সকালবেলা ঘুম থেকে উঠেই সহকারী শিক্ষক মো. শাহ আলমের প্রথম চিন্তা আজ যমুনা নদীর ঢেউ কেমন হবে? নৌকা কি সময়মতো পাওয়া যাবে? স্রোত কি একটু শান্ত থাকবে? সিরাজগঞ্জের কাজিপুর উপজেলার দুর্গম চরাঞ্চলের ভেটুয়াখোলা বাঁশ জান সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের এই শিক্ষক প্রতিদিন সকাল ৬ টায় ঘর থেকে বের হয়ে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে উত্তাল যমুনা পার হয়ে বিদ্যালয়ে যান, ঘরে ফেরেন সন্ধ্যায়, প্রায়ই হয়ে যায় রাত।
২০২০ সালের ৮ মার্চ থেকে তিনি এখানে কর্মরত। দীর্ঘদিনের ভোগান্তির পর গত বছরের ২০ এপ্রিল বদলির আদেশ হাতে পান তিনি। একই উপজেলার বাড়ির কাছাকাছি পলাশপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রতিস্থাপন সাপেক্ষে বদলির নির্দেশে তার মনে হয়েছিল এবার হয়তো যমুনার ঢেউয়ের দুর্ভোগ শেষ হবে, পরিবারের সঙ্গে কাটবে নিশ্চিন্ত সময়। কিন্তু বাস্তবে সেই স্বপ্ন এখনো অধরা। প্রতিস্থাপকের অভাবে তিনি আজও ছাড়পত্র পাননি। বদলির আদেশ হাতে পেয়েও নতুন কর্মস্থলে যোগ দিতে পারছেন না।
শুধু শাহ আলমই নন এভাবে শত শত শিক্ষক দুর্বিসহ জীবনযাপন করছেন। সূত্র বলছে, সম্প্রতি আদেশসহ ২০২৪ ও ২০২৫ সালে বিভাগ, জেলা, উপজেলাসহ যেসব বদলী অনলাইন আদেশ হয়েছে তার মধ্যে শত শত শিক্ষক প্রতিস্থাপন শর্ত বদলীর আদেশ পেয়েছেন। এমন আদেশে দেশের সব জেলাতেই আটকে আছেন শিক্ষকরা। কাজিপুরসহ সিরাজগঞ্জ জেলায় প্রায় ৬০ জন শিক্ষক প্রতিস্থাপন সাপেক্ষে বদলির আদেশ পেয়েও আটকে আছেন। এ চিত্র শুধু সিরাজগঞ্জেই সীমাবদ্ধ নয়। তথ্য অনুযায়ী বদলী আদেশে হবিগঞ্জ জেলায় ৪৬ জনের মধ্যে ২১ জন, সিলেটে ৬৪ জনের মধ্যে ২৫ জন, পটুয়াখালীতে ৪৬ জনের মধ্যে ১৪ জন, মৌলভীবাজারে ৬০ জনের মধ্যে ২২ জন, ময়মনসিংহে ৫০ জনের মধ্যে ১০ জন, চট্টগ্রামে ৭৩ জনের মধ্যে ১১ জন, রংপুরে ৫৯ জনের মধ্যে ১৭ জন, চরফ্যাশনে ৩৫ জনের মধ্যে ১৯ জন, ভোলার মনপুরায় ৫ জনের মধ্যে ২ জন, নড়াইলে ১৮ জনের মধ্যে ৮ জন, ঠাকুরগাঁওয়ে ৫৯ জনের মধ্যে ১৭ জন, নাটোরে ৪২ জনের মধ্যে ১১ জন এবং কিশোরগঞ্জে ৫১ জনের মধ্যে ১১ জন শিক্ষক একই সমস্যায় রয়েছেন।
শিক্ষকরা বলছেন, ২০২৩ সালের আদেশ বাস্তবায়নের মাধ্যমে অনেকের ভোগান্তি দূর হয়েছিল। তাই তারা অনুরোধ জানাচ্ছেন মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে এবছরও যেন প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর একই ধরনের উদ্যোগ গ্রহণ করে এবং দ্রুত অবমুক্তির ব্যবস্থা নেয়। অধিদপ্তর বলছে, বিদ্যালয়ের স্বার্থ উর্দ্ধে রেখে শিক্ষকদের সমস্যা সমাধানে আন্তরিক প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর।
