দেশের সর্ববৃহৎ কাঠ ব্যবসার মোকাম হিসেবে পরিচিত পিরোজপুরের স্বরূপকাঠি উপজেলা। প্রায় সাড়ে তিন‘শ বছর ধরেই স্বরূপকাঠিতে গাছ বা কাঠের বাণিজ্যের ঐতিহ্য রয়েছে। স্থানীয় সূত্র জানা যায়, উপজেলার সোহাগদলের ছজয়দ্দিন,কুড়িয়ানার বিষ্ণুপ্রসাদ, দ্বারকানাথ ও বিন্না গ্রামের ব্রজগোপাল ১৬৯৩ সালে সুন্দরবনের সুন্দরি ও বার্মারমার বার্মাটিক গাছকে কেন্দ্র করে এলাকা ভিক্ত কাঠুরিয়াদের মাধ্যমে প্রথম কাঠ ব্যবসার যাত্রা শুরু করে। কুড়িয়ানার বষীয়াণ বরেন্দ্র বিপুল বলেন, ১৭৯৭ সালে বাখরঞ্জ (পিরোজপুর) জেলা অন্তর্ভুক্ত সুন্দরবনের পার্শ্ববর্তী এলাকা কেওড়া,ছৈলা, গেওয়া সহ বিভিন্ন ধরনের গাছের বন-জঙ্গল থাকায় এ এলাকার নাম রাখা হয় কেওয়ারী থানা। ১৮১৯ সালে বরিশালের তৎকালীন জেলা ম্যাজিস্টেট ও কালেক্টর মিস্টার হান্টার সর্বপ্রথম তার নিজ এলাকা পাকিস্তানের আজাদ কশ্মীর অঞ্চলে ৩৩ হাজার ৭‘শ ঢাকার সুন্দরী ও কেওড়া গাছ রপ্তানি করেন। মাহামুদকাঠির শতবর্ষীয়ান গফুর আলী বলেন, ১৮৯৩ সালে কেওয়ারী থানার বিভিন্ন এলাকায় বাণিজ্যিকভাবে গাছের মোকাম গড়ে উঠে। ১৯০৩ সালে জীববিজ্ঞানী ডেভিড প্রেইন সুন্দরবনের ৩৩৪ প্রজাতির গাছের তালিকার মধ্যে আগা-মরা রোগে আক্রান্ত গাছ গেওয়া, গড়ান, বাইন, গোলপাতা, পশুর, হেঁতাল, কেওড়া, খামুঁখলশী, ধন্দুল, লতা সুন্দরী, ওড়া, ছৈলা, কাঁকরা, ঝঁনা ও সিংরাসহ প্রায় ১৬ ধরনের গাছ বায়াওলীরা কাড়ামি নৌকায় সুন্দরবন থেকে এনে কেওয়ারী (স্বরূপকাঠি) থানায় গাছ ব্যবসায় দেশব্যাপী পরিচিত হয়ে উঠে। কেওয়ারী থানা কালীগঙ্গা নদীতে বিলীন হওয়ায় ১৯০৬ সালে এর নাম রাখা হয় স্বরূপকাঠি থানা। এ সময় থানার প্রায় ৭০% পরিবার গাছ ব্যবসায় স্বাবলম্বী হয়ে ওঠে। দেশব্যাপী অর্থসম্পন্ন হিসাবে পরিচিত হয়ে উঠে স্বরূপকাঠি। এরশাদ সরকার ১৯৮৭ সালে ফরেস্ট অ্যাক্ট ১৯২৭ আইন সংশোধন করে সুন্দরবনের পরিবেশ ও বনজ সম্পদ রক্ষায় সুন্দরী গাছ কাটা পারমিট ও নিলাম বন্ধ করে দেয়। আগা-মরা সুন্দরী গাছের নিলামও বন্ধ হয়ে যাওয়ায় সুন্দরবনেই সুন্দরী গাছসহ নানান ধরনের কোটি কোটি টাকার গাছ মাটিতে দেবে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। খুলনা বিভাগীয় বন সংরক্ষক দপ্তর সূত্রে জানা যায়, পারমিট বন্ধ হওয়ায় প্রতিবছর প্রায় ২৪ কোটি টাকা রাজস্ব হারাচ্ছে সরকার। আবার আধুনিক সভ্যতায় সুন্দরবনের গোলপাতর ব্যবহার প্রায় বিলীন, এসব প্রতিকূলতায় নেছারবাদ সহ দক্ষিণা অঞ্চলের বায়াওলীদের বৃহত্তর জনগোষ্ঠী অর্থনৈতিক ভাবে পঙ্গু হয়ে পড়ছে। ১৯৯৯ সালে মেহগনি, চাম্বল, রেইনট্রি, গামারি, শিমুল, আকাশবেলা, আকাশমনি, কাঠবাদামসহ বিভিন্ন ধরনের ’স্থানীয় গাছ সুন্দরবনের গাছের -’অবস্থা দখল করে নেয়। ২০০৩ সালে সন্ধ্যা নদীর সংলগ্ন স্বরূপকাঠি সরকারি পাইলট মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের খালেরচর, শীতলা খাল,বরছাকাঠি কালিবাড়ি খালচর, বয়ারউলা, ডুবি, চামী, ভাইজোড়া, মাহামুদকাঠি, বিন্না, একতা, নাওয়ারা