ভোট গণনা ঘন্টার পর ঘন্টা থমকে থাকল; তৃতীয় দিনে গড়ালো জাকসু নির্বাচন

নিজস্ব প্রতিবেদক | প্রকাশ: ১৩ সেপ্টেম্বর, ২০২৫, ০২:০২ এএম
ভোট গণনা ঘন্টার পর ঘন্টা থমকে থাকল; তৃতীয় দিনে গড়ালো জাকসু নির্বাচন

বহুল প্রতীক্ষিত জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় শিক্ষার্থী সংসদ (জাকসু) নির্বাচন যে শুধু ভোটগ্রহণের অনুষ্ঠান নয়—সে কথা নির্বাচনী দিন ও তার পরের দুইদিনে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত শান্তিপূর্ণভাবে চলা ভোটাভুটির পরে কেন্দ্রীয় গণনা শুরু হতে বিলম্ব এবং পদ্ধতির আকস্মিক পরিবর্তনের ফলে বিশ্ববিদ্যালয়জুড়ে সন্দেহ, প্রতিবাদ ও মানবিক শোকে ভরা একটি পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। প্রশাসন, নির্বাচন কমিশন, প্রার্থীরা এবং বিভিন্ন ছাত্র সংগঠনের মধ্যে তীব্র অভিযোগ-প্রতিবাদের মাঝেই গণনা কার্যক্রম শনিবার (১৩ সেপ্টেম্বর) তৃতীয় দিন গড়ায়।

বৃহস্পতিবার (১১ সেপ্টেম্বর) সকাল ৯টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত অনুষ্ঠিত ভোটগ্রহণের পরে কেন্দ্রগুলো থেকে ব্যালট বাক্সগুলো সিনেট ভবনে নিয়ে আসা হয়; গণনা শুরু হয় রাতে, রাত প্রায় দশটার পরে। ভোটগ্রহণে মোট নিবন্ধিত ভোটার ছিলেন প্রাথমিক তথ্য অনুযায়ী ১১,৭৪৩ জন এবং কর্তৃপক্ষে উল্লেখ আছে মোট ভোটগ্রহণ হয়েছে প্রায় ৬৭ শতাংশ। প্রতি ভোটারকে কেন্দ্রীয় ও হল সংসদ মিলিয়ে একসঙ্গে একাধিক ব্যালট দেওয়া হওয়ায় গণনায় কাজের পরিমাণ ছিল অনেক বেশি; নির্বাচনী কর্মকর্তারা জানিয়েছিলেন, একজন ভোটারের জন্য তিনটি ব্যালট পেপার হওয়ায় অন্তত ২৫ হাজার ব্যালট গণনা করতে হবে—এটি সময়সাপেক্ষ ও শক্ত পরিশ্রমী একটি কাজ ছিল।

গণনা পদ্ধতিতে রাতারাতি সিদ্ধান্ত বদল এবং ওএমআর মেশিন থেকে হঠাৎ করে হাতে গণনায় ফিরিয়ে আনা—এই পরিবর্তনেই অনেকে পারস্পরিক অভিযোগ তুলেছেন। কমিশনের এক সদস্য মাফরুহী সাত্তার পরে অভিযোগ করে বলেন, মেশিন-ভিত্তিক গণনার সিদ্ধান্ত আগে নেওয়া হয়েছিল, কিন্তু কিছু অংশের আপত্তি বিবেচনায় নিয়ে ম্যানুয়াল গণনায় যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। এখানেই শুরু হয় বিতর্ক: অভিযোগ উঠেছে, সিদ্ধান্ত পরিবর্তন প্রক্রিয়ায় সব পক্ষের সঙ্গে পরামর্শ হয়নি এবং ফলে গণনায় অপ্রয়োজনীয় বিলম্ব ও অস্থিরতা দেখা দিয়েছে।

ফল প্রকাশে বিলম্ব ও গণনাকেন্দ্রে অভিযোগ-প্রতিবাদের জটিলতায় পরিস্থিতি আরও জটিল আকার নিলে বড় ধাক্কা হয়ে আসে এক অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার সংবাদ। শুক্রবার (১২ সেপ্টেম্বর) সকালে সিনেট ভবনের নির্বাচন কমিশন কার্যালয়ে গণনা তদারকি করতে প্রবেশের সময় চারুকলা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক জন্নাতুল ফেরদৌস মৌমিতা আকস্মিক অসুস্থ হয়ে পড়েন। দ্রুত তাকে হাসপাতালে নেওয়া হলেও কর্তব্যরত চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন। মৃত শিক্ষিকার আকস্মিকতার খবর বিশ্ববিদ্যালয়জুড়ে শোক ও ক্ষোভ তৈরি করেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের এক কর্মকর্তা অভিযোগ করেন যে গণনা পদ্ধতির পরিবর্তন এবং দীর্ঘ সময় ধরে চাপের মধ্যে কাজ করায় এ ধরনের বাস্তবিক বিপর্যয় ঘটেছে; রিটার্নিং অফিসার অধ্যাপক সুলতানা আখতার সরাসরি বলেছেন, ‘নির্বাচন কমিশনের অব্যবস্থাপনাই এ মৃত্যুর জন্য দায়ী।’ উপাচার্য গভীর শোক প্রকাশ করেছেন এবং বিধানগতভাবে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।

