হিজলায় দল ও সম্পত্তি কুক্ষিগত করার চাঞ্চল্যকর অভিযোগ

এফএনএস (মোঃ নুরনবী; হিজলা, বরিশাল) : | প্রকাশ: ২২ সেপ্টেম্বর, ২০২৫, ০৩:২৪ পিএম
হিজলায় দল ও সম্পত্তি কুক্ষিগত করার চাঞ্চল্যকর অভিযোগ

বরিশালের হিজলা উপজেলায় ক্ষমতা, স্বজনপ্রীতি এবং ব্যক্তিগত স্বার্থের সংমিশ্রণে এক চাঞ্চল্যকর ঘটনা উন্মোচিত হয়েছে, যা স্থানীয় রাজনীতিতে নতুন করে বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। অভিযোগ উঠেছে, একটি প্রভাবশালী পরিবার প্রথমে একটি রাজনৈতিক দলকে এবং পরবর্তীতে পুরো উপজেলাকে নিজেদের কুক্ষিগত করেছে। এই চক্রের শিকার হয়েছেন এশিয়ান টেলিভিশনের হিজলা প্রতিনিধি এবং স্থানীয় সেচ্ছাসেবক দল  নেতা মোঃ দুলাল হোসেন সরদার, যার পৈতৃক সম্পত্তি আত্মসাতের জন্য ষড়যন্ত্র করা হয়েছে।ষড়যন্ত্রের নেপথ্যে এক পরিবার এবং দলীয় কোন্দল

২০ সেপ্টেম্বর, ২০২৫ তারিখে এই প্রতিনিধির হাতে আসা দুটি লিখিত অভিযোগপত্র থেকে জানা যায়, মোঃ দুলাল হোসেন সরদার তার চাচাতো ভাইদের বিরুদ্ধে পৈতৃক সম্পত্তি গোপনে বিক্রির জন্য বায়নানামা চুক্তি ও সীমানা নির্ধারণের অভিযোগ করেন। এই বিষয়ে তিনি  হিজলা থানায় লিখিত অভিযোগ দাখিল করেন। অভিযোগের ভিত্তিতে হিজলা থানার তৎকালীন এসআই আরাফাত উভয় পক্ষকে নিয়ে সালিশের ব্যবস্থা করেন।

কিন্তু কোন ধরনের মিমাংসায় না পৌঁছে বাদী পক্ষের অজান্তে বিবাদীর পক্ষে একটি রায় লিখে দেয় শালিসগন।


এই সালিশে যে বিষয়গুলো সবচেয়ে বেশি চোখে পড়েছে, তা হলো সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের রাজনৈতিক পরিচয়। বাদীর পক্ষের সালিশ ছিলেন উপজেলা বিএনপি নেতা হানিফ দেওয়ান এবং সাবেক বড়জালিয়া ইউনিয়ন বিএনপির  সাধারণ সম্পাদক শাজাহান রেজা। অন্যদিকে, বিবাদী ফারুক সরদার, যিনি সদ্য ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগের গুয়াবাড়িয়া ইউনিয়ন এর ৫নং ওয়ার্ড শাখার সাধারণ সম্পাদক, তার সালিশ হিসেবে বেছে নেন গুয়াবাড়িয়া ইউনিয়ন বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক রিপন খান এবং হিজলা উপজেলা শ্রমিক দলের সভাপতি শাহীন খানকে। মজার বিষয় হলো, উভয় পক্ষের সালিশরাই বিএনপির পদধারী নেতা তবুও সেচ্ছাসেবক দল নেতার অভিযোগের ভিত্তিতে আয়োজিত শালিসির রায় তারা গোপনে আওয়ামীলীগের সাধারণ সম্পাদকের পক্ষে দিয়ে দেন ।

সালিশের সময় দুলাল সরদার নিয়মিত অর্থ ও আপ্যায়ন দিয়ে সহযোগিতা করলেও, কোনো ধরনের আলোচনা ছাড়াই সালিশরা বিবাদীর পক্ষে একতরফা রায় দেন। এতে দুলাল সরদার বিস্মিত ও ক্ষুব্ধ হন, কারণ তার দাবি ছিল সালিশি স্থগিত রাখা হয়েছিল। এই অপ্রত্যাশিত রায়ের পর দুলাল সরদার প্রশ্ন তোলেন, রাজনৈতিক সহকর্মী ও দলের নেতারা কীভাবে অর্থের বিনিময়ে অথবা অন্য কোনো কারণে তার বিরুদ্ধে গিয়ে মিথ্যের পক্ষে অবস্থান নিলেন?

