সিলেট সরকারি মহিলা কলেজ: নারী শিক্ষার অগ্রযাত্রার এক অনন্য প্রতিষ্ঠান

এফএনএস (এইচ এম শহীদুল ইসলাম; সিলেট) : | প্রকাশ: ৫ সেপ্টেম্বর, ২০২৫, ০৩:০৮ পিএম
সিলেট সরকারি মহিলা কলেজ: নারী শিক্ষার অগ্রযাত্রার এক অনন্য প্রতিষ্ঠান

বাংলাদেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের অন্যতম ঐতিহ্যবাহী শিক্ষাঙ্গন হলো সিলেট সরকারি মহিলা কলেজ। সিলেটের নারী শিক্ষার প্রসারে এই কলেজের অবদান অপরিসীম। ১৯৩৯ সালে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর থেকে আজ পর্যন্ত এটি কেবলমাত্র একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নয়, বরং সিলেটের সমাজ ও সংস্কৃতিতে আধুনিকতার আলো ছড়িয়ে দেওয়া এক মহৎ কেন্দ্র হয়ে উঠেছে। দীর্ঘ ৮৫ বছরেরও বেশি সময় ধরে কলেজটি নারী শিক্ষার্থীদের উচ্চশিক্ষার সুযোগ করে দিয়ে সমগ্র অঞ্চলে শিক্ষার প্রসার ঘটাচ্ছে।

প্রতিষ্ঠা ও ইতিহাস: ১৯৩৯ সালে যখন সিলেটে মেয়েদের জন্য উচ্চশিক্ষার সুযোগ সীমিত ছিল, তখন কিছু দূরদর্শী মানুষের প্রচেষ্টায় গড়ে ওঠে এই কলেজ। শুরুতে এটি সাধারণ এক ইন্টারমিডিয়েট কলেজ হিসেবে পথচলা শুরু করে। পরবর্তী সময়ে জাতীয় শিক্ষানীতির উন্নয়ন এবং নারী শিক্ষার চাহিদা বৃদ্ধির কারণে কলেজটি ধাপে ধাপে অনার্স ও মাস্টার্স পর্যায়ে সম্প্রসারিত হয়। এই ধারাবাহিকতায় বর্তমানে কলেজটি জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত হয়ে বিস্তৃত পরিসরে শিক্ষা প্রদান করছে।

অবস্থান ও পরিবেশ: কলেজটি সিলেট শহরের প্রাণকেন্দ্র চৌহাট্টা এলাকায় হযরত শাহজালাল রোডে অবস্থিত। শহরের অন্যতম প্রধান স্থানে হওয়ায় কলেজে পৌঁছানো সহজ। এর আশপাশে শিক্ষা ও সংস্কৃতি সংশ্লিষ্ট অনেক প্রতিষ্ঠান থাকায় শিক্ষার্থীরা একটি জ্ঞানচর্চার পরিবেশ পেয়ে থাকে। সবুজে ঘেরা প্রশস্ত ক্যাম্পাসে শিক্ষার্থীদের জন্য রয়েছে লাইব্রেরি, ল্যাবরেটরি, খেলার মাঠ, অডিটোরিয়ামসহ আধুনিক শিক্ষা অবকাঠামো।

একাডেমিক কাঠামো ও বিভাগসমূহ: সিলেট সরকারি মহিলা কলেজ বর্তমানে উচ্চমাধ্যমিক (এইচএসসি), স্নাতক (অনার্স) ও স্নাতকোত্তর (মাস্টার্স) পর্যায়ে পাঠদান করছে। উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ে বিজ্ঞান, মানবিক ও ব্যবসায় শিক্ষা বিভাগ চালু রয়েছে।

অনার্স ও মাস্টার্স পর্যায়ে নিম্নলিখিত বিষয়ে পাঠদান করা হয়: বাংলা, ইংরেজি, ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি, ইতিহাস, দর্শন, রাষ্ট্রবিজ্ঞান, অর্থনীতি, সমাজকর্ম, সমাজবিজ্ঞান, গার্হস্থ্য অর্থনীতি, গণিত, পদার্থবিজ্ঞান, রসায়ন, উদ্ভিদবিজ্ঞান, প্রাণিবিজ্ঞান, তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি (ওঈঞ)।এছাড়াও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে নিয়মিত মাস্টার্স কোর্সে শিক্ষার্থীরা পড়াশোনা করার সুযোগ পেয়ে থাকে।

