ঝিনাইদহ কালীগঞ্জের মোবারকগঞ্জ চিনিকলটি ৪২ বছর ধোরে একাধারে প্রতি বছর লোকসানের বোঝা মাথায় নিয়ে চালিয়ে যাচ্ছে। বিশেষ করে বিগত সরকারের আমলে স্থানীয় এমপি আনোয়ারুল আজীম আনার ও সিবিএ নেতাদের অবৈধ নিয়োগ বাজ্যি নিম্নমানের মালামাল ক্রয়সহ প্রতিটি বিভাগে অনিয়ম দূনীতি কারনে চিনিকলটি লাভের মুখ থেকে মুখ থুবড়ে পড়ছে। প্রতি বছর মাড়াই মৌসুমের আগেই কর্মকর্তারা বলেন এ বছর লাভ হবে কিন্তু মাড়াই শেষে দেখা যায় মোটা অংকের টাকা লোকসান বোঝা। গত বছর ২০২৩-২৪ অর্থবছরে প্রতি কেজি চিনিতে ৪১৭ টাকা লোকসান দিয়েছে মিলটি। গত মাড়াই মৌসুমে সরকারী ভ্যাট ও ব্যংকের সুদ দিয়ে মিলটির প্রতি কেজি চিনি উৎপাদন ব্যয় ছিল ৫৪২ টাকা। মাড়াই মৌসুমে চিনি আহরণের হার ছিল সর্বকালের নিচে এবং নিম্নমানের যন্ত্রাংশের কারনে ১৮ থেকে ২৪ ঘন্টা পর্যন্ত যান্ত্রিক ত্রুটির কারনে ১২৩ মিলের মাড়াই বন্ধ ছিল। গেল বছরে ২৫০০ মেট্রিক টন চিনি উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা থাকলেও অর্জিত হয়েছিল ১৮৭১ মেট্রিক টন। এছাড়া মিলটিতে অপারেশনাল লস হয়েছে ৩৪ কোটি ও ব্যাংক ঋণের সুদ দিয়েছে ৩৬ কোটি টাকা। সব মিলিয়ে ৭০ কোটি টাকা লোকসানের বোঝা আর ৩৫০ কোটি টাকা ব্যাংকের দেনা রয়েছে।চলতি বছর ১৩ ডিসেম্বর ৫৮ তম মাড়াই মৌসুম শুর করেছে। মোবারকগঞ্জ চিনিকলটি ঝিনাইদহের কালীগঞ্জ শহর সংলগ্ন এলাকায় ১৯৬৫ সালে ৩ কোটি ৪৮ লাখ টাকা ব্যয়ে ২০৭ দশমিক ৯৩ একর নিজস্ব জমির ওপর নেদারল্যান্ডস সরকারের সহযোগিতায় মোবারকগঞ্জ চিনিকলটি প্রতিষ্ঠা করা হয়। তন্মধ্যে ২০ দশমিক ৬২ একর জমিতে কারখানা, ৩৮ দশমিক ২২ একর জমিতে কর্মকর্তা ও শ্রমিক-কর্মচারীদের আবাসিক কলোনি, ২৩ দশমিক ৯৮ একর পুকুর, ১০৭ একর জমিতে ইক্ষু খামার ও ১৮ দশমিক ১২ একর জমিতে রয়েছে সাবজোন অফিস ও আখ ক্রয় কেন্দ্র। ঝিনাইদহের ৬ উপজেলা ছাড়াও যশোরের দুটি উপজেলা নিয়ে গঠিত মিলে ৮টি সাবজোন অফিস ও ১৮ দশমিক ১২ একর জমি জুড়ে রয়েছে সাবজোন অফিস ও আখ ক্রয় কেন্দ্র। বর্তমানে মোবারকগঞ্জ চিনিকরে অধিনে ৪৮টি আখ ক্রয় কেন্দ্রের আওতায় চাষযোগ্য জমির পরিমাণ রয়েছে ৩ লাখ একর। চলতি মাড়াই মৌসুমে ৭০ হাজার মেট্রিক টন আখ মাড়াই করে ৩ হাজার ৯২০ মেট্রিক টন চিনি উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। চিনি আহরণের হার নির্ধারন করা হয়েছে ৫.