কালীগঞ্জে তিন শিবির নেতাকে বিচারবহিরভুত ভাবে গুলি করে হত্যা

এফএনএস (টিপু সুলতান; কালীগঞ্জ, ঝিনাইদহ) : | প্রকাশ: ২৯ আগস্ট, ২০২৫, ১১:৫৩ এএম
কালীগঞ্জে তিন শিবির নেতাকে বিচারবহিরভুত ভাবে গুলি করে হত্যা

আওয়ামীলীগ সরকারের আমলে ইসলামি ছাত্র শিবিরের তিন জনকে বিচারবহির্ভূত হত্যা করা হয়েছে। ২০১৬ সালের পুলিশের কথিত ক্রসফায়ারে প্রান হারান তিন জন। প্রকাশ্য দিবালোকে পুলিশ বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে যায়। পুলিশ তখন দাবি করেছিল কথিত বন্দুকযুদ্ধে পাল্টা গুলিতে নাকি তাদের মৃত্যু হয় আবার এমন ও বলেছিল কিভাবে তারা মারা গেছে পুলিশ তা জানে না। ফ্যাসিস শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকারের সময় এমন ‘বন্দুকযুদ্ধ’ বা ক্রসফায়ারের নামে ৩ জনের বিচারবহির্ভূত হত্যার ঘটনা ঘটেছে। এই ঘটনা গুলো বিচারবহির্ভূত হত্যাকান্ড বলে গণ্য হলেও ফ্যাসিস শেখ হাসিনা সরকার ও প্রশাসন বরাবরই তা অস্বীকার করে এসেছে। 

ঝিনাইদহ কালীগঞ্জের সংশ্লিষ্ট আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ক্রসফায়ারের সাজানো গল্প বলে মামলা করে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই ভুক্তভোগী পরিবার মামলা করার সাহস ছিল না। কেউ কেউ আদালতে মামলা করার চেষ্টা করলে হয়রানি ও হুমকির শিকার হয়েছিল।ক্রসফায়ারের লক্ষবস্তুু শুরুতে ছিলেন শীর্ষ অপরাধী বা দুর্র্ধষ সন্ত্রাসীরা। পরে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও ব্যক্তিগত বিরোধের কারণে এবং কালীগঞ্জের প্রভাবশালিদের ইন্ধনে তিন শিবির নেতাকে পরিকল্পিত ভাবে গুলি করে হত্যা করা হয়। পরিবারের সদস্যরা ৩ জনের ছবি দেখে প্রতিদিন কান্নাকাটি করে।২০১৬ সালে, ঝিনাইদহে বিচার বর্হিভুত হত্যার বিভিষিকা নেমে আসে। সালটা জুড়েই গোটা জেলা যেন মৃত্যু উপত্যাকায় পরিণত হয়। যৌথ বাহিনী ও ডিবি পুলিশের অভিযানে একের পর এক “বন্দুক যুদ্ধের” ঘটনা ঘটতে থাকে। স্কুল ও মাদ্রাসার শিক্ষক, কলেজ বা ভার্সিটির ছাত্র কেউ এই গুলির লড়াই থেকে বাদ পড়েনি। প্রথমে আইন শৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য পরিচয়ে তুলে নিয়ে যাওয়া পরে গুলিবিদ্ধ লাশ পড়ে থাকতো বিভিন্ন স্থানে। এদের মধ্যে কালীগঞ্জ উপজেলা আবুজার গিফারি ২০১৬ সালের ১৮ মার্চ সাদা পোষাকে চারজন ব্যক্তি আবুজার গিফারিকোর পূর্বক তুলে নিয়ে যায়। আবুজার গিফারী যশোর এমএম কলেজের বাংলায় অনার্স ৩য় বর্ষের ছাত্র ও কালীগঞ্জ পৌর এলাকার চাপালী গ্রামের নুর ইসলামের ছেলে। ঘটনার দিন নিজ গ্রামের মসজিদে জুম্মার নামাজ শেষে বাড়ি ফেরার পথে দুটি মটর সাইকেলে ৪ জন ব্যক্তি গিফারীর পথরোধ করে। তারা নিজেদেরকে ডিবি পুলিশ পরিচয় দিয়ে গিফারীর হাতে হাতকড়া দিয়ে তুলে নিয়ে যায়। এ সময় উপস্থিত ছিলেন আবুজার গিফারী মা কুলসুম বেগম, মামা ফজলু সরদার, ফুফু নূরজাহান বেগম, চাচাতো ভাই পান্নু রহমান, ফুফাত্ োভাই রিপন হোসেন। এ ব্যাপারে তিনি পুত্রকে বিভিন্ন জায়গা খুজে না পেয়ে ২২ মার্চ কালীগঞ্জ থানায় একটি সাধারন ডায়েরী করেন। শামীম মাহমুদ ২০১৬ সালের ২৫ মার্চ  ঝিনাইদহের কালীগঞ্জ শহর থেকে সাদা পোশাকের ডিবি পুলিশ পরিচয়ে মুখোশধারী সাদা পোশাকের লোক জোর করে তুলে নিয়ে যায়। শামীম কালীগঞ্জ পৌরসভা এলাকার বাকুলিয়া গ্রামের রুহুল আমিনের ছেলে এবং ঝিনাইদহ সরকারী কেসি কলেজের অনার্স ব্যবস্থাপনা দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র।এদিন বিকালে সে বাইরে বেড়াতে এসেছিল। কিন্তু যশোর- ঝিনাইদহ মহাসড়কের সরকারি মাহতাব উদ্দীন ডিগ্রী কলেজের পাশ থেকে অপরিচিত ৪ জন লোক তাকে তুলে নিয়ে যায়। এরপর পরিবারের সদস্যরা প্রশাসনের সব দপ্তরে খোজ করে তার কোন সন্ধান পায়নি।

