কাছ থেকে নগদ লক্ষ লক্ষ টাকাসহ মাদক আটক করে। স্থানীয়দের হাতে কপোত-কপোতিও আটক হয়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে স্থানীয়ভাবে জরিমানার মাধ্যমে তাদের ছেড়ে দেয়া হয়। সম্প্রতি এরকম কয়েকটি ঘটনা থানা পুলিশ পর্যন্ত গড়ালেও সেসব মিমাংশা করা হয়। কোন কোন ক্ষেত্রে ব্যবসায়ীদের নারীদের লোভ দেখিয়ে ডেকে নিয়ে আটকে রেখে ব্ল্যাক মেইলিংও করা হয়। এর আগে এ ধরণের ঘটনার খবর সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশের পর ২০২১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর র্যাবের অভিযানে এক যুবককে তার দুই স্ত্রীসহ আটক করা হয়েছিল। এধরণেরই একটি চক্র খাদিজা হত্যাকান্ড ঘটিয়েছে বলে স্থানীয়দের ধারণা।
মামলা তদন্তে শম্বুক গতি :
মহাদেবপুর থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) শাহীন রেজা জানান, এই মামলায় আটক শাহজাহান কোন বাসা থেকে খাদিজার মোবাইলফোন চুরি করেছিল তা বলতে পারেননি। এখন তিনি নাকি সে বাসা আর চিনতেও পারছেন না। হাসিনা বা আলমের সম্পর্কেও কোন খোঁজ পাননি। তিনি বলেন, ময়নাতদন্ত রিপোর্ট পেলেই পরবর্তী ব্যবস্থা নিবেন।
মামলার তদন্তকারি কর্মকর্তা নিয়োগ করা হয় মহাদেবপুর থানার এসআই আব্দুল মতিনকে। মামলার তদন্তে কোন অগ্রগতি আছে কিনা জানতে চাইলে বুধবার (১২ আগস্ট) বিকেলে মোবইলফোনে তিনি বলেন, ‘‘না কোন অগ্রগতি নেই। পোষ্ট মর্টেম রিপোর্টও আসেনি। একজনকে আটক করা হয়েছে।”
এসআই আব্দুল মতিন আরো বলেন, ‘‘আজকে ওর মা আসছিল, উল্টাপাল্টা কথাবার্তা কয়। বলে যে, খাদিজা কোন কোন বাসায় থাকতো সেগুলো আমি চিনি। আমি তাকে বলেছি, ঠিক আছে ওই বাসার মালিকের নাম ঠিকানা নিয়ে আসেন আমার কাছে, আমি দেখবো বিষয়টা। ওই গেছে, পালাইছে তো পালাইছে।”
স্থানীয়দের প্রত্যাশা :
গতবছর ১৫ জানুয়ারি উপজেলার খাজুর ইউনিয়নের কুঞ্জবন মাস্টারপাড়া গ্রামে রিনা পারভীন (৪০) নামে এক গৃহবধূকে সন্ত্রাসীরা তার বাড়িতে হাত-পা-মুখ বেঁধে হত্যা করে ফেলে রাখে। পরদিন থানা পুলিশ তার মরদেহ উদ্ধার করে। কিন্তু গত দেড় বছরেও পুলিশ এ হত্যারহস্য উদঘাটন করতে পারেনি। অধরাই থেকে গেছে হত্যাকারিরা। সুষ্ঠু তদন্ত না হলে খাদিজা হত্যা মামলাও ফ্রিজে চলে যেতে পারে। এনিয়ে এলাকার গৃহবধূরা আতংকে দিন কাটাচ্ছেন। খোদ উপজেলা সদরের ব্যস্ত এলাকায় এ হত্যাকান্ডের কূলকিনারা হবেনা, এটা তারা ভাবতেই পারছেন না। তাদের ধারণা, অন্য কোথাও হত্যা করে মরদেহ এখানে ফেলে রেখে যায় দূর্বত্তরা। এই এলাকার চারদিকের সিসিটিভি ফুটেজ সংগ্রহ করা হয়নি। বণিক সমিতির নৈশপ্রহরি সামসুল আলমকে পুলিশ কোন জিজ্ঞাসাবাদ করেনি বলে জানান তিনি। এছাড়া আলোচিত হাসিনা-আলম দম্পতির খোঁজ পাওয়া গেলে মামলার জট খোলা সম্ভব। আটক শাহজাহানকে ভালভাবে জিজ্ঞাসাবাদ করলেও হত্যার মোটিভ উদঘাটন করা সম্ভব। মামলাটির ঢিলেঢালা জনমনে নানান গুঞ্জন শুরু হয়েছে। এভাবে কালক্ষেপণ করলে হত্যার কোন কোন আলামত নষ্ট হতে পারে বলেও অভিমত স্থানীয়দের। সুষ্ঠু তদন্ত হলে এর সাথে জড়িত রাঘব বোয়ালদের মুখোশ উন্মোচন হতে পারে।