বাংলাদেশের আদিবাসী জনগোষ্ঠীর মধ্যে সাঁওতালরা অন্যতম বৃহৎ ও প্রাচীন সম্প্রদায়। দেশের উত্তরের বনাঞ্চল ও গ্রামীণ এলাকায় দীর্ঘদিন থেকে তারা বসবাস করে আসছে। উত্তরবঙ্গের রাজশাহী, রংপুর, দিনাজপুর, ঠাকুরগাঁও, পঞ্চগড়, কুড়িগ্রাম, গাইবান্ধা ও নীলফামারী জেলায় সাঁওতালদের ঘনবসতি লক্ষ্য করা যায়। আদিবাসী জনসংখ্যার একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসেবে সাঁওতালরা দেশের সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য ও ঐতিহ্যের অমলিন রূপ বহন করছে। তবে সাম্প্রতিক সরকারি তথ্য অনুযায়ী বাংলাদেশে সাঁওতাল জনসংখ্যা আনুমানিক ৪ লক্ষ ৫০ হাজারের কাছাকাছি, যার প্রায় ৭০ শতাংশ বসবাস করে উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন জেলায়।
সাঁওতালদের সাংস্কৃতিক পরিচিতি ও ঐতিহ্য: সাঁওতালরা প্রধানত সাঁওতালি ভাষায় কথা বলে, যা মুন-খমার ভাষা পরিবারের অন্তর্ভুক্ত। তাদের নিজস্ব সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক প্রোফাইলকে আরও সমৃদ্ধ করেছে। কৃষিজীবী এ সম্প্রদায়ের জীবনযাত্রা প্রকৃতির সঙ্গে গভীরভাবে নিবিড়ভাবে জড়িত। তাঁদের ঐতিহ্যগত উৎসব ‘বিহু’, ‘বসু ওজার’, ‘কুম্ভা’ সমাজের ঐক্য ও ধর্মীয় বিশ্বাসের বহিঃপ্রকাশ। উৎসবকালে সাঁওতালরা বর্ণিল নৃত্য-গান ও বাদ্যযন্ত্রের মাধ্যমে তাদের ইতিহাস, মঙ্গলকামনা ও আনন্দের প্রকাশ ঘটায়। সাঁওতালদের ঐতিহ্যগত বাদ্যযন্ত্র যেমন মন্দির, টোমটোম, বাদুম ইত্যাদি তাদের সাংস্কৃতিক জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ।
জনসংখ্যার পরিসংখ্যান ও বসবাসের বিস্তৃতি : সরকারি পরিসংখ্যান অনুযায়ী, বাংলাদেশে আদিবাসী জনগোষ্ঠীর মোট সংখ্যা প্রায় ১৫ থেকে ২০ লাখ। এর মধ্যে সাঁওতাল জনগোষ্ঠী প্রায় ৪ লাখ ৫০ হাজার, যা আদিবাসীদের মধ্যে সংখ্যায় সর্বোচ্চ। উত্তরের রাজশাহী বিভাগে সাঁওতালের ঘনত্ব বেশি। বিশেষ করে দিনাজপুর, রাজশাহী, ঠাকুরগাঁও ও রংপুর জেলায় সাঁওতালের সংখ্যা অনেক বেশি। এছাড়াও কুড়িগ্রাম, পঞ্চগড়, গাইবান্ধা ও নীলফামারীর গ্রামীণ অঞ্চলেও তাদের বসতি বিস্তৃত। আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটে ভারতের ঝাড়খণ্ড, পশ্চিমবঙ্গ ও ওড়িশা রাজ্যে সাঁওতালদের সংখ্যা কয়েক মিলিয়নের বেশি। বাংলাদেশের সাঁওতালরা সেই বৃহৎ সম্প্রদায়ের অংশ হলেও অর্থনৈতিক ও শিক্ষাগত ক্ষেত্রে এখনো পিছিয়ে রয়েছে।