২০১৬ সালের ১৩ এপ্রিল সকালে যশোর সদর উপজেলার হৈবতপুর ইউনিয়নের বহরামপুর সার্বজনিন শ্মশান ঘাট থেকে তাদের গুলিবিদ্ধ লাশ পাওয়া যায়। ওইদিন সকালে স্থানীরা শ্মশানঘাটের মন্দিরে পূজা করতে এসে পুকুরে পড়ে থাকা লাশ দেখতে পেয়ে পুলিশে খবর দেয়।পরে নিহতদের পরিবারের লোকজন সেখানে যেয়ে তাদের পরিচয় নিশ্চিত করে। সোহানুর ইসলাম সোহান ২০১৬ সালের ১০ এপ্রিল বিকালে ঝিনাইদহের কালীগঞ্জ উপজেলা ঈশ্বরবা গ্রামের জামতলা থেকে সোহানুর ইসলামকে একটি ইজিবাইকে করে চারজন অপরিচিত লোক তাকে তুলে নিয়ে যায় বলে স্থানীয়রা জানায়। এরপর থেকে সে নিখোজ ছিল।কালীগঞ্জ থানার পুলিশ এসআই নিরবের নেতৃত্বে তাকে তুলে নিয়ে যায় বলে প্রত্যক্ষধর্শীরা নিশ্চিত করে। নিখোজ সোহানুর ঈশ্বরবা গ্রামের কাপড় ব্যবসায়ী মহসিন আলীর ছেলে ও কালীগঞ্জ শহরের শহীদ নুর আলী কলেজের প্রথম বর্ষের মানবিক বিভাগের ছাত্র ছিল। 

নিখোজ সোহানুর ইসলামের মা পারভিন আক্তার জানায়, ওইদিন আমি ঢাকা থেকে বাড়ি ফিরছিলাম। আমার দুই ছেলে গ্রামের ঈশ্বরবা জামতলা এলাকায় বসে ছিল আমাকে নেওয়ার জন্য। আমার সাথে মোবাইলে শেষ কথা হয় ৫ টা ১০ মিনিটের সময়। এর ২০ মিনিট পর আমি গ্রামের জামতলায় পৌছায়। এরপর পাশের একটি বাড়ি থেকে আমার ছোট ছেলে কাদতে কাদতে এসে বললো আম্মু ভাইকে কারা ধরে নিয়ে গেছে। সে এসএসসি পরীক্ষায় জিপিএ-৪.৩১ নম্বর পেয়ে কালীগঞ্জ শহরের শহিদ নূর আলী কলেজে প্রথম বর্ষের ছাত্র ছিল।সোহানুর রহমানের বাবা ঢাকায় থাকেন। তার দুই ছেলে এক মেয়ে। সোহানুরের সন্ধান দাবিতে ১৭ এপ্রিল ঝিনাইদহ প্রেস ক্লাবে সংবাদ সম্মেলন করেছিল সোহানুরের পরিবার। নিখোজের ১০ দিন পর ২০১৬ সালের ২০ এপ্রিল সকালে চুয়াডাঙ্গার সদর উপজেলার বাকুলিয়া-বুলকিয়া গ্রামের চন্দ্রতলা ব্রিজের নীচ থেকে কলেজ ছাত্র সোহানুর ইসলামের গুলিবিদ্ধ লাশ উদ্ধার হয়। নিহত সোহানুরের বাম চোখে গুলি লেগে মাথার পিছন দিকের হাড় ভেঙ্গে বেরিয়ে যায়। মৃত্যুর পূর্বে তার উপর অমানবিক নির্যাতন করা হয়েছিল।একইভাবে নির্যাতন করে হত্যা করাহয় কলেজ ছাত্র আবুজার গিফারি ও শামিম মাহমুদকে। 

