সরকারি প্রতিষ্ঠানের অনিয়ম-দুর্নীতি নিরীক্ষার উদ্যোগ সরকারের নেই

এফএনএস এক্সক্লুসিভ | প্রকাশ: ২ সেপ্টেম্বর, ২০২৫, ০৮:০২ এএম
সরকারি প্রতিষ্ঠানের অনিয়ম-দুর্নীতি নিরীক্ষার উদ্যোগ সরকারের নেই

সরকারি প্রতিষ্ঠান, সংস্থা, করপোরেশন ও বিভাগের অনিয়ম-দুর্নীতি নিরীক্ষার উদ্যোগ অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের নেই। বিভিন্ন সময়ে কম্পট্রোলার অ্যান্ড অডিটর জেনারেলের (সিএজি) দপ্তরের নিরীক্ষায় ওসব প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন প্রকল্প ও কেনাকাটায় বড় ধরনের আর্থিক অনিয়মের তথ্য উঠে এসেছে। পাশাপাশি ঋণের নামে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের অর্থ লুট করা হয়েছে। বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গত এক বছরে বেসরকারি খাতের বিভিন্ন অনিয়ম ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে তদন্ত ও নিরীক্ষার উদ্যোগ নিলেও এখনো দেখা যায়নি সরকারি প্রতিষ্ঠান, সংস্থা, করপোরেশন ও বিভাগের অনিয়ম-দুর্নীতি নিরীক্ষা করে দেখার কোনো উদ্যোগ। বর্তমানে দেশে ২৩২টি স্বায়ত্তশাসিত, স্বশাসিত ও বিধিবদ্ধ সরকারি প্রতিষ্ঠান রয়েছে। অনিয়ম-দুর্নীতি ও অদক্ষতার কারণে ওসব প্রতিষ্ঠানের অধিকাংশ থেকে সেভাবে কোনো রিটার্ন পাচ্ছে না সরকার। বরং এসব প্রতিষ্ঠান টিকিয়ে রাখতে সরকারি কোষাগার থেকে দিতে হচ্ছে অর্থ। অর্থনৈতিক সমীক্ষা অনুসারে ৩০ জুন ২০২৪ শেষে ওসব প্রতিষ্ঠানের ঋণের পরিমাণ ২ লাখ ১৮ হাজার কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে। আর ২০২৩-২৪ অর্থবছরে সরকার ওসব প্রতিষ্ঠানকে ৫০ হাজার ৭৮৩ কোটি টাকা অনুদান দিয়েছে। কম্পট্রোলার অ্যান্ড অডিটর জেনারেলের (সিএজি) দপ্তর এবং জ্বালানি মন্ত্রণালয় সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।

সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, যেসব সরকারি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে সবচেয়ে বেশি অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে সেগুলোর মধ্যে রয়েছে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি), বাংলাদেশ তেল, গ্যাস ও খনিজ সম্পদ করপোরেশন (পেট্রোবাংলা), বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম এক্সপ্লোরেশন অ্যান্ড প্রডাকশন কোম্পানি (বাপেক্স), তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন, বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (বিপিডিবি), বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনস, বাংলাদেশ কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ করপোরেশন (বিসিআইসি) ও বাংলাদেশ শিপিং করপোরেশন (বিএসসি)। বিগত সরকারের শাসনামলে সরকারি বিনিয়োগকে ঘিরে ব্যাপক দুর্নীতি হয়েছে। সরকারি কর্মকাণ্ডের জন্য ক্রয়কৃত পণ্য ও সেবায় প্রায় ৭ লাখ কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে। ওই অর্থ থেকে ঘুস হিসেবেই ১ লাখ ৬১ হাজার কোটি থেকে ২ লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকার মতো চলে গেছে। রাজনৈতিক নেতা, আমলা ও তাদের সহযোগী ব্যক্তিরা ওই ঘুস নিয়েছেন। ওই সময়ে দেশ থেকে ২৩৪ বিলিয়ন বা ২৩ হাজার ৪০০ কোটি ডলার পাচার হয়েছে। বাংলাদেশী মুদ্রায় পাচারকৃত অর্থের পরিমাণ প্রায় ২৭ লাখ কোটি টাকা। আর বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাত ছিলো অনিয়ম ও লুটপাটের অন্যতম ক্ষেত্র। কিন্তু ওই খাতসংশ্লিষ্ট সরকারি প্রতিষ্ঠান বিপিসি, পেট্রোবাংলা, বাপেক্স, তিতাস গ্যাস ও বিপিডিবির বিরুদ্ধে ওঠা অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ খতিয়ে দেখতে কোনো ধরনের তদন্ত কিংবা বিশেষ নিরীক্ষার অন্তর্বর্তী সরকার উদ্যোগ নেয়নি।