রাজনৈতিক ক্ষমতা ও স্বজনপ্রীতির ভয়াবহ চিত্র

অনুসন্ধানে দেখা যায়, এই ঘটনার নেপথ্যে রয়েছে একটি পরিবার, যারা সুকৌশলে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের গুরুত্বপূর্ণ পদগুলো নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিয়েছে। হিজলা উপজেলা বিএনপির আহ্বায়ক গাফফার তালুকদার এবং তার পরিবার এই ক্ষমতার কেন্দ্রে রয়েছে। তাদের স্বজনপ্রীতির চিত্রটি দেখলে চোখ কপালে ওঠে:

উপজেলা কমিটি: উপজেলা বিএনপির আহবায়ক  গাফফার তালুকদারের বোনের ছেলে শাহীন খান হিজলা উপজেলা শ্রমিক দলের সভাপতি।  শাহীন খানের চাচাতো ভাই  আসাদুজ্জামান খান সজল উপজেলা স্বেচ্ছাসেবক দলের আহ্বায়ক, তার মা গুয়াবাড়িয়া ইউনিয়ন বিএনপির আহ্বায়ক (যিনি ১৫ বছরে কোনো রাজনৈতিক কার্যক্রমে প্রকাশ্যে আসেননি), তার বড় ভাই রিপন খান একই ইউনিয়নের সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক। অর্থাৎ একটি ইউনিয়নের গুরুত্বপূর্ণ দুটি পদ মা ও ছেলের দখলে।

ওয়ার্ড কমিটি: তার চাচা মজিদ খান ৫ নম্বর ওয়ার্ড বিএনপির সভাপতি এবং মামা ৬ নম্বর ওয়ার্ড বিএনপির সভাপতি।

অন্যান্য পদ: সজল খানের ভাইদের মধ্যে একজন সদ্য বিলুপ্ত গুয়াবাড়িয়া ইউনিয়ন যুবদলের সিনিয়র সহ-সভাপতি, আরেক ভাই উপজেলা যুবদল নেতা, আরেক ভাই সদ্য বিলুপ্ত গুয়াবাড়িয়া ইউনিয়ন স্বেচ্ছাসেবক দলের সিনিয়র সহ-সভাপতি।

 এমনকি ঢাকায় বসবাসকারী এবং রাজনৈতিক কার্যক্রমে নিষ্ক্রিয় দু'জন ভাই বরিশাল মহানগর ছাত্রদল ও জেলা ছাত্রদলের পদে আছেন।

ভাতিজা ও অন্যান্য: সজল খানের ভাতিজা ইউনিয়ন ছাত্রদলের সদ্য বিলুপ্ত কমিটির  সাধারণ সম্পাদক। এছাড়াও তার চাচাতো ভাই এবং খালাতো ভাইও বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে রয়েছেন।

গাফফার তালুকদারের নিজের তিন ছেলেও বিভিন্ন ছাত্র ও যুব সংগঠনের গুরুত্বপূর্ণ পদে রয়েছেন। এই পরিবারটি রাজনীতিতে এতটাই প্রভাবশালী যে, তাদের বিরুদ্ধে হাজার হাজার একর জমি দখল, টেন্ডারবাজি, অবৈধ বালু উত্তোলন, চাঁদাবাজি, মাদক ব্যবসা, গরু-মহিষ লুটপাটসহ বিভিন্ন অপরাধের অভিযোগ রয়েছে।