ভুক্তভোগী শিক্ষকরা জানিয়েছেন, প্রতিস্থাপনের শর্তের কারণে দীর্ঘদিন তারা নতুন কর্মস্থলে যোগ দিতে পারছেন না। এর ফলে শুধু ব্যক্তিগত জীবনই নয়, বিদ্যালয়ের শিক্ষাকার্যক্রমও ব্যাহত হচ্ছে। তাঁদের মতে, যেখানে শিক্ষার্থী সংখ্যা কম, সেখানে চার জনের মধ্যে একজন বদলীকৃত শিক্ষককে ছাড় দেওয়া যেতে পারে। আর যেখানে শিক্ষার্থী সংখ্যা বেশি, সেখানে নিকটবর্তী বিদ্যালয় থেকে শিক্ষক ডেপুটেশনের মাধ্যমে শিক্ষক সংকট মোকাবিলা করে ভুক্তভোগী শিক্ষককে নতুন কর্মস্থলে যোগদানের সুযোগ দেওয়া যেতে পারে। শিক্ষকেরা আশা করছেন, কর্তৃপক্ষ যদি মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিষয়টি বিবেচনা করেন, তবে এটি সহজেই সমাধানযোগ্য।
ভেটুয়াখোলা বাঁশ জান সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে মোট শিক্ষক পদ ৫টি। বর্তমানে শাহ আলমসহ কর্মরত আছেন ৪ জন শিক্ষক। মাসিক রিটার্ন অনুযায়ী শিক্ষার্থী সংখ্যা মাত্র ৫৫ জন। অর্থাৎ শাহ আলম অন্যত্র বদলি হলেও বিদ্যালয়ে শিক্ষক শূন্য হওয়ার কোনো আশঙ্কা নেই। তবুও বদলী নীতিমালার শর্তে প্রতিস্থাপকের অভাবে তিনি অবমুক্ত হচ্ছেন না। ব্যথাভরা কণ্ঠে শাহ আলম বলেন, ুমনে করেছিলাম বদলির আদেশ পেয়ে যমুনার ঢেউয়ের ভয়ে আর ভুগতে হবে না। কিন্তু আজও আমি পুরনো বিদ্যালয়ে আটকে আছি। দিন দিন মানসিকভাবে ভেঙে পড়ছি।”তার স্ত্রী অভিমানে বলেন, ুপ্রতিদিন ভয়ে থাক্তিযমুনা পার হতে গিয়ে যদি কোনো দুর্ঘটনা ঘটে!”
নোয়াখালীর সোনাইমুড়ী উপজেলার শিক্ষক আজিজ বলেন, ২০২০ সালের শুরুতে বাড়ী থেকে দূরের একটি বিদ্যালয়ে যোগদান করি। দীর্ঘ অপেক্ষার পর ২০২৪ সালে অনলাইনে আবেদন করে প্রতিস্থাপনের বদলীর আদেশ পেয়েছি, শিক্ষক সংকট থাকায় ছাড়পত্র পাইনি। তিনি বলেন, পার্শ্ববর্তী বিদ্যালয় থেকে ডেপুটেশনের ব্যবস্থা করলে হয়তো আমি দীর্ঘদিনের দুর্ভোগ থেকে মুক্তি পেতাম। একই অবস্থা পুতুল রানী মোদকের। বর্ষা মৌসুমে বিদ্যালয়ে প্রায় দেড় কিলোমিটার হেটে যেতে হয় দুর্গম এলাকার বিদ্যালয়ে। বাড়ীর নিকটবর্তী প্রতিস্থঅপন বদলী আদেশ পেয়েও দুর্ভোগ কাটেনি।
শিক্ষক হাবিবা সুলতানা বলেন, ২০২৩ সালের ২৪ জানুয়ারি থেকে মামুদনগর একটি সরকারি প্রাথমিক.বিদ্যালয়ে কর্মরত। ৯৬ জন শিক্ষার্থীর বিপরীতে আছি ৪জন শিক্ষক। দীর্ঘদিনের ভোগান্তির পর গত ২৫ মে ২০২৫ তারিখে বদলির আদেশ পাই স্বামীর ঠিকানার কাছাকাছি প্রতিস্থাপন স্বাপেক্ষে বদলী আদেশ পেয়েও যেতে পারছি না শিক্ষক সংকট থাকায়। পারিবারিক অশান্তিসহ নানাবিধ জটিলতা তৈরি হচ্ছে আমার জীবনে। শশুরবাড়ি আর বাবার বাড়ির দূরত্ব প্রায় ২শত কিলোমিটার। ফটিকছড়ি থেকে রামু। স্বামীর কর্মস্থল কক্সবাজার। ছোট একটা বাচ্চা আছে। স্বামী একা থাকতে হয়। দূরত্ব