দেশে কার্যরত সরকারি বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রগুলো নিয়মিত মুনাফা করছে। আর ওই মুনাফা কোম্পানিগুলোর কর্মকর্তা-কর্মচারীরা ভাগাভাগি করে নিচ্ছে। অথচ বিদ্যুৎ খাতে সরকারকে প্রতি বছরই দিতে হচ্ছে বিপুল অংকের ভর্তুকি। এমনকি দিন দিন ওই ভর্তুকির পরিমাণ বাড়ছে। গত অর্থবছরে বিদ্যুৎ খাতে সরকারকে সর্বোচ্চ ৬২ হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি দিতে হয়েছে। সরকারি বিদ্যুৎ উৎপাদন কোম্পানির মুনাফা বন্ধে গত সেপ্টেম্বরে বিদ্যুৎ বিভাগ নির্দেশনা দিলেও তা বন্ধ হচ্ছে না। বিদ্যুৎ উৎপাদন খাতে ৬টি, বিতরণ খাতে ৬টি ও সঞ্চালন খাতে একটি সরকারি কোম্পানি আছে। ওসব কোম্পানির বেতনকাঠামো সরকারি বেতন স্কেলের চেয়ে অনেক বেশি। কোম্পানিগুলোর কর্মকর্তা-কর্মচারীরা ভবিষ্য তহবিল/প্রভিডেন্ট ফান্ড, গ্র্যাচুইটি, বার্ষিক ছুটি, গ্রুপ ইনস্যুরেন্স, বার্ষিক বেতন বৃদ্ধিসহ নানা সুবিধা পান। তার বাইরে তাঁরা প্রতিবছর কোম্পানির মুনাফা ভাগাভাগি করে, যা পরিচিত প্রফিট বোনাস হিসেবে। বিদ্যুৎ ও জ্বালানি মন্ত্রণালয় সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি) সরকারি-বেসরকারি সব বিদ্যুৎকেন্দ্রে উৎপাদিত বিদ্যুৎ কিনে নেয়। এরপর তা বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি) নির্ধারিত দামে তা বিক্রি করে ছয়টি বিতরণ সংস্থার কাছে। পিডিবির প্রতি ইউনিট বিদ্যুৎ কিনতে ১১ টাকার বেশি খরচ হয় গড়ে। আর পিডিবি প্রতি ইউনিট ৭ টাকা ৪ পয়সায় বিক্রি করে। তাতে পিডিবির লোকসান গুনতে হয় এবং তা ভর্তুকি হিসেবে সরকারের কাছ থেকে নেয়া হয়।
সূত্র জানায়, সরকারি বিদ্যুৎ উৎপাদন কোম্পানিগুলোর মুনাফা জনবলের দক্ষতা বা বিদ্যুৎ উৎপাদনের ওপর নির্ভর করে না। বরং কোনো বিদ্যুৎ উৎপাদন না করেও বিদ্যুৎকেন্দ্র মুনাফা করতে পারে পিডিবি ওভাবেই বিদ্যুৎকেন্দ্রের সঙ্গে বিদ্যুৎ ক্রয় চুক্তি করে। চুক্তিতে বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ভাড়া (ক্যাপাসিটি চার্জ) নির্ধারণ করা থাকে। ফলে কেন্দ্র বিদ্যুৎ উৎপাদন করুক আর না করুক পিডিবি ভাড়া পরিশোধ করে। কোম্পানি আইনে নিবন্ধিত হলেও ওই কোম্পানিগুলো সরকারের ভর্তুকির প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ গ্রহীতা বা উপকারভোগী। বিদ্যুৎ খাতে সরকারি ভর্তুকি বাদ দিলে ওসব কোম্পানি কখনোই লাভজনক থাকবে না। এমন পরিস্থিতিতে ওসব কোম্পানিকে লাভজনক দেখিয়ে মুনাফা ভাগাভাগি নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। এক্ষেত্রে কোম্পানির নিট আয়ের সঙ্গে ভর্তুকির টাকা সমন্বয় করে প্রতিষ্ঠানের লাভ-ক্ষতি হিসাব করা জরুরি। তাছাড়া কোম্পানিগুলোর মুনাফার ৫ শতাংশ ওয়ার্কার্স প্রফিট পার্টিসিপেশন ফান্ডে (ডব্লিউপিপিএফ) শ্রম আইন অনুসারে জমা হয়। ওই ফান্ড থেকে অংশগ্রহণ তহবিলে ৮০ শতাংশ জমা হয়। আর কল্যাণ তহবিল ও শ্রমিক কল্যাণ ফাউন্ডেশন তহবিলে ১০ শতাংশ করে জমা হয়। অংশগ্রহণ তহবিলের তিন ভাগের দুই ভাগ প্রতিবছর কোম্পানির কর্মকর্তা-কর্মচারীরা সমহারে ভাগাভাগি করে নেন। আরেক ভাগ তাঁদের অবসর তহবিলে জমা হয়। প্রতি অর্থবছরের ৯ মাসের মধ্যে আগের অর্থবছরের মুনাফা শ্রম আইনে ভাগাভাগি করার বিধান আছে। তাতে কোম্পানির প্রত্যেক কর্মকর্তা-কর্মচারী প্রতিবছর গড়ে কয়েক লাখ টাকা করে পায়।