৬%। ২০২৩-২৪ মাড়াই মৌমুমে প্রতি কেজি চিনি উৎপাদন করতে ব্যয় হয়েছে ৩৪৯ টাকা ৫০ পয়সা। ২০১৯-২০ মাড়াই মৌসুমে মিলটির লোকসান গুনতে হয় ৯৭ কোটি ২৪ লাখ টাকা। মোট লোকসানের মধ্যে ব্যাংক সুদ পরিশোধ করতে খরচ হয় ৪৯ কোটি টাকা। এর আগে ২০১৮-১৯ মাড়াই মৌসুমে মিলটিকে এক কেজি চিনি উৎপাদন করতে ব্যাংক সুদ দিতে হয়েছিল ৭৮.১১ টাকা। ওই বছর মিলটি এক কেজি চিনি উৎপাদন করতে সুদ বাদে খরচ হয় ১৩৩.০৩ টাকা আর সুদসহ উৎপাদন ব্যয় হয় ২১১.১৪ টাকা। ২১১ টাকায় উৎপাদিত চিনি বাজারে বিক্রি হয়েছিল প্রতি কেজি ৫৫ টাকায়। এভাবেই চলছে মোবারকগঞ্জ সুগার মিল। ২০১৯-২০ মাড়াই মৌসুম শেষে মিলটির ব্যাক ঋণ দাঁড়ায় ৩৪৭ কোটি ৯৯ লাখ টাকা। ২০১৮-২০১৯ মৌসুমে মিলটির লোকসান গুনতে হয় ৭৭ কোটি ৬৯ লাখ ৫৫ হাজার টাকা। ২০১৭-২০১৮ মাড়াই মৌসুমে উৎপাদন খরচ ছিল ১৮৯.১৩ টাকা। ২০১৬-২০১৭ মৌসুমে তা বেড়ে হয় ১৭৪.২৪ টাকা। তার আগের মৌসুম ২০১৫-২০১৬ প্রতি কেজি চিনির উৎপাদন ব্যয় হয়েছিল ১৭৬.৪০ টাকা। এই চিনি উৎপাদনে ব্যাংক ঋণের সূদ দিতে হয়েছিল যথাক্রমে ৫৭.৯৩, ৫০.০৬ এবং ৩৩.২৯ টাকা। বছর গুলোতে চিনির কেজি প্রতি বিক্রয় মূল্য ছিল ৫০, ৪৭ ও ৪৫ টাকা। ২০১৭-২০১৮ মাড়াই মৌসুমে ৭০ কোটি ২৮ লাখ ২২ হাজার টাকা এবং ২০১৬-২০১৭ মৌসুমে লোকসান হয় ৩৫ কোটি ৫৫ লাখ ৯৭ হাজার টাকা। সর্বশেষ ২০০৫-২০০৬ মাড়াই মৌসুমে লাভ হয় ৫ কোটি ৮৬ লাখ ৭৬ হাজার টাকা। এছাড়া আখের জাতের কারণে এই লোকসান বাড়ছে অন্যদিকে, চিনি উৎপাদনের সঙ্গে বিভিন্ন পর্যায়ের শ্রমিক মজুরি খরচ, আখ ক্রয়, মিলে অপরিষ্কার আখ সরবরাহ, রস ধারণ ক্ষমতার অতিরিক্ত দৈনিক আখ মাড়াই, পরিবহণ খরচ, কারখানা মেরামত এবং বয়লারের জ্বালানিসহ প্রায় অর্ধশতাধিক খাতের খরচ মিটিয়ে প্রতি বছরই বাড়ছে চিনি উৎপাদন খরচের এই অংক সে তুলনায় বাড়েনি চিনির বিক্রয় মূল্য।চিনির উৎপাদন ব্যায় নিশ্চত করে মোচিকের জিএম (ফাইন্যান্স) জানান, চলতি মাড়াই মৌসুমে ৭০ হাজার মেট্রিক টন আখ মাড়াই করে ৩ হাজার ৯২০ মেট্রিক টন চিনি উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। চিনি আহরণের হার নির্ধারন করা হয়েছে ৫.৬%। তিনি বলেন, ২০২৩-২৪ মাড়াই মৌমুমে প্রতি কেজি চিনি উৎপাদন করতে ব্যায় হয়েছে ৩৪৯ টাকা ৫০ পয়সা। তবে কর্মচারীদের বেতন ভাতা, সরকারের ভ্যাট আইটি ও ব্যাংকের সুদ যোগ করলে উৎপাদন ব্যায় আরো বেশি হবে। ধারাবাহিক লোকসানের কারণ ব্যাখা করে তিনি বলেন, ১৯৬৫ সালে স্থাপিত সেই পুরানো যন্ত্রপাতি দিয়ে চিনি উৎপাদন করা হচ্ছে। মিলটিতে কোন আধুনিকতার ছোঁয়া লাগেনি। মোবারকগঞ্জ চিনিকল অব্যাহত লোকসানের শিকার হয়ে এখন বন্ধের উপক্রম হয়েছে।মিলটিতে বরাবরই আয়ের চেয়ে ব্যয় দেখানো হয়েছে অনেক বেশী। ফলে এখন দেনার দায়ে জর্জরিত অবস্থা প্রতিষ্টানটির।