শুক্রবার (১২ সেপ্টেম্বর) দিবাগত রাতে নির্বাচন সংক্রান্ত অভিযোগ ও অসন্তোষকে কেন্দ্র করে আরও পরিবেশ উত্তপ্ত হয়। এই রাতে নির্বাচন কমিশনের সদস্য অধ্যাপক মাফরুহী সাত্তার নিজে সংবাদ সম্মেলনে জানিয়ে দেন যে তিনি পদত্যাগ করেছেন; তিনি বলেছেন, নির্বাচনের নানা অব্যবস্থাপনা ও অনিয়মের কারণে তিনি কমিশনে আর দায়িত্ব পালন করতে সক্ষম নন এবং গণনা শুরু হওয়ার আগে যে অন্যায়গুলোর সমাধান চাওয়া হয়েছিল, সেগুলো বিবেচনায় নেয়ার বদলে গণনা চালিয়ে গেলে তিনি দায়িত্বে থাকাই অনুচিত মনে করেন। তিনি উল্লেখ করেন যে তিনি ভোট গণনা আপাতত স্থগিত রাখার অনুরোধ জানিয়েছিলেন, কিন্তু তা মানা হয়নি — ফলে পদত্যাগের সিদ্ধান্ত নেন।

এই সব উত্তেজনার মধ্যেই বিভিন্ন ছাত্রপ্যানেল অনিয়মের অভিযোগ এনে ভোট বর্জনের ঘোষণা দিয়েছে এবং রাত জাগা গণনা-বিলম্বের বিরুদ্ধে ক্যাম্পাসে অবস্থান ও বিক্ষোভ গড়ে উঠেছে। ছাত্রদল সমর্থিত প্যানেল, স্বাধীন ও স্বতন্ত্র কিছু প্যানেল এবং সমন্বিত শিক্ষার্থী জোট—কয়েকটি গোষ্ঠী কর্তৃপক্ষের সিদ্ধান্ত ও পরিচালনায় অস্বস্তি প্রকাশ করেছে। একইসঙ্গে শিবির সমর্থকরা ফলাফল বিলম্ব ও গণনা প্রক্রিয়ার স্বচ্ছতার অভাব নিয়ে রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে সমাবেশ ও মিছিল করেছেন এবং ক্যাম্পাসেও তাদের প্রতিবাদ-প্রচেষ্টা ছিল চোখে পড়ার মতো।

নিরাপত্তা জোরদার করা ছিল প্রশাসনের প্রধান অগ্রাধিকার। নির্বাচনকালীন ও গণনার সময় প্রায় ১৫০০ জন পুলিশ সদস্য মোতায়েন করা হয় এবং র‍্যাব ও বিজিবির বিভিন্ন প্লাটুনও ক্যাম্পাসে স্থাপন করা হয়। প্রবেশপথ-গুলিতে চেকপোস্ট ও সিসি ক্যামেরা স্থাপন করে তৎপর ছিল কর্তৃপক্ষ, তবু গণনা প্রক্রিয়ার স্বচ্ছতা নিয়ে সন্দেহ ও অনাস্থা নিয়ন্ত্রণ করা সহজ হয়নি। নির্বাচন কমিশনের সদস্য সচিব এ কে এম রশিদুল আলম গণনা বিলম্বের কারণ হিসেবে প্রার্থীদের আপত্তি ও ম্যানুয়াল গণনায় রূপান্তর তুলে ধরেছেন এবং আশ্বাস দিয়েছেন দ্রুত ফলাফল প্রকাশের জন্য লোকবল কাজ করছে; তবে কমিশনও স্বীকার করেছে যে গণনা শেষ হতে সারারাত লাগতে পারে এবং চূড়ান্ত ফলাফল ঘোষণায় বিলম্ব হওয়া সম্ভব।

এই তফসে নির্বাচনের ফলাফলকে ঘিরে শিক্ষার্থীদের মধ্যে অনিশ্চয়তা ও উত্তেজনা যে দ্রুত ঝাড় হয়ে যাবে, তা বলা কঠিন। প্রার্থীরা ও তাদের সমর্থকেরা দ্রুততম সময়ে ফলাফল চেয়েছেন; আর প্রশাসন দাবি করেছে, স্বচ্ছতা ও যথাযথ প্রক্রিয়া নিশ্চিত করেই ফল ঘোষণা করবে।

আপনার জেলার সংবাদ পড়তে