সূত্র আরো জানায়, বিগত সরকার বিদ্যুৎ খাতের খরচের ঘাটতি মেটাতে দেড় দশকে বিদ্যুতের দাম বাড়ায় পাইকারি পর্যায়ে ১২ বার, খুচরা পর্যায়ে ১৪ বার। তারপরও প্রতিবছর বিদ্যুৎ খাতের ভর্তুকি বেড়েছে। কিন্তু ২০১৭-১৮ অর্থবছর থেকে ২০২৩-২৪ অর্থবছর পর্যন্ত ডব্লিউপিপিএফে ২১৮ কোটি ৩৩ লাখ টাকা নওপাজেকো জমা করে। তার মধ্যে ২০২৩-২৪ অর্থবছরে কোম্পানিটি প্রায় ৩৭ কোটি টাকা কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মুনাফা দিয়েছে। একই অর্থবছরে ইজিসিবি মুনাফা দিয়েছে ১৬ কোটি ৭৭ লাখ টাকা, আগের বছর তা ছিল ১৭ কোটি ৩৭ লাখ টাকা। এপিএসসিএল দিয়েছে ২৬ কোটি ৮১ লাখ টাকা, আগের বছরে ১৩ কোটি ৭৭ লাখ টাকা। আরপিসিএল দিয়েছে ৯ কোটি ৮৪ লাখ টাকা, আগের বছর তা ছিল ২ কোটি ২৭ লাখ টাকা। বিআরপিএল দিয়েছে ৫ কোটি ৬২ লাখ টাকা, আগের বছর তা ছিল ২ কোটি ৯ লাখ টাকা। আর গত মার্চের শেষ দিকে ২০২৩-২৪ অর্থবছরের মুনাফা সরকারি মালিকানাধীন ইলেক্ট্রিসিটি জেনারেশন কোম্পানি অব বাংলাদেশ লিমিটেড (ইজিসিবি) ভাগাভাগি করে। তারপর ধাপে ধাপে মে মাসের মধ্যে একই অর্থবছরের মুনাফা সরকারি মালিকানাধীন অপর চার কোম্পানি ভাগ করে নেয়। সেগুলো হলো আশুগঞ্জ পাওয়ার স্টেশন কোম্পানি লিমিটেড (এপিএসসিএল), নর্থ-ওয়েস্ট পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানি লিমিটেড (নওপাজেকো), রুরাল পাওয়ার কোম্পানি লিমিটেড (আরপিসিএল) ও বি-আর পাওয়ারজেন লিমিটেড (বিআরপিএল)।
এদিকে বিদ্যুৎ উৎপাদন কোম্পানিগুলো সংশ্লিষ্টদের মতে, কোম্পানির শ্রম আইন মানার আইনগত বাধ্যবাধকতা রয়েছে। সেজন্যই আইনগত ঝামেলা এড়াতে বিদ্যুৎ বিভাগের সঙ্গে মৌখিকভাবে আলোচনা করে ২০২৩-২৪ অর্থবছরের মুনাফা কোম্পানিগুলো ভাগাভাগি করেছে। কিন্তু মুনাফার ভাগ দিতে রাজি নয় কোম্পানির ৫০ শতাংশ মালিকানায় থাকা চীনের কোম্পানি সিএমসি। এ নিয়ে আনুষ্ঠানিক আপত্তি জানানো হয়েছে। তারা বলছে, পায়রা চীনের এক্সিম ব্যাংকের ঋণসহায়তায় নির্মিত হয়েছে। সাড়ে ১১ বছরের মধ্যে তা শোধ করতে হবে। ঋণ পরিশোধের আগে মুনাফা বণ্টনের সুযোগ নেই।
অন্যদিকে এ প্রসঙ্গে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান জানান, বিদ্যুৎ খাতে গত অর্থবছরে ৬২ হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি দেয়া হয়েছে। ওই ভর্তুকি আসলে বিদ্যুৎ উৎপাদনের ক্ষেত্রে চড়া খরচের দায় মেটাতে দিতে হয়। বিদ্যুৎ উৎপাদন খাতে সরকারের মালিকানাধীন কোম্পানি আছে ছয়টি। পিডিবি বিদ্যুৎ কিনে লোকসান করলেও এই কোম্পানিগুলো প্রতিবছর মুনাফা করছে। বিদ্যুৎ খাতের সরকারি কোম্পানিগুলোকে মুনাফা ভাগাভাগি বন্ধ রাখতে গত বছরের সেপ্টেম্বরে নির্দেশনা দেয়া হয়।