শিক্ষক ও প্রশাসন: কলেজের একাডেমিক ও প্রশাসনিক কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে যোগ্য শিক্ষক-শিক্ষিকাদের মাধ্যমে। বর্তমানে কলেজের অধ্যক্ষ প্রফেসর ভূবনজয় আচার্য্য এবং উপাধ্যক্ষ মো. শামসুল ইসলাম। তাদের নেতৃত্বে শিক্ষকরা শিক্ষার্থীদের মানসম্মত শিক্ষা ও দিকনির্দেশনা প্রদান করে যাচ্ছেন। কলেজে প্রতিটি বিভাগে অভিজ্ঞ অধ্যাপক ও সহকারী অধ্যাপকেরা পাঠদান করছেন, যা শিক্ষার্থীদের শিক্ষার মান উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে।

অবকাঠামো ও শিক্ষার্থী সেবা: সিলেট সরকারি মহিলা কলেজের ক্যাম্পাসে রয়েছে আধুনিক ল্যাবরেটরি, সমৃদ্ধ লাইব্রেরি এবং অডিটোরিয়াম। শিক্ষার্থীদের জন্য বিভিন্ন সহশিক্ষা কার্যক্রম যেমন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, ক্রীড়া প্রতিযোগিতা, বিতর্ক প্রতিযোগিতা, বিজ্ঞান মেলা ও নাট্যচর্চা অনুষ্ঠিত হয়। এর ফলে শিক্ষার্থীরা পাঠ্যবইয়ের পাশাপাশি সামাজিক ও সাংস্কৃতিক জগতে নিজেদেরকে সমৃদ্ধ করতে পারে।

কলেজে একটি ছাত্রী নিবাস (হোস্টেল) রয়েছে, যা বহিরাগত শিক্ষার্থীদের আবাসনের সুযোগ করে দিচ্ছে। এই হোস্টেল নারী শিক্ষার প্রসারে বিশেষ ভূমিকা রাখছে, কারণ প্রত্যন্ত এলাকার অনেক ছাত্রী এই হোস্টেলের সুবিধা নিয়ে উচ্চশিক্ষা অর্জন করতে পারছে।

শিক্ষার্থীর সংখ্যা ও সাফল্য: প্রতিবছর কয়েক হাজার শিক্ষার্থী এখানে ভর্তি হয়। কলেজের ঊওওঘ নম্বর ১৩০৪৫৩, যা সিলেট শিক্ষা বোর্ডের অধিভুক্ত কলেজগুলোর মধ্যে একটি স্বতন্ত্র পরিচয় বহন করে। একাডেমিক সাফল্যের দিক থেকেও কলেজটির অবস্থান সবসময় প্রশংসনীয়। উচ্চমাধ্যমিক ও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষায় এখানে পড়ুয়া শিক্ষার্থীরা নিয়মিত ভালো ফলাফল অর্জন করছে।

সমাজে অবদান: সিলেট সরকারি মহিলা কলেজ নারীশিক্ষার বিস্তারে শুধু একটি প্রতিষ্ঠানই নয়, বরং এটি সামাজিক পরিবর্তনেরও প্রতীক। এখানে শিক্ষা গ্রহণ করা অসংখ্য নারী আজ বাংলাদেশের বিভিন্ন ক্ষেত্রে-শিক্ষা, প্রশাসন, চিকিৎসা, সাংবাদিকতা ও সংস্কৃতিতে-গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছেন। একসময় যে অঞ্চলে মেয়েদের উচ্চশিক্ষা গ্রহণ কঠিন ছিল, সেই অঞ্চলে আজ এই কলেজের কল্যাণে নারী শিক্ষা একটি স্বাভাবিক ও অপরিহার্য ধারায় পরিণত হয়েছে।

সাম্প্রতিক কার্যক্রম: ২০২৫ সালের আগস্ট-সেপ্টেম্বর মাসে একাদশ শ্রেণির ভর্তি, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অনার্স পরীক্ষা, ক্রীড়া প্রতিযোগিতা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান আয়োজনের মধ্য দিয়ে কলেজটি তার শিক্ষামূলক কার্যক্রম অব্যাহত রেখেছে। আধুনিক তথ্য প্রযুক্তি ব্যবহার করে নোটিশ, ভর্তি বিজ্ঞপ্তি ও ফলাফল প্রকাশ করা হচ্ছে অফিসিয়াল ওয়েবসাইট ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে।

উপসংহার: সিলেট সরকারি মহিলা কলেজ কেবল একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নয়, বরং নারীশিক্ষার আলোকবর্তিকা। এ প্রতিষ্ঠানটি সিলেটের মেয়েদের শিক্ষার সুযোগ তৈরি করে সমাজে নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছে। প্রতিষ্ঠার পর থেকে অগণিত ছাত্রী এই কলেজ থেকে শিক্ষা অর্জন করে সারা দেশে এবং দেশের বাইরে সাফল্যের সাথে কাজ করছে। আগামী দিনে সিলেট সরকারি মহিলা কলেজ নারী শিক্ষার অগ্রযাত্রায় আরও বেশি অবদান রাখবে, এটাই প্রত্যাশা।

আপনার জেলার সংবাদ পড়তে