সহ পর্যক্রমে এসব স্থানে ২৬টি ভাসমান গাছের চরের হাট গড়ে উঠে। নেছারাবাদেও প্রায় সহস্রাধিক শ্রমজীবী মানুষ পরোক্ষ-প্রত্যক্ষভাবে গাছের বাণেজ্যিক ব্যবসার সাথে জড়িয়ে জীবনজীবীকা নির্বাহ করছে। পিরোজপুর জেলা বনশিল্প উন্নয়ন কর্পোরেশন সূত্র তথ্যে“ বরিশাল, খুলনা, চাঁদপুর, বাগেরহাট, মুলাদী, মুন্সীগঞ্জ, যশোর, ঝিনাইদহ, নোয়াখালী ফরিদপুর, বাগেরহাট ও হবিগঞ্জসহ দেশের ৬৪টি জেলার প্রায় তিন কোটি মানুষ এখনো স্বরূপকাঠির এই ভাসমান কাঠের হাটে ব্যবসায় জড়িত থেকে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে কাঠের মোকাম গড়ে তুলছেন”। নদী পথে বিভিন্ন জেলা ও উপজেলা থেকে আসা কাঠ ব্যবসায়ীরা জলদস্যুেদর ভয়ে ২৫-৩০টি নৌকার বহরে একই সঙ্গে স্বরূপকাঠির ভাসমান গাছের মোকামে আসে। বেচাকেনা শেষে, আবার সারিবদ্ধ নৌকাগুলো নদীপথে চলে যায়। স্থানীয় কাঠ ব্যবসায়ী হারুন বলেন, অগ্রহায়ণ ও পৌষ মাসে বিভিন্ন জেলা থেকে আসা গাছ কম দামে কিনে বেশি দামে বিক্রির আশায় খালের চরে -‘প করা হয়। ৩ শতাংশ জায়গার চরভাড়াও গুনতে হয় বছর প্রায় লাখ টাকা। কাঠ ব্যবসায়ী আড়তদার মতিউর রহমান মৃধা বলেন, “সারা বছরই কাঠ ব্যবসার মৌসুম, প্রতি সপ্তাহে বৃহস্পতি ও সোমবার এ দুইদিন গাছ ও কাঠের ভাসমান হাট বসে। হাটে হাজার হাজার ক্রেতা ও বিক্রেতার মিলনমেলা চরের কোটি-কোটি টাকার গাছ বেচাকেনা হয়। স্বরূপকাঠির ভাসমান কাঠের হাট বা চরের হাট থেকেই ট্রাক, ট্রলার, ও কার্গোযোগে, দেশের বিভিন্ন স্থানে সরবরাহ হয়ে থাকে”। বরছাকাঠি কাঠের আড়তদার বৃদ্ধ হাসেম আলী জানান,‘প্রায় ৪১ বছর ধরেই চার ছেলে কাঠ ব্যবসায় জড়িত থেকে তারা স্বাবলম্বী। চরের ভাসমান গাছ ব্যবসায়ীর সেলিম বলে,ব্যবসাটির কারণে অসংখ্য স্ব-মিল ও ফার্নিচার সহ অনেক কাঠের কুঠির শিল্প গড়ে উঠেছে। এবং হাজার হাজার লোকের কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়েছে। ক্ষুদ্রঋণসহ সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা পেলে এ শিল্পকে আধুনিক ভাবে প্রসারিত করা সম্ভব। স্থানীদের অভিযোগ, সরকারের পৃষ্ঠপোষকতার অভাব, কাঠের চরের হাটে রাজনৈতিক প্রভাব, ব্যবসায়ীদের সহজ শর্তে সত্রে ঋণ সুবিধা না পাওয়া, দালালচক্রের উৎপাত, নদীপথে জলদস্যুেদর আক্রমণ, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, পরিকল্পিত বনায়ন তৈরি না হওয়া সহ নানান কারণে ঐতিহ্যবাহী ব্যবসাটি হুমকির মুখে। নৌ-পুলিশ কর্মকর্তা ও নেছারাবাদ থানা ইনচার্জ বনি আমিন বলেন,“ ভাসমান কাঠের হাটে ডাকাতি, ছিনতাই, দালাল চক্রের উৎপাত সহ কোনো ধরনের অপ্রীতিকর ঘটনা না ঘটে সে ধরনের ব্যবস্থা নেয়া আছনেছারবাদ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মোঃ জাহিদুল ইসলাম বলেন, নেছারাবাদ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. জাহিদুল ইসলাম বলেন,“দালালচক্রের উৎপাত, নদীপথে জলদস্যুেদর আক্রমণ, প্রতিরোধে আমাদের নৌ-পুলিশ বাহিনী রয়েছে।