বিভিন্ন সেক্টরে সীমাহীন দুর্নীতি এবং অব্যবস্থাপনাই এর প্রধান কারণ।মোচিক জোনের আওতায় রয়েছে আরো ৮টি সাবজোন।এগুলো হলো কালীগঞ্জ মিলগেট-১,মিলগেট-২,ঝিনাইদহ সাবজোন,কোটচাঁদপুর সাবজোন,খালিশপুর সাবজোন,হরিণাকুন্ডুু সাবজোন, যশোর সাবজোন ও চৌগাছা সাবজোন। অনিয়ম দুর্নীতি, দক্ষ কর্মকর্তা ও কর্মচারির অভাব, নিম্নমানের সরঞ্জাম ক্রয়, কর্মচারিদের কাজে ফাঁকি, জোনের বাইরের আখ ক্রয়, কৃষকের কাছ থেকে আখ নিয়ে দুই-তিন দিন সেন্টারে খোলা আকাশের নিচে ফেলে রাখায় শুকিয়ে ওজন ও রস কমে যাওয়া।অনিয়ম দুর্নীতি, দক্ষ কর্মকর্তা ও কর্মচারির অভাব, নিম্নমানের সরঞ্জাম ক্রয়, কর্মচারিদের কাজে ফাঁকি, জোনের বাইরের আখ ক্রয়, কৃষকের কাছ থেকে আখ নিয়ে দুই-তিন দিন সেন্টারে খোলা আকাশের নিচে ফেলে রাখায় শুকিয়ে ওজন ও রস কমে যাওয়া।অদক্ষ শ্রমিক ও নিম্নমানের যন্ত্রাংশে চিনি রিকোভারি কম হওয়াসহ একাধিক কারণে দিনে দিনে লোকসানে পড়ছে মোচিক। এর মধ্যে সব থেকে বড় কারণটি হল পর্যাপ্ত আখ উৎপাদন না হওয়া। ১৯৮৩/৮৪ মাড়াই মৌসুমে ১৭ হাজার একর পরিমান জমিতে আখ চাষ করে মোচিক সাড়ে ৫ কোটি টাকার বেশী লাভ করেছিল। সে হিসাবে লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী ৬০ হাজার একর জমিতে আখ উৎপাদন সম্ভব হলে প্রতি বছর অন্তত ৪০ কোটি টাকা লাভ হবে।উৎপাদন ব্যয়ের তুলনায় চিনির বিক্রয় মূল্য কম নির্ধারণ, চিনিকল জোন এলাকায় লাগামহীন গুড় উৎপাদনের কারণে মিলে প্রয়োজনীয় আখ সরবরাহের অভাব,অতীতে মিলে অতিরিক্ত কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগ, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের অভার টাইমের ঘাপলা, কৃষকদের মধ্যে পুঁজি বিতরণে অনিয়ম-দুর্নীতি, আখ বিক্রির টাকা পরিশোধে গড়িমসি।ফলে আখ চাষের জমির পরিমাণ কমে গেছে। প্রয়োজনীয় আখের অভাবে চিনিকল ক্রমাগত লোকসানের মুখে পড়ছে। মহাব্যবস্থাপক (কৃষি) গৌতম কুমার জানান, নিচু জমিতে উৎপাদিত আখে চিনির উৎপাদন হার কম হয়। তাছাড়া মাড়াই মৌসুম শুরু হলে এক শ্রেনির আখ চাষীর ওজন বৃদ্ধি করার জন্য জমিতে সেচ ও সার প্রয়োগ করেন। ফলে চিনি উৎপাদন হার কমে যায়। মোচিক এালাকার কৃষকদের অভিযোগ, মিলের কর্মকর্তা ও সিবিএ নেতাদের লাগামহীন দূনীতি, কর্তব্য অবহেলা ও অদক্ষতার কারণে মিলটির ঐতিহ্য হারাচ্ছে। এছাড়া বিগত সরকারের আমলে অতিরিক্ত অদক্ষ জনবল নিয়োগের ফলে মিলকে প্রতি বছর বেতন ভাতা বাবদ মোটা অংকের টাকা গুনতে হয়েছে।