মংলা নদীবন্দরের সাথে দেশের উত্তরাঞ্চলের প্রবেশদ্বার যশোর-ঝিনাইদহ মহাসড়ক। বন্দরের সাথে উত্তরাঞ্চলসহ সারাদেশের যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নয়নের লক্ষ্যে বিশ্বব্যাংকের অর্থয়ানে ২০২০ সালের ২৪ নভেম্বরে একনেক সভায় ঝিনাইদহ কেন্দ্রীয় বাস টার্মিনাল থেকে যশোরের চাচড়া পর্যন্ত ৪৭.৪৮ কিলোমিটার সড়ক ৬ লেনে উন্নীতকরণের প্রকল্প পাস হয়। সে সময় উইকেয়ার ফেজ-১: ঝিনাইদহ-যশোর মহাসড়ক (এন-৭) উন্নয়ন প্রকল্প’র প্রাক্কলিত ব্যয় মূল্য ধরা হয় ৪১৮৭.৭০১৭ কোটি টাকা। যার মেয়াদ নির্ধারিত হয় ২০২১ সালের পহেলা জানুয়ারি হতে ২০২৩ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত। ভূমি অধিগ্রহণ ও পূনর্বাসন বাবদ ব্যয় ধরা হয় ৮৮৬.৮৯ কোটি টাকা। কিন্তু ভূমি অধিগ্রহণ জটিলতায় বাড়ানো হয়েছে প্রকল্পের মেয়াদ ও মূল্য। পরবর্তীতে প্রকল্পের মেয়াদ বৃদ্ধি করা হয়েছে ২০২৬ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত। ব্যয় বৃদ্ধি করে ধরা হয় ৬৬২৬.৭৩ কোটি টাকা। যেখানে বর্ধিত ব্যয়ে ভূমি অধিগ্রহণ ও পূনর্বাসন বাবদ ধরা হয় ২৬৫০.২৭ কোটি টাকা।
চলতি বছরের ১৫ আগস্ট পর্যন্ত কোন জমি অধিগ্রহণ করতে পারেনি ঝিনাইদহ ও যশোর জেলা প্রশাসন।সর্বশেষ চলতি মাসের ৮ আগস্ট ভূমির দাম নির্ধারণ করে নোটিশ দেওয়া হয়েছে। জমির মালিকরা তা প্রত্যাখ্যান করে মানববন্ধন, সড়ক অবরোধ ও স্বারকলিপি প্রদানসহ বিভিন্ন কর্মসূচী পালন করেছে। জমির সঠিক মূল্য দাবিসহ ঝিনাইদহ জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের ভূমি অধিগ্রহণ শাখার সার্ভেয়ার রিয়াজুল ইসলামের বিরুদ্ধে অনিয়মের অভিযোগ তোলা হয়। জমির মালিকরা বলছেন, জমির বাজারমূল্য বর্তমানে ২০ থেকে ৩০ লাখ টাকা সেখানে তাদের ৭ থেকে ৮ লাখ টাকা নিধারন করা হয়েছে। জমিতে থাকা স্থাপত্যের সঠিক মূল্য নির্ধারিত হয়নি। সার্ভেয়ার রিয়াজুল ইসলাম যাদের কাছ থেকে অনৈতিক সুবিধা পেয়েছেন তাদের জমি ও ভবনের সঠিক শ্রেণিতে দাম নির্ধারিত হয়েছে বলে অভিযোগ করা হচ্ছে।সব মিলিয়ে কাজের গতি ও ভূমি অধিগ্রহনসহ নানা জটিলতায় ২০২৬ সালের ডিসেম্বরেও ৬ লেনের এ সড়কটির কাজ শেষ না হওয়ার শঙ্কা দেখা দিয়েছে। এদিকে সড়কে খানা খন্দে ভরে গেছে। সড়ক ও জনপথ বিভাগ পিচের উপর দায়সারা ইটের ফ্ল্যাট সলিং দিয়ে দুই বছরে প্রায় ৪ কোটি টাকার ক্ষুদ্র সংস্কার কাজ করেছে। কিন্তু তাতেও সড়কে চলাচল উপযোগী করা যাচ্ছে না। এ সড়কটি এখন চলাচলকারীদের জন্য গলার কাটা হয়ে দাড়িয়েছে।
