যথাযথ প্রক্রিয়া ও নিয়ম মেনে পার্বত্যাঞ্চলের বাজারফান্ড জায়গা বন্দোবস্তি নিয়েছে এ অঞ্চলের শত শত মানুষ। কিন্তু জেলা প্রশাসকের একটি চিঠির আদেশে এই জায়াগাগুলোর বন্ধকী ব্যবস্থা বন্ধ রয়েছে বিগত ৬ বছর ধরে। ফলে এখানকার বাসিন্দারা বাজার ফান্ডের জায়গার প্রকৃত সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। প্রশ্ন ওঠেছে লাখ লাখ টাকা ব্যয় বন্দোবস্তি নেয়াসহ নানা স্থাপনা তৈরী করে দোকান-পাট গড়ে ব্যবসা চালিয়ে আসছে এ অঞ্চলের বাসিন্দারা কয়েকযুগ ধরে। তাহলে ভূমির মালিক হয়েও সরকারি সুযোগ গ্রহণ করতে না পারার ক্ষোভ বাড়ছে।
একটি নির্ভরযোগ্য সূত্র মতে ২০১৯ সালের ১৪ অক্টোবর খাগড়াছড়ির পতিত সরকারের তৎকালীন জেলা প্রশাসক প্রতাপ চন্দ্র বিশ্বাস কর্তৃক খাগড়াছড়ি বাজারফান্ডের খাস জমি নিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিবের কাছে লেখা এক চিঠির প্রেক্ষিতে পার্বত্য চট্টগ্রামের ব্যবসা বাণিজ্যের প্রাণ ‘বাজার ফান্ড’র হাত ধরে বন্ধকী ঋণ কার্যক্রম বন্ধ করেছে তিন জেলার প্রশাসন। এ আদেশের কারণে ব্যাংকগুলো এসব ভূমি মালিকদের ঋণ সুবিধা দিচ্ছে না। কোনো ধরনের সরকারি নিষেধ না থাকলেও আমলাতান্ত্রিক প্যাঁচে ৬বছর ধরে বন্ধ রয়েছে এ কার্যক্রম। শত বছর ধরে চালু থাকা এ ঋণ না পেয়ে ব্যবসা বাণিজ্য লাটে উঠেছে প্রায় ৪০ হাজার ব্যবসায়ীর। ইতোমধ্যেই অর্থাভাবে ব্যবসা বানিজ্য বন্ধ করে এ এলাকা থেকে চলে গেলে কয়েকশো ব্যবসায়ী-ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তা।
জানা গেছে, ১৯৩৭ সালের বাজার ফান্ড ম্যানুয়েল অনুযায়ী পরিচালিত হয়। পার্বত্য চট্টগ্রামের অর্থনীতির ভীত মজবুত করতে নতুন বাজার ও ব্যবসায়ী সৃষ্টি এবং বাজার ব্যবস্থাপনার অংশ হিসেবে এ ফান্ড কাজ করছে। এ ফান্ডের হাত ধরে ব্যবসায়ীরা সংশ্লিষ্ট ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে তাদের ব্যবসা বাণিজ্য পরিচালনা করেন। ১৯৮৯ সালে পার্বত্য তিন জেলায় স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা চালুর আগ পর্যন্ত এ বাজার ফান্ডের প্রশাসক হিসেবে দায়িত্বে ছিলেন সংশ্লিষ্ট জেলা প্রশাসকগণ।
এরপর আইন অনুযায়ী বাজার ফান্ড পার্বত্য জেলা পরিষদের উপর ন্যস্ত হওয়ায় পরিষদের চেয়ারম্যান এ ফান্ডের প্রশাসক হিসেবে দায়িত্ব পান। এরপর থেকেই তিন জেলার বাজার ব্যবস্থাপনা জেলা পরিষদের তদারকিতেই চলে আসছিল।
সম্প্রতি খাগড়াছড়ি ২৯৮নং আসনের সাবেক সংসদ সদস্য ও পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ডের সাবেক চেয়ারম্যান ওয়াদুদ ভূইয়া পার্বত্যাঞ্চলের বাজারফান্ড জায়গায় জেলা প্রশাসকদের অবৈধ হস্তক্ষেপের জবাব চেয়েছেন। রাঙামাটি চেম্বার অব কমার্স এন্ড ইন্ড্রাস্টিজ মিলনায়তনে পার্বত্য চট্টগ্রাম সমঅধিকার আন্দোলন রাঙামাটি জেলা শাখার প্রতিনিধি সম্মেলনে ভার্চুয়ালী যুক্ত হয়ে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি বলেছেন, পাহাড়ের (রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি, বান্দরবান) বাজারফান্ড জায়গা কোন আইনে জেলা প্রশাসকরা জায়গা বন্ধকী বন্ধ রেখেছে সেটা এখানকার বাসিন্দাদের কাছে জবাবদিহি করতে হবে।