ঝিনাইদহের কালীগঞ্জ পৌর শাখা শিবিরের সাবেক সভাপতি আবুজর গিফারী ও শিবিরকর্মী শামীম হোসেনকে হত্যার ঘটনায় পৃথক দুটি মামলা হয়েছে। ২০২৪ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর বিজ্ঞ আমলী জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট কালীগঞ্জ আদালতে আবুজার গিফারীর বাবা নুর ইসলাম বাদি হয়ে ১১ জন ও শামীম হোসেনের বাবা রুহুল আমিন বাদী হয়ে ১২ জনের নাম উল্লেখ করে মামলার আবেদন করেন। মামলাটি আমলে নিয়ে কালীগঞ্জ থানার ওসিকে এজাহারভুক্ত করতে নির্দেশ দেয় বিজ্ঞ আমলী জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট কালীগঞ্জ আদালতের বিচারক রোমানা আফরোজ।দুটি মামলার আসামিরা ঝিনাইদহের সাবেক পুলিশ সুপার আলতাফ হোসেন, কালীগঞ্জ থানার সাবেক ভারপ্রাপ্ত কমকর্তা আনোয়ার হোসেন, সাবেক এসআই নিরব হোসেন, সাবেক এসআই আশরাফুল আলম, সাবেক অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আজবাহার আলী শেখ,সাবেক এসআই নাসির হোসেন,সাবেক এসআই গাফ্ফার, সাবেক এসআই ইমরান হোসেন,পৌরসভার সাবেক মেয়র আশরাফুল আলম,মোস্তাফিজুর রহমান বিজু, সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান শিবলী নোমানী,সাবেক এমপির একান্ত সচিব আব্দুর রউফ, সাবেক চেয়ারম্যান আবুল কালাম আজাদ,আলী হোসেন অপু, মহিদুল ইসলাম মন্টু । মামলার বিবরণে আবুজার গিফারীর বাবা নুর ইসলাম উল্লেখ করেছেন, ২০১৬ সালের ১৮ মার্চ জুম্মার নামাজ পড়ে বাড়ি ফেরার পথে চাপালী লস্কারপাড়া থেকে দুইটা মোটর সাইকেলে ৪ জন সাদা পোশাকধারী জোরপূর্বক অপহরণ করে নিয়ে যায়। চিৎকারে বাড়ি থেকে গিফারীর মা আসলে তাকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে জোরপূর্বক নিয়ে যায়। এরপর সাবেক সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজীম আনার, পুলিশ সুপারসহ বিভিন্ন অফিসে যোগাযোগ করলে তারা এড়িয়ে যায়। পরে ২০১৬ সালের ১৩ এপ্রিল যশোর সদরের লাউখালি গ্রামে শ্মশানঘাট এলাকা থেকে গুলিবিদ্ধ লাশ পাওয়া যায়। আরেক মামলার এজাহারে শামীম হোসেনের বাবা রুহুল আমিন উল্লেখ করেছেন, ২০১৬ সালের ২৪ মার্চ বিকাল ৫টার দিকে শহরের সরকারি মাহতাব উদ্দিন ডিগ্রী কলেজ এর পূর্ব পাশের গেটের সামনে থেকে দুই মোটর সাইকেলে থাকা সাদা পোশাকধারী ৪ জন তাকে জোরপূর্বক উঠিয়ে নিয়ে যায়। এরপর বিভিন্ন অফিসে খোঁজাখুঁজি করে সন্ধান পাইনি পরিবার। পরে ২০১৬ সালের ১৩ ্এপ্রিল যশোর সদরের লাউখালি গ্রামে শ্মশানঘাট এলাকা থেকে গুলিবিদ্ধ লাশ পাওয়া যায়।এ ব্যাপারে মামলার বাদী পক্ষের আইনজীবী আব্দুর রশিদ বিশ্বাস বলেন, আবুজার গিফারী ও শামীম হোসেনকে হত্যার ঘটনায় পৃথক দুটি মামলার আবেদন করেছিল নিহতদের বাবা। আদালতে ৩৬৪/৩০২/৩৪ দন্ড বিধি আইনে মামলাটি করা হয়। পরিকল্পিত ভাবে কথিত বন্ধুক যুদ্ধের নামে ঠান্ডা মাথায় পুলিশ সদস্যগণ শামীম হোসেনের মাথার ডান পাশে কানের উপরে এবং মাথার বাম পাশে গুলি করে তাকে হত্যা করে।আদালত ১৫৬(৩) ধারার বিধান মোতাবেক এজাহার হিসেবে গ্রহন করার জন্য বর্তমান কালীগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) কে নির্দেশ দিয়েছেন। 

অবৈধ ভোটার বিহীন আওয়ামী লীগ সরকার প্রধানের নির্দেশে, আওয়ামী লীগের সন্ত্রাসীরা ও আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর কিছু অতি উৎসাহী সদস্যরা দমন-নিপীড়ন ও নির্যাতন চালিয়ে ক্রসফায়ারের নামে ভয়াবহ হত্যাকান্ড চালিয়েছে।আওয়ামীলীগসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর মূল উদ্দেশ্য ছিল ক্রসফায়ারের নামে হত্যার মাধ্যমে বড় রাজনৈতিক দলকে শূন্য করে দেওয়া ভীতি সৃষ্টি করে সমর্থক ও লোকজনদের দলীয় কার্যক্রম থেকে বিরত রাখার চেষ্টা করা, এবং দলের মধ্যে বিভ্রান্তি তৈরি করা।

আপনার জেলার সংবাদ পড়তে