এই প্রকল্পে মোট ভূমি অধিগ্রহণ করা হবে ৩৭৩.১৩ একর। প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে সড়ক ও জনপথ বিভাগ ও ওয়েস্টার্ন ইকোনমিক করিডোর(উইকেয়ার)। ঝিনাইদহ কেন্দ্রীয় বাসটার্মিনাল থেকে যশোরের চাচড়া পর্যন্ত ৪৭.৪৮ কিলোমিটার সড়কটি ৩ লটে ভাগ করা হয়েছে। ঝিনাইদহ কেন্দ্রীয় বাসটার্মিনাল থেকে কালীগঞ্জ সরকারি মাহতাব উদ্দিন ডিগ্রি কলেজ গেট পর্যন্ত লট-১ (১৫.৯ কিমি), সরকারি মাহতাব উদ্দিন কলেজ গেট থেকে যশোরের মান্দারতলা পর্যন্ত লট-২ (১৫.৮ কিমি) এবং মান্দারতলা থেকে চাচড়া পর্যন্ত লট-৩ (১৫.৮ কিমি)। নির্মিতব্য এ সড়কে থাকবে একটি ফ্লাইওভার, চারটি সেতু, ৫৫টি কালভার্ট, পাঁচটি ভেহিকুলার ওভারপাস, ৮টি পেডিস্ট্রিয়ান ওভারপাস ও একটি রেলওয়ে ওভারপাস।এছাড়া প্রকল্প করিডোরকে স্মার্ট হাইওয়েতে রূপান্তর করার লক্ষ্যে ইন্টেলিজেন্ট ট্রান্সপোর্টেশন সিস্টেম ও অপটিক্যাল ফাইবার ক্যাবল ডিজাইন করা হবে। পৌর এলাকার মধ্যে ৪ লেন ও পৌর এলাকার বাইরে ৬ লেনে উন্নীত করা হবে রাস্তাটি।
ঝিনাইদহ অংশে প্রায় ৩০ কিলোমিটার এলাকায় ভূমি মালিকদের শতশত অভিযোগ ও আপত্তি থাকলেও সেগুলো আমলে না নিয়ে নিজেদের খেয়াল খুশি মতো কাজ করছেন।লট-১ অঞ্চলে ব্যক্তি মালিকানা জমি রয়েছে ৯১.৮৬ একর, সরকারি সংস্থার ১.৫২ একর, লট-২ অঞ্চলে ব্যক্তি মালিকানা জমি রয়েছে ১৩২.২২ একর এবং লট-৩ অঞ্চলে ব্যক্তি মালিকানা জমি রয়েছে ৭১.৫৭ একর এবং সেনানিবাসের ৮.০৮ একর জমি রয়েছে। ঝিনাইদহ জেলার মধ্যে জেলা পরিষদের জমি রয়েছে ১৪৫.৪৬ একর। মোবারকগঞ্জ চিনিকলের জমির মধ্যে মিল এলাকায় ১.৬৬ শতক, সদর উপজেলার বিষয়খালী মৌজায় ১৩ শতক, কালীগঞ্জের বারোবাজারে ৪৩ শতক, বারিনগন এলাকায় ৬৩ শতক জমি অধিগ্রহণ হচ্ছে। তবে ৩.১৫ শতক জমির মোট ১৬ লাখ ৭০ হাজার টাকা গ্রহণের জন্য শনিবার মোবারকগঞ্জ চিনিকলে নোটিশ পাঠিয়েছে ভূমি অধিগ্রহণ শাখা। কালীগঞ্জের শহরের ঝরনা প্রিন্টিং প্রেসের মালিক আবু জাফর বলেন, আড়পাড়া মৌজার ১৮৫ নং খতিয়ানের ১১.১৫ শতক জমির মধ্যে ৩.১৫ শতক জমি অধিগ্রহণ করা হচ্ছে। এই পুরো জমিতে তাদের একটি দ্বিতল ভবন রয়েছে। নিচে প্রিন্টিং প্রেস, দোকান ও উপরে একটি ডিজিটাল ফটোল্যাব রয়েছে। তার দাবি, তাদের জমি ও ভবন কালীগঞ্জ শহরের টপ পজিশনে অবস্থিত। কিন্তু সার্ভেয়াররা জ্বরাজীর্ণ ভবন ও নিম্ন শ্রেণিতে অন্তর্ভুক্ত করে আমাদের ঠকিয়েছে। আপত্তি দাখিল করতে গেলেও তারা বিভিন্ন অজুহাত দেখিয়ে গ্রহন করেনি।কোন উপায় না পেয়ে চলতি বছরের ২৬ মে হাইকোর্টে একটি রিট পিটিশন দায়ের করেন। হাইকোর্ট ঝিনাইদহ জেলা প্রশাসককে আপত্তি গ্রহণের নির্দেশ দিলে তারা গ্রহণ করেননি।