সাবেক এই এমপি আরও বলেন, আমাদের শহরকেন্দ্রীক দামি জায়গাগুলো হলো বাজারফান্ডের জায়গা। জেলা প্রশাসকরা অনৈতিকভাবে এ জায়গাগুলোর বন্ধকী বন্ধ করে দেওয়ায় ব্যবসায়ীরা ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে, ঋণ সুবিধা পাচ্ছেন না। আর জায়গার বিনিময়ে ঋণ সুবিধা না পাওয়া মানে আমরা এ এলাকার অধিবাসী না। অথচ এই জায়গাগুলোতে আমরা যুগের পর যুগ বসবাস করে আসছি। কিন্তু জেলা প্রশাসকরা মৌখিক আদেশে জায়গাগুলোর কার্যক্রম বন্ধ রেখেছেন। তারা এ বন্দোবস্তি জায়গা থেকে আমাদের উৎখাতের সূদর প্রসারী ষড়যন্ত্র করছেন। তিনি সমঅধিকারের নেতা-কর্মীদের উদ্দেশ্যে বলেন, আপনারা জেলা প্রশাসকদের বিরুদ্ধে মানববন্ধন করুন, আন্দোলন করুন। তারা কোন উদ্দেশে, কোন আইনে, কিসের ক্ষমতা বলে বাজারফান্ডের জায়গা বন্ধকী কার্যক্রম বন্ধ রেখেছেন সেটা জানতে চান। তবে তাদের সেই আদেশ আপনারা মানবেন না। আপনারা সজাগ থাকবেন, একতাবদ্ধ থাকবেন। আপনারা শক্ত থাকলে তাদের এমন ষড়যন্ত্র কোনো কাজে আসবে না।
ওয়াদুদ ভূইয়া বলেন, এক সময় পার্বত্যাঞ্চলের (রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি, বান্দরবান) জেলা পরিষদগুলোতে শিক্ষকসহ অন্যান্য নিয়োগে পাহাড়িরা ৩০ভাগ কোটা সুবিধা পেতো। কোটার কারণে মেধাহীন শিক্ষক, কর্মচারী আমরা পেয়েছি। অপরদিকে এখানে বসবাসরত বাঙালীরা চরমভাবে বৈষম্যর শিকার হয়ে আসছিলো। যে কারণে সমঅধিকারের নেতৃবৃন্দ এ ব্যাপারে হাইকোর্টে রিট করলে মহামান্য হাইকোর্ট পার্বত্যাঞ্চলের পাহাড়িদের জন্য এক ভাগ কোটা সুবিধা রাখার পক্ষে রুল জারি করেন। জেলা পরিষদগুলো যদি তাদের পুরনো নিয়মে নিয়োগ কার্যক্রম পরিচালনা করে তাহলে আপনারা হাইকোর্টের রায়টি দেখাবেন এবং প্রতিবাদ জানাবেন।
এদিকে পার্বত্য চট্টগ্রামে বাজার ফান্ডের ঋণ-বন্দোবস্তি প্রক্রিয়া চালু না করলে আন্দোলনের হুশিয়ারি দিয়েছে “বাজার ফান্ড ভূমি অধিকার সংরক্ষণ কমিটি”। কোনো ধরনের কোন ধরনের সরকারি নিষেধ না থাকলেও আমলাতান্ত্রিক প্যাঁচে ৬ বছর ধরে পার্বত্যাঞ্চলের বাজার ফান্ড এলাকায় বন্ধ থাকা ঋণ কার্যক্রম চালু করাসহ বাজার ফান্ডের বন্দোবস্তি প্রক্রিয়া চালুর দাবিতে গঠিত “বাজার ফান্ড ভূমি অধিকার সংরক্ষণ কমিটি”র নেতৃবৃন্দ রাঙামাটি জেলা প্রশাসকের সাথে সাক্ষাৎ করে অবিলম্বে রাঙামাটিসহ তিন পার্বত্য জেলায় অঘোষিত নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের দাবি জানিয়েছেন।
রাঙামাটি জাতীয়তাবাদী আইনজীবি সমিতির সভাপতি এ্যাডভোকেট সাইফুল ইসলাম পনির ও জেলা বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক সাইফুল ইসলাস শাকিলের নেতৃত্বে “বাজার ফান্ড ভূমি অধিকার সংরক্ষণ কমিটি”র নেতৃবৃন্দ রাঙামাটি জেলা প্রশাসক মো: হাবিব উল্লাহ মারূফ এর সাথে বৈঠক করে ৬ বছর ধরে পার্বত্যাঞ্চলের বাজার ফান্ড এলাকায় বন্ধ থাকা ঋণ কার্যক্রম চালু করাসহ বাজার ফান্ডের বন্দোবহিম প্রক্রিয়া অবিলম্বে চালুর দাবি জানান।
এসময় জেলা প্রশাসক বাজার ফান্ড ভূমি অধিকার সংরক্ষণ কমিটির নেতৃবৃন্দকে জানান, আমি আপনাদের দাবির বিষয়টি আমার বিভাগীয় কমিশনারকে অবহিত করেছি এবং এই বিষয়ে আজ-কালের মধ্যেই রাঙামাটি জেলা প্রশাসকের পক্ষ থেকে লিখিত প্রতিবেদন পাঠানো হবে।
খাগড়াছড়ি জেলা যুবদলের সভাপতি মাহবুবুল আলম সবুজ বলেন, অবিলম্বে তিন পার্বত্য জেলায় পতিত সরকারের প্রতিনিধি র্কর্তৃক কোনো ধরনের লিখিত নির্দেশনা ছাড়াই শুধুমাত্র মৌখিক নিষেধাজ্ঞায় প্রায় ৬ বছর ধরে বন্ধ থাকায় ঋণ কার্যক্রম ও বন্দোবস্তি প্রক্রিয়া চালু করার দাবি জানান। তা না হলে পাহাড়ের সকল বাসিন্দাদের নিয়ে রাজপথে আন্দোলনে নামবে। এ অঞ্চলের মানুষ মনে করে এই জটিলাতর দ্রুত নিরসন হোক। চালু করা হোক পাহাড়ের বাজার ফান্ডের জায়গার বন্ধকী কার্যক্রম।