প্রভাবশালী মহলের পরিকল্পিত ষড়যন্ত্র

অনুসন্ধানে আরও জানা যায়, দুলাল সরদার একজন পেশাদার সাংবাদিক হিসেবে স্থানীয় প্রভাবশালীদের বিভিন্ন দুর্নীতি ও অনিয়মের বিরুদ্ধে নিয়মিত সংবাদ প্রকাশ করতেন। এই কারণে একটি প্রভাবশালী মহল তার উপর ক্ষিপ্ত ছিল। সেই মহলটি তাকে হেনস্তা করার জন্য পরিকল্পিতভাবে তার চাচাতো ভাইকে দিয়ে সম্পত্তি বিক্রির বায়না চুক্তি করায় গুয়াবাড়িয়া ইউনিয়ন শ্রমিক দলের সাধারণ সম্পাদক সাবের হোসেন মালতিয়ার সাথে, যিনি সজল খানের কর্মী হিসেবে পরিচিত । তাদের উদ্দেশ্য ছিল, দুলাল যেন ক্ষুব্ধ হয়ে কোনো ভুল পদক্ষেপ নেন এবং তাকে শায়েস্তা করার সুযোগ তৈরি হয়। কিন্তু দুলাল আইনি পথে হেঁটে তাদের ফাঁদে পা দেননি।

এই ঘটনার তদন্ত চলাকালে রহস্য আরও ঘনীভূত হয় যখন দেখা যায়, সালিশের সাথে জড়িত কিছু রাজনৈতিক নেতা ৩০০ টাকার স্ট্যাম্পে একটি দ্বিপাক্ষিক চুক্তিতে আবদ্ধ হয়েছিলেন কয়েক মাস পূর্বে। যেখানে তারা নিজেদের মধ্যে খাগেরচর মৌজার প্রায় ৭০ একর জমি ভাগ করে নিয়েছেন যেখানে বেশিরভাগ লোকই গাফফার তালুকদারের স্বজন। এই ৭০ একরের ভাগ বাটোয়ারানামায় দেখা যায় দুলাল সরদার এর পক্ষের শালিশগনের নামও।

এই জমির মালিকানার কোনো দাবি তারা ৫ আগষ্ট এর পূর্বে কখনও করেননি। দুলাল সরদার তার ফেসবুক পোস্টে এই চুক্তির আংশিক অংশ তুলে ধরে এর প্রতিবাদ করেছিলেন কয়েক মাস পূর্বে। 

এসআই আরাফাত এবং গোপন বৈঠক

এই পুরো ঘটনায় হিজলা থানার এসআই আরাফাতের ভূমিকা রহস্যজনক। সালিশি চলাকালে তার উপস্থিতি, সালিশ শেষে বাদী পক্ষের অভিযোগ ও অটলনামা ( অঙ্গীকারনামা) জমা না দেওয়া এবং তা হারিয়ে গেছে বলে দাবি করা এই প্রশ্ন তৈরি করে যে, তিনি কি এই ষড়যন্ত্রের অংশ ছিলেন?

উপজেলা স্বেচ্ছাসেবক দলের আহ্বায়ক আসাদুজ্জামান খান সজল নিজেই স্বীকার করেছেন যে, এসআই আরাফাত বদলি হওয়ার কারণে সাদ্দাম তালুকদারের বাসায় এক আপ্যায়নের আয়োজন করা হয়। এই অনুষ্ঠানে সজলও উপস্থিত ছিলেন, যেখানে জমি সংক্রান্ত বিষয় কীভাবে সমাধান করা যায়, তা নিয়ে আলোচনা হয়েছিল বলে অভিযোগ উঠেছে। সজল অবশ্য এই অভিযোগ অস্বীকার করে বলেছেন, সেখানে শুধু দাওয়াতে অংশগ্রহণ করা হয়েছিল। তবে সেখানে উপস্থিত ছিলেন শুধুমাত্র বিবাদী রাসেল সরদার, এস আই আরাফাত, সজল খান ও সাদ্দাম তালুকদার।  

দুটি বড় প্রশ্ন

এই পুরো ঘটনা দুটি বড় প্রশ্ন তুলে ধরে: ১. উপজেলা বিএনপির আহ্বায়