ঝিনাইদহ জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের ভূমি অধিগ্রহণ শাখার সামনে ২০/ ৩০ জন অভিযোগকারীর সাথে কথা হয়।কালীগঞ্জের বাদেদীহী গ্রামের আব্দুল মালেক বিশ্বাসের ছেলে জিন্নাত আলী বলেন, আমার জমির রেট দিচ্ছে মাত্র ৪৫ হাজার টাকা শতক। এই জমি বর্তমানে ২০ লাখের উপরে শতক বিক্রি হচ্ছে। একই গ্রামের গোলাম নবীর ছেলে রোকনুজ্জামান বলেন, ২০০৫ সালে বিদেশ থাকা অবস্থায় আমি বারোবাজারে ৩ লাখ টাকা শতক যে জমি কিনেছি সেই জমি সরকার এখন ৪৫ হাজার টাকা করে শতক দিতে চাচ্ছে। এই জমির বাজার মূল্য এখন ২০ লাখের উপরে। সরকার আমাকে পথে বসিয়ে দিচ্ছে।বাবুল আক্তার নামে একজন জানান, তাদের ২.৯৬ শতক জমি অধিগ্রহণ হচ্ছে। এর মধ্যে ০.৯০ শতক জমি ডাঙ্গা শ্রেণি দেখানো হয়েছে। আমি ঝিনাইদহ ভূমি অধিগ্রহণ শাখায় আপত্তি দাখিল করলে সরোজমিনে তদন্তে আসেন কর্মকর্তারা। তারা ভূল স্বীকার করে সংশোধন করে দিবেন বলে জানালে তা আর করেননি।
২০২৩ সালের ২৬ জুন থেকে ভূমি অধিগ্রহণ আইনের ৪ এর ১ ধারার নোটিশ দেওয়া শুরু হয়। নোটিশ দেওয়ার সময় গ্রহণকারীদের তারিখ বিহীন স্বাক্ষর নেওয়া হয়। কয়েক মাস ধরে এই নোটিশ বিতরণ করা হয়েছে এক এনজিওর মাধ্যমে। আইন অনুযায়ী নোটিশ পাওয়ার ১৫ দিনের মধ্যে আপত্তি দাখিলের নির্দেশ রয়েছে। তারিখ বিহীন স্বাক্ষরের ফাঁদে পড়ে অনেকেই আপত্তি দাখিল করতে গিয়ে জানতে পারেন আপত্তি দাখিলের মেয়াদ নেই।
সার্ভেয়ার রিয়াজুল ইসলামকে যারা অনৈতিক সুবিধা দিয়েছেন তাদের জমি সঠিক ভাবে শ্রেণিবদ্ধ হয়েছে এমন অভিযোগ রয়েছে। ঝিনাইদহ ভূমি অধিগ্রহণ শাখার কয়েকজন নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানিয়েছেন, আওয়ামী লীগ সরকারের সাবেক ভারতে খুন হওয়া এমপি আনোয়ারুল আজীম আনারের সাথে সখ্যতা থাকায় দাপুটে ছিলেন সার্ভেয়ার রিয়াজুল ইসলাম। অভিযোগের বিষয়ে রিয়াজুল ইসলাম বলেন, এ ধরনের কথা যারা বলছেন তাদের দাবি সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন। বর্তমান সময়ে জমি অধিগ্রহণে শ্রেণি পরিবর্তনের কোন সুযোগ নেই। সার্ভে করার সময় ম্যাজিস্ট্রেট ছিল। তিনি যেভাবে বলেছেন সেইভাবে লিখেছি।
ঝিনাইদহ ভূমি অধিগ্রহণ কর্মকর্তা আহমেদ সাদাত বলেন, এসব বিষয়ে আমাকে কেউ এখনো জানায়নি বা আমি কোন লিখিত অভিযোগ পায়নি।
উইকেয়ার ফেজ-১ প্রকল্পের ডেপুটি প্রজেক্ট ম্যানেজার নিলন আলী বলেন, জমি অধিগ্রহণ শেষ করতে না পারায় আমরা কাজ করতে পারছি না। লট-১ অঞ্চলে ৭.২৫ শতাংশ অগ্রগতি হয়েছে। তবে অন্যান্য লটে ২ শতাংশের নিচে। এখনো বিদ্যুতের পোল সরানো হয়নি। এই কারণে আমরা সড়ক বিভাগের জমিতে কাজ করতে পারছি না। অধিগ্রহণ শেষ হলেই আমরা দ্রুত কাজ করতে পারবো।