বেশি হওয়াতে ছোট বাবু নিয়ে আসা যাওয়া করা যায় না। চা বাগানের ভিতরে মাটির রাস্তা দিয়ে যেতে হয় তিন কিলোমিটার। বদলির আদেশ পেলাম তাও প্রতিস্থাপন সাপেক্ষে বলেন রিফাত কানিজ নামে এক শিক্ষক। আরেকজন শিক্ষক বলেন ১২ বছর যাবত হাওর এলাকার স্কুলে আছি, অনেক চেষ্টার পর আদেশ পেয়েছি সেটিও প্রতিস্থাপন। এখানে কোনদিন প্রতিস্থাপক হিসেবে শিক্ষক আসবে কিনা জানিনা।
প্রতিস্থাপন বদলী আদেশ পাওয়া শিক্ষকদের সমস্যা সমাধানে ২০২৩ সালে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর একটি গুরুত্বপূর্ণ আদেশ দিয়েছিল। আদেশে উল্লেখ ছিল, বদলি নির্দেশিকার অনুচ্ছেদ ৩.৪ অনুযায়ী, দুই শিফট বিশিষ্ট বিদ্যালয়ের যে কোনো এক শিফটের শিক্ষার্থী (১ম ও ২য় অথবা ৩য় হতে ৫ম শ্রেণি পর্যন্ত) সংখ্যার মধ্যে যে সংখ্যা বেশি হবে, তা ১:৪০ অনুপাতে বিবেচনায় নিয়ে প্রতিস্থাপন সাপেক্ষে বদলির আদেশপ্রাপ্ত শিক্ষকদের অবমুক্ত করতে হবে, যাতে তারা বদলিকৃত বিদ্যালয়ে যোগদান করতে পারেন। এছাড়া, যে সকল বিদ্যালয়ে ৪ (চার) জন বা তার কম শিক্ষক কর্মরত আছেন, সে সব বিদ্যালয়ের কোনো শিক্ষক যদি প্রতিস্থাপন সাপেক্ষে বদলির আদেশ পান, তবে উক্ত বিদ্যালয়ে সংযুক্তি প্রদানযোগ্য বিদ্যালয় থেকে শিক্ষক সংযুক্তির ব্যবস্থা করে, বদলির আদেশপ্রাপ্ত শিক্ষককে দ্রুত অবমুক্ত করার নির্দেশনা ছিল।
এ বিষয়ে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক আবু নূর মো. শামসুজ্জামান বলেন, শিক্ষক বদলির ক্ষেত্রে আমরা প্রতিস্থাপন নীতিকে গুরুত্ব দিচ্ছি যাতে কোনো বিদ্যালয়ে শিক্ষক সংকট না তৈরি হয়। আবার শিক্ষক যেন তার পরিবারের কাছে থাকতে পারে। তবে অনেক ক্ষেত্রে প্রতিস্থাপক শিক্ষক যোগদানে দেরি হওয়ায় কিছু শিক্ষক সমস্যায় পড়ছেন এটা ঠিক। শ্রেণিপাঠদান নিশ্চিত শিক্ষকদের সমস্যা সমাধানে করনীয় থাকে তাহলে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর অবশ্যই ইতিবাচক সিদ্ধান্ত নিবে। কোথাও শিক্ষার্থী সংখ্যা কম থাকলে বা পার্শ্ববর্তী বিদ্যালয় থেকে শিক্ষক ডেপুটেশনের মাধ্যমে সমন্বয় করার বিষয়টি চিন্তা করা হবে।
শাহ আলম, আজিজ, হাবিবা সুলতানার মতো শত শত ভুক্তভোগী শিক্ষকরা প্রতিদিন ঝুঁকিপূর্ণ পথে বিদ্যালয়ে যাচ্ছেন। পরিবার থেকে রয়েছেন বিচ্ছিন্ন। নদীর ঢেউ, দুর্গম পথ, দীর্ঘ সময়ের অপেক্ষাসবই তাদের জীবনকে কষ্টের মধ্যে ফেলেছে। বদলির আদেশ পেলেও মুক্তি নেই, পরিবার থেকে দূরে থাকতে হয়, এবং শিক্ষার্থীদের পড়াশোনা চালিয়ে যেতে হয় অনিশ্চয়তার স্রোতে ভেসে। প্রতিটি দিন তাদের জন্য এক নতুন চ্যালেঞ্জ, প্রতিটি রাতেই থাকে উদ্বেগ ও অশান্তি। শিক্ষকরা শুধু নিজের জন্য নয়, দেশের শিক্ষার্থীর ভবিষ্যতের জন্যও লড়াই করছেন.