গুম হওয়া অনেকেই ২৪ এর ৫ আগস্টের পর আয়নাঘর থেকে ফিরে এসেছেন। সেই বিশ্বাসে আল-মুকাদ্দাসএর মা আয়েশা ছিদ্দিকা এখনো কানের কাছে মোবাইল ফোন নিয়ে শুয়ে থাকেন। এই বুঝি তাঁর ছেলে মুকাদ্দাস ফোন করে জানাবে, ‘মা আমি আসছি’। কিন্তু মুকাদ্দাস আসে না।
কুষ্টিয়া ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের আল-ফিকহ এন্ড ‘ল (এলএলবি) অনার্স ৪র্থ বর্ষের মেধাবী ছাত্র ছিল পিরোজপুর সদর উপজেলার খানাকুনিয়ারী গ্রামের অধ্যক্ষ মাওলানা আব্দুল হালিম এর জ্যেষ্ঠ পুত্র আল-মুকাদ্দাস। তিন ভাই-বোনের মধ্যে সে বড়। ছোট ভাই চট্টগ্রাম আই আই ইউ এর ছাত্র। ২০১১ সালের ১১ নভেম্বর একমাত্র বোন তাজরিয়ান জান্নাত এর বিয়ে শেষে ১৩ নভেম্বর মোকাদ্দেছ ফিরে যায় তার বিশ্ববিদ্যালয়ে। মুকাদ্দাস ছিলো ওই বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ইসলামী ছাত্র শিবিরের সাংস্কৃতিক সমপাদক।
মুকাদ্দাস ও তার বন্ধু ঝালকাঠী জেলার কাঠালিয়া গ্রামের ওয়ালিউল্লাহ ২০১২ সালের ২ ফেব্রুয়ারী ব্যক্তিগত কাজে ঢাকায় যায়। কাজ শেষে ৪ ফেব্রুয়ারী শনিবার রাত সাড়ে ১১ টায় ঢাকার কল্যাণপুর থেকে হানিফ পরিবহনের (ঝিনাইদাহ-৩৭৫০) বাসে ওঠে দুবন্ধু। বাসের সুপার ভাইজার মো: সুমন মিয়ার দেওয়া তথ্য অনুযায়ী বাসটি ছেড়ে আসার পর সাভারের নবী নগরে বাসটি থামিয়ে কালো পোষাক পরিহিত র্যাব- ৪ ও সাদা পোষাকের ৮-১০ জন ডিবি সদস্য বাসে উঠে মুকাদ্দাস ও ওয়ালিউল্লাহকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে বলে নামিয়ে নিয়ে যায়। জিজ্ঞাসাবাদ শেষে তাাদেরকে ছেড়ে দেওয়া হবে বলে একটি সাদা রং এর মাইক্রোবাসে তুলে নিয়ে যায়। মুকাদ্দাসএর বাবা জানিয়েছেন, বাসের সুপারভাইজার মো: সুমন মিয়া লক্ষ্য করেছেন র্যাবের নেতৃত্ব দেওয়া এক জনের নেইম প্লেটে
নাম লেখা ছিলো জামান।
ওদের বন্ধুরা জানতো ৫ ফেব্রুয়ারী ভোরে তাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে পৌঁছার কথা। কিন্তু তারা না পৌঁছায় পরে খোঁজ নিয়ে জানতে পারে র্যাব ও ডিবি পুলিশ দু’জনকে র্যাব-১ ও র্যাব-২ ক্যামেপর মাঝামাঝি এলাকা থেকে তুলে নিয়ে গেছে। ৬ ফেব্রুয়ারী বন্ধুরা মুকাদ্দেসের বাবাকে ফোন দিয়ে ঢাকায় যেতে বলে। র্যাব ও ডিবি পুলিশ কর্তৃপক্ষের সাথে যোগাযোগ করে ছেলের নিখোঁজের বিষয়ে কোনো সদোত্তর না পেয়ে ওই ৬ ফেব্রুয়ারীই মুকাদ্দেসের পরিবার নিশ্চিত হয় যে, তাকে গুম হয়েছে এবং ওই দিনই ঢাকার দারুসসালাম থানায় জিডি (নং-৩১৭) করেন। মুকাদ্দাস এর পরিবার মুকাদ্দাসকে হন্যে হয়ে খুঁজেছে।
ওর বাবা জানিয়েছেন তার ছেলেকে খুঁজতে র্যাবের এক লোক তাদেরকে বিভিন্ন জায়গায় ঘুরিয়েছে। ওই জায়গা গুলোকে তাদের কাছে মনে হয়েছে আয়না ঘর। মুকাদ্দাসের পরিবারের কাছে মনে হয়েছে সব আয়না ঘর পরিদর্শন করতে পারলে হয়তো কোনো আলামত পাওয়া যেত। ওই সময় তাদের কাছে মনে হয়েছে তারা তাদের ছেলেকে আর ফিরে পাবে না। র্যাব-১ এলাকায় খুঁজতে গিয়ে দেখে একজনকে কালো কাপড় দিয়ে মাথাসহ মুখমন্ডল ঢেকে এক রুম থেকে অন্য রুমে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। তখন তাদের মনে হয়েছে মুকাদ্দাস হয়তো ওই ক্যামেপই আছে। মুকাদ্দাসের পরিবার বলেছে তাদের ছেলেকে ওখানে রেখে নির্যাতন করা হয়েছে।
মুকাদ্দাস ও তার বন্ধু ওয়ালিউল্লাহকে ধরে কোথায় রাখলো, ওরা বেঁচে আছে নাকি মেরে ফেলা হয়েছে, মেরে ফেললে কোথায় তাদের দাফন করা হয়েছে, না আদৌ দাফনের ব্যবস্থা হয়নি স্বজনদের এসব প্রশ্নের সদোত্তর রাষ্ট্রের কেউ দিতে পারেনি। পুলিশ ও র্যাবসহ প্রশাসনের কাছে বারবার ধর্ণা দিয়ে, হাই কোর্টে রীট করে, এমনকি জাতীয় প্রেসক্লাবে সংবাদ সম্মেলন করে প্রধানমন্ত্রী ও আইনশৃংখলা বাহিনীর কাছে আকুল আবেদন জানিয়েও সন্ধান পাননি গুম হওয়া দু’শিক্ষার্থীর।
মুকাদ্দাসের বাবা আঃ হালিম জানিয়েছেন, জাতিসংঘের মানবাধিকার পরিষদের গুম বিষয়ক ওয়ার্কিং গ্রুপ বিভিন্ন সময়ে গুমের শিকার ৭৬ জনের একটি তালিকা দেয় বাংলাদেশ সরকারকে। ওই তালিকায় মুকাদ্দাস ও ওয়ালিউল্লাহর নাম থাকলেও আইনশৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনী গুমের বিষয় বেমালুম অস্বীকার করে। তবে মুকাদ্দাসের বাবা আঃ হালিম বলেন, যারা দেশের শত শত মানুষকে গুম করেছে তাদের বিচার দেখে যেতে চান তিনি।
গুম হওয়া ব্যক্তিদের সন্ধান ও ঘটনাগুলো তদন্তে গত বছরের ২৭ আগস্ট একটি কমিশন গঠন করেছিলো অন্তর্র্বর্তী সরকার। এরপর নতুন করে আশার আলো দেখেন মুকাদ্দাসের বাবা-মা। হয়তো ছেলে ফিরে আসবে, সেই পথপানে চেয়ে তার স্বজনরা।