শিক্ষা ও স্বল্পতা : বাংলাদেশের আদিবাসী জনগোষ্ঠীর মধ্যে সাঁওতালদের শিক্ষার হার এখনও খুবই নিম্নমানের। জাতীয় শিক্ষা সমীক্ষা ২০২২ অনুসারে, সাঁওতাল সম্প্রদায়ের মধ্যে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তির হার প্রায় ৭৫% হলেও মাধ্যমিক পর্যায়ে পৌঁছানো মাত্র ৩৫%-এর কাছাকাছি। নারীদের শিক্ষার হার পুরুষদের তুলনায় অনেক কম, যেখানে নারী শিক্ষার হার মাত্র ২৫-৩০%। গ্রামীণ ও বনাঞ্চল ভিত্তিক বসবাসের কারণে অনেক সময় স্কুলে পৌঁছানো, পরিবহণ সুবিধা ও শিক্ষার পরিবেশ অপ্রতুল থাকে। শিশুদের শিক্ষার পথেই বাধা সৃষ্টি করে পারিবারিক দায়িত্ব ও আর্থিক সংকট। শিক্ষার অভাব সাঁওতাল যুবসমাজের কর্মসংস্থান ও সামাজিক অগ্রগতির বড় বাধা। সরকারি বিভিন্ন প্রকল্প যেমন “আদিবাসী শিক্ষাবৃত্তি’’, “স্কুল ইনফ্রাস্ট্রাকচার উন্নয়ন’’, এবং “নারী শিক্ষার প্রসার” উদ্যোগে কাজ করলেও যথাযথ বাস্তবায়ন ও সম্প্রসারণের জন্য আরও প্রয়োজন।
অর্থনৈতিক অবস্থান ও জীবনমান : সাঁওতাল জনগোষ্ঠীর অর্থনৈতিক অবস্থান তুলনামূলকভাবে দুর্বল। অধিকাংশ সাঁওতাল পরিবারের আয় কৃষিকাজের ওপর নির্ভরশীল। সরকারিভাবে সংগৃহীত তথ্য অনুযায়ী, সাঁওতালদের মধ্যে ভূমিহীনতার হার প্রায় ৪৫%-৫০%, যা তাদের কৃষিজমির সীমাবদ্ধতা ও অনিশ্চিত আয়ের কারণ। প্রাকৃতিক দুর্যোগ, জলাবদ্ধতা ও খরা তাদের ফসল ফলাতে বাধা সৃষ্টি করে। অনেক সাঁওতাল সদস্য দিনমজুরি, ছোটখাটো কারিগরি কাজ অথবা বন থেকে বিভিন্ন প্রাকৃতিক সম্পদ সংগ্রহ করে জীবিকা নির্বাহ করে থাকে। সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের প্রশিক্ষণ ও আর্থিক সহায়তা অনেকাংশে তাদের স্বাবলম্বিতা বৃদ্ধি করলেও চাহিদার তুলনায় যথেষ্ট নয়। বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণ, কৃষি প্রযুক্তির উন্নয়ন, ক্ষুদ্রঋণ ও ক্ষুদ্র উদ্যোগের সুযোগ বৃদ্ধি করে সাঁওতাল জনগোষ্ঠীর আর্থিক অবস্থার উন্নয়ন সম্ভব। এ ক্ষেত্রে স্থানীয় প্রশাসন ও উন্নয়ন সংস্থার সমন্বিত প্রচেষ্টা অপরিহার্য।
স্বাস্থ্যসেবা ও সামাজিক সুরক্ষা : স্বাস্থ্যসেবার ক্ষেত্রে সাঁওতাল সম্প্রদায়ের পেছনে থাকার কারণগুলো অনেকগুণ। সরকারি স্বাস্থ্য পরিসংখ্যান মতে, সাঁওতাল জনগোষ্ঠীর শিশু ও মাতৃমৃত্যুর হার জাতীয় গড়ের থেকে প্রায় ২০% বেশি। স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রের দূরত্ব, পরিচ্ছন্নতার অভাব, পুষ্টিহীনতা ও সচেতনতার ঘাটতি এ পরিস্থিতি বাড়িয়ে তোলে। বিশেষ করে শৈশব ও মাতৃত্বকালীন স্বাস্থ্যসেবার অভাব তাদের জন্য উদ্বেগজনক। গ্রামীণ স্বাস্থ্যকর্মী ও বিভিন্ন এনজিও উদ্যোগের মাধ্যমে স্বাস্থ্য সচেতনতা ও সেবা সম্প্রসারণ করলেও ব্যাপক উন্নয়ন এখনো দেরিতে। সাঁওতালদের সামাজিক নিরাপত্তা বৃদ্ধির জন্য স্বাস্থ্য বীমা, পুষ্টি কর্মসূচি ও পরিবেশগত স্বাস্থ্য উন্নয়নের উদ্যোগ প্রয়োজন। স্থানীয় সম্প্রদায়ের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করে স্বাস্থ্যসেবার মান উন্নয়নে মনোযোগ দিতে হবে।