সূত্র জানায়, বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের আমলে প্রকাশিত শ্বেতপত্র কমিটির প্রতিবেদনে দেশের বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে অন্তত ৬০০ কোটি ডলার অনিয়ম-দুর্নীতির কথা উঠে আসে। বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণে কমিশন, কেন্দ্র না চালিয়ে বসিয়ে রেখে ক্যাপাসিটি চার্জ ও অতিরিক্ত মুনাফা হিসেবে ওই অর্থ বেসরকারি খাত নিয়ে যাওয়ার কথা শ্বেতপত্রে উল্লেখ করা হয়। এরই মধ্যে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে অতিরিক্ত ব্যয় ও আর্থিক ক্ষতি কমাতে মন্ত্রণালয় থেকে বিভিন্ন কমিটি করা হলেও আগের অনিয়ম-দুর্নীতি তদন্তে এখন পর্যন্ত কোনো দৃশ্যমান উদ্যোগ নেই। অথচ বিগত ২০০৯ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দ্রুত সরবরাহ আইনের আওতায় শতাধিক প্রকল্প গ্রহণ করা হয়। সেব প্রকল্পে পছন্দের কোম্পানিকে কাজ দিতে বড় আকারের কমিশন বাণিজ্য হয়। একই সঙ্গে প্রকল্পের ব্যয় বৃদ্ধি, অপ্রয়োজনীয় প্রকল্প গ্রহণ করে সরকারের আর্থিক ক্ষতির বিষয়টিও বারবার আলোচনায় উঠে এসেছে। আর দেশের বিদ্যুৎ খাতের একক ক্রেতাপ্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (বিপিডিবি)। সংস্থাটি উৎপাদন সক্ষমতা বাড়াতে গিয়ে বিশেষ আইনের অধীনে বিগত দেড় দশকে দেশী-বিদেশী বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে বিদ্যুৎ ক্রয় চুক্তি করে। তবে ওসব ক্রয় চুক্তিতে বিভিন্ন সময় অনিয়ম-দুর্নীতির মাধ্যমে রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানটিকে ক্ষতিগ্রস্ত করার অভিযোগ রয়েছে। আদানির সঙ্গে বিদ্যুৎ ক্রয় চুক্তি, রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র, আরো অনেক বেসরকারি বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণে বড় আকারে দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে। বিগত সরকার পতনের পরই ওসব অভিযোগ স্বাধীনভাবে তদন্ত করার দাবি ওঠে।

সূত্র আরো জানায়, দেশের সবচেয়ে ব্যয়বহুল প্রকল্প রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র। বিভিন্ন সময় ওই প্রকল্পে অর্থ ব্যয়ে দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে। বর্তমান সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর রূপপুর বিদ্যুৎ কেন্দ্রের প্রকৃত ব্যয় নিয়ে নিরীক্ষা করার সুযোগ ছিল। ১ লাখ ১৪ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ের ওই বিদ্যুৎ কেন্দ্রে বিভিন্ন সময় কেনাকাটায় কী হয়েছে তার সঠিক তদন্তের দাবিও উঠেছিল। কিন্তু অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ওই রকম কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। তাছাড়া ২০১০-১১ থেকে ২০২৪-২৫ অর্থবছর পর্যন্ত শুধু বিদ্যুতেই ২ লাখ ৩৬ হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি দিতে হয়েছে। তার মধ্যে ক্যাপাসিটি চার্জ ছিলো অন্তত দেড় লাখ কোটি টাকার বেশি। বিদ্যুৎ, জ্বালানির বিশেষ আইন বাতিল করলেও ওই আইনের আওতায় হওয়া চুক্তিগুলোয় কী ছিল তা জনগণের সামনে প্রকাশ করার জোর দাবি ওঠলেও সরকার সে রকম কিছু করেনি। আর বিগত ২০১৮ সালের পর জ্বালানি খাতে এলএনজি আমদানি নিয়ে শুরু থেকেই বিতর্ক ছিল। সবচেয়ে বড় অভিযোগ ছিল ওই খাতের কমিশন বাণিজ্য। ওই খাতে কারা কমিশন বাণিজ্য করেছে, তা তদন্ত করে দেখার বিষয়টি বার বার আলোচনা হলেও এ বিষয়ে কোনো উদ্যোগ এখনো নেয়া হয়নি। বিপুল অংকের এলএনজি আমদানি করতে গিয়ে দেশের গ্যাস খাতের স্থানীয় অনুসন্ধান কার্যক্রম অবহেলায় রাখার পেছনে বড় একটি সিন্ডিকেট কাজ করেছিল বলে অভিযোগ রয়েছে। যে কারণে বছরের পর বছর পেট্রোবাংলা অর্থ সংকটে থেকেছে।

এদিকে দেশে জ্বালানি তেল ক্রয়, আমদানি ও বিপণনকাজে নিয়োজিত রয়েছে রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি)। বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দামে উল্লম্ফন হলে বিপিসি বিভিন্ন সময় তেলের দাম বাড়িয়েছে। সংস্থাটি লোকসানের কথা বলে তেলের দাম বাড়িয়ে ভোক্তার কাছ থেকে তা উসুল করেছে। অথচ বিগত সাত-আট বছর কোম্পানিটি বিপুল পরিমাণ লাভ করলেও ওই অর্থ দাম কমার সময়ে সমন্বয় করেনি। বরং বছরের পর বছর বিপুল পরিমাণ অর্থ বিভিন্ন ব্যাংকে জমা রেখে মুনাফা করেছে সংস্থাটি। জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির ক্ষেত্রে বিভিন্ন সময় বিপিসির আর্থিক মুনাফার বিষয়টি আন্তর্জাতিক ফার্ম দিয়ে অডিট করার দাবি উঠলেও সে বিষয়ে কোনো উদ্যোগ নেয়া হয়নি। অর্থনৈতিক সমীক্ষার হিসার অনুযায়ী, ২০১৪-১৫ থেকে ২০২৩-২৪ (এপ্রিল পর্যন্ত) অর্থবছর পর্যন্ত প্রায় সাড়ে ৫৫ হাজার কোটি টাকা লাভ করেছে বিপিসি। তাছাড়া গ্রাহক ও গ্যাস সরবরাহে দেশের সবচেয়ে বড় বিতরণ কোম্পানি তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেড (টিজিটিডিসিএল)। কোম্পানিটির গ্যাস বিতরণে সিস্টেম লস চলতি বছরের জানুয়ারিতে ১০ দশমিক ৫৩ শতাংশ। উচ্চমূল্যে গ্যাস কিনে বিতরণ করতে গিয়ে এ সিস্টেম লসের (কারিগরি ত্রুটি) নামে বিপুল পরিমাণ গ্যাস অপচয় ও চুরি হচ্ছে। সব মিলিয়ে গ্যাসের সিস্টেম লসে বছরে অন্তত ১০০ কোটি ডলারের আর্থিক ক্ষতি হচ্ছে। অভিযোগ রয়েছে, কোম্পানির অসাধু ও দুর্নীতিবাজ কিছু কর্মকর্তাদের কারণে সিস্টেম লস দেখিয়ে অবৈধভাবে গ্যাস সংযোগ দেয়া হচ্ছে। ওই চুরি ঠেকাতে নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করা হলেও কোনোভাবেই তা কমানো যাচ্ছে না। জ্বালানি বিভাগ থেকে ২০২৬ সালের জুনে তিতাসসহ অন্যান্য কোম্পানির সিস্টেম লস কমিয়ে আনতে লক্ষ্যমাত্রা বেঁধে দেয়া হলেও প্রকৃতপক্ষে তা কার্যকর হচ্ছে না। গ্যাস খাতে তিতাসের এসব অনিয়ম-দুর্নীতি নিয়ে বিভিন্ন সময়ে বৃহদাকারে তদনে—র দাবি উঠলেও সে বিষয়ে এখনো কোনো উদ্যোগ নেয়া যায়নি বলে মনে করেন সংশি­ষ্টরা। আর দেশের গ্যাস অনুসন্ধান-উত্তোলনের রাষ্ট্রীয় কোম্পানি বাপেক্স। সংস্থাটি গত দুই দশকে বৃহদাকারে কোনো গ্যাস অনুসন্ধানে কার্যক্রম চালাতে পারেনি। গ্যাস খাতে বাপেক্সকে বসিয়ে রাখা হয়েছে নাকি বাপেক্সের সক্ষমতা নেই এমন প্রশ্ন তৈরি হয়েছিল আওয়ামী সরকারের শেষ সময়ে। দেশের গ্যাস খাতে বিদেশী কোম্পানি দিয়ে উচ্চমূল্যে কূপ খননের বড় অভিযোগ রয়েছে। এছাড়া রিগ ক্রয়, প্রকল্প বাস্তবায়নে ধীরগতি, সঠিক জরিপ না করে কূপ খনন করে সরকারের আর্থিক দণ্ড নিয়ে বড় প্রশ্ন রয়েছে।

অন্যদিকে জ্বালানি খাতের এসব বিষয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, তারা ক্ষমতায় আসার পর বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের বকেয়া ছিলো বড় চ্যালেঞ্জ। তা পরিশোধ করে রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর আর্থিক চাপ কমানো হয়েছে। তাছাড়া বিশেষ আইন নিয়ে অভিযোগ ছিল। সরকার তা বাতিল করেছে। এর বাইরে বিদ্যুতের ট্যারিফ কমানো, চুক্তি বাতিল, বিভিন্ন বিদ্যুৎ কেন্দ্রের বিষয়ে তদন্ত কমিটি করা হয়েছে। ওই কমিটি মূলত ব্যয় ও চুক্তির বিষয়গুলো খতিয়ে দেখে সুপারিশ করেছে। সেগুলো নিয়ে এখনো কাজ চলছে। আর বিগত সরকারের সময়ে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের অনিয়ম-দুর্নীতি নিয়ে বড় আকারে অনুসন্ধানের পরিকল্পনা রয়েছে এ সরকারের।

এ প্রসঙ্গে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান জানান, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে অনিয়ম-দুর্নীতি তদন্তে আগামীতে অডিটের পরিকল্পনা রয়েছে। তবে এখানে স্থানীয়ভাবে কোনো ফার্মকে নিয়োগ করার ক্ষেত্রে আরো পর্যবেক্ষণের দরকার। এ খাতের বিভিন্ন চুক্তি ও ক্রয় খতিয়ে দেখার জন্য মন্ত্রণালয়ে একটি কমিটি করা হয়েছিল। তারা আন্তর্জাতিক পরামর্শক নিয়োগ দেয়ার বিষয়ে সুপারিশ করেছিল। একটা আন্তর্জাতিক পরামর্শক প্রতিষ্ঠান খোঁজা হচ্ছে, কিন্তু এখনো কাউকে নিয়োগ দেয়া যায়নি।

আপনার জেলার সংবাদ পড়তে