রাজধানী থেকে গ্রামাঞ্চল-দেশের কোথাও চুরি-ছিনতাইয়ের হাত থেকে মানুষ রেহাই পাচ্ছে না। মওলানা ভাসানী সেতু থেকে বৈদ্যুতিক তার, রাজধানীর ব্যস্ত সড়কে গাড়ির যন্ত্রাংশ, বাজারের দোকান থেকে মালামাল কিংবা গ্রামের কৃষকের ঘর থেকে পাট ও হাঁস-মুরগি-সবকিছুই চোরচক্রের নিশানায়। এমনকি ভিক্ষুক নারীর ঘরে চুরি হয়ে তাঁর হত্যার মতো ভয়ংকর ঘটনাও ঘটছে। পুলিশের নিজস্ব পরিসংখ্যান বলছে, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে জুলাই পর্যন্ত দেশে পাঁচ হাজারের বেশি চুরির মামলা হয়েছে। শুধু ঢাকা মহানগরীতেই সাত মাসে ৮৩৭টি মামলা। এর বাইরে অসংখ্য ঘটনা অভিযোগের বাইরেই থেকে যাচ্ছে। অপরাধ বিশ্লেষকরা বলছেন, বেকারত্ব, নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি, দারিদ্র্য বৃদ্ধি, মাদকের বিস্তার এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নজরদারির দুর্বলতা এ পরিস্থিতির মূল কারণ। পিপিআরসির গবেষণায় দেখা গেছে, গত তিন বছরে দেশে দারিদ্র্যের হার প্রায় ১০ শতাংশ বেড়ে ২৮ শতাংশে পৌঁছেছে। প্রতিটি পরিবারের আয় কমেছে, অথচ ব্যয়ের সিংহভাগ এখন শুধু খাদ্যে। এই প্রেক্ষাপটে চুরির হার বেড়ে যাওয়া অপ্রত্যাশিত নয়। তবে এ অজুহাতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় গাফিলতি চলতে পারে না। চুরি হয়তো বড় অপরাধের তুলনায় ‘ছোটখাটো’ মনে হতে পারে, কিন্তু এর সামাজিক প্রভাব ভয়াবহ। বাসাবাড়ি থেকে স্বর্ণালংকার বা কৃষকের গুদাম থেকে পাট চুরি শুধু আর্থিক ক্ষতি নয়, মানুষের নিরাপত্তাবোধকে চূর্ণ করে দেয়। ফলে সমাজে অনিশ্চয়তা ও ভয়ের পরিবেশ তৈরি হয়। এ কারণে অনেক এলাকায় মানুষ দল বেঁধে রাত জেগে পাহারা দিতে বাধ্য হচ্ছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী অবশ্য বলছে, তারা তৎপর রয়েছে এবং অপরাধীদের ধরার চেষ্টা করছে। কিন্তু বাস্তবতা হলো, প্রতিদিনই নতুন নতুন চুরির ঘটনা ঘটছে। এর মানে নজরদারি দুর্বল, টহল কার্যকর নয় এবং অপরাধীরা শাস্তির ভয় পাচ্ছে না। শুধু গ্রেপ্তার নয়, আদালতে দ্রুত বিচার এবং দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত না করলে এ প্রবণতা কমবে না। পাশাপাশি, চুরি প্রতিরোধ কেবল পুলিশের দায়িত্ব নয়। স্থানীয় প্রশাসন, জনপ্রতিনিধি এবং সমাজকেও সচেতন হতে হবে। জনসম্পৃক্ততা ছাড়া ছোট অপরাধ নিয়ন্ত্রণ সম্ভব নয়। একই সঙ্গে সরকারকে দারিদ্র্য হ্রাস, কর্মসংস্থান সৃষ্টির মাধ্যমে অপরাধে প্রবণতা কমাতে হবে। সামাজিক নিরাপত্তা জোরদার না হলে ক্ষুধার তাড়না ও হতাশা মানুষকে অপরাধের দিকে ঠেলে দেবে। ছিঁচকে চুরি নিছক অপরাধ নয়, এটি একটি সামাজিক সংকটের প্রতিফলন। এর পেছনে অর্থনৈতিক দুরবস্থা যেমন দায়ী, তেমনি আইন প্রয়োগের শৈথিল্যও সমানভাবে দায়ী। জনগণ নিরাপত্তা চায়, ক্ষতির পরে আশ্বাস নয়। এখন সময় এসেছে এই “ছোট” অপরাধকে বড় সংকট হিসেবে বিবেচনা করে জরুরি পদক্ষেপ নেওয়ার।