সাংস্কৃতিক সংরক্ষণ ও চ্যালেঞ্জ : সাঁওতালদের ভাষা, সংগীত, নৃত্য ও শিল্পকলার ঐতিহ্য বাংলাদেশে সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যের প্রাণ। তবে বিশ্বায়নের প্রভাবে তাদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের ঝুঁকি বেড়েছে। নতুন প্রজন্মের মাঝে নিজস্ব ভাষার অবহেলা ও আধুনিকতার ছোঁয়ায় ঐতিহ্য হারানোর আশঙ্কা স্পষ্ট। সরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে আদিবাসী ভাষা ও সংস্কৃতি অন্তর্ভুক্তির উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, কিন্তু তা যথেষ্ট নয়। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে সাঁওতাল সাংস্কৃতিক উৎসবের প্রচার ও সমর্থন বাড়াতে হবে। ভাষা সংরক্ষণ, ঐতিহ্যবাহী শিল্পকলা উন্নয়ন, সাঁওতাল সাহিত্য ও লোকগানের চর্চায় সামাজিক ও আর্থিক সহায়তা জরুরি।
সরকারি নীতি ও সামাজিক উদ্যোগ : বাংলাদেশ সরকার “আদিবাসী কল্যাণ অধিদফতর”ও সংশ্লিষ্ট বিভাগসমূহের মাধ্যমে আদিবাসীদের জীবনমান উন্নয়নে কাজ করছে। ২০১৯ সালের সরকারি নীতিমালা অনুসারে, আদিবাসীদের জন্য শিক্ষাবৃত্তি, ভূমি অধিকার নিশ্চিতকরণ, স্বাস্থ্যসেবা ও সাংস্কৃতিক উন্নয়নের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে।তবে বাস্তবতা হলো, নীতিমালা ও প্রকল্পের সঠিক বাস্তবায়ন ও পর্যাপ্ত বরাদ্দের অভাবে সাঁওতালদের উন্নয়ন এখনো বিলম্বিত। স্থানীয় প্রশাসন, এনজিও, ও সমাজের সমন্বিত অংশগ্রহণ ছাড়া কাঙ্ক্ষিত ফলাফল অর্জন কঠিন। উত্তরবঙ্গের সাঁওতাল জনগোষ্ঠী বাংলাদেশের এক অমূল্য সাংস্কৃতিক সম্পদ। তাদের ঐতিহ্য ও জীবনধারা দেশের সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যের প্রাণবন্ত রূপ। তবে জনসংখ্যার প্রায় চার লক্ষ পঞ্চাশ হাজার হলেও শিক্ষার ঘাটতি, আর্থিক দুরবস্থা, স্বাস্থ্যঝুঁকি ও সাংস্কৃতিক অবক্ষয়ের মতো সমস্যার মুখোমুখি। রাষ্ট্র এবং সমাজের পক্ষ থেকে তাদের জীবনমান উন্নয়নে আরো কার্যকরী ও সমন্বিত উদ্যোগ গ্রহণের সময় এখন।
তাদের শিক্ষার প্রসার, অর্থনৈতিক সক্ষমতা বৃদ্ধি, স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতকরণ ও সাংস্কৃতিক সংরক্ষণে ত্বরান্বিত পদক্ষেপ গ্রহণ করা উচিত। এ ক্ষেত্রে স্থানীয় সম্প্রদায়ের অংশগ্রহণ, সরকারি নীতি ও বেসরকারি উদ্যোগের সমন্বয় অপরিহার্য। সাঁওতাল জনগোষ্ঠীর উন্নয়ন বাংলাদেশের জাতীয় ঐক্য, সামাজিক সুবিচার ও সাংস্কৃতিক সমৃদ্ধির জন্য জরুরি। তাদের স্বকীয়তা রক্ষা ও মর্যাদা বৃদ্ধির মাধ্যমে একটি সাম্য ও সুদৃঢ় জাতি গঠন সম্ভব। তাই আমরা সবাই মিলে তাদের জন্য বাস্তব ও টেকসই উন্নয়নের পথ খুঁজে বের করতে হবে।
লেখক: মো: শামীম মিয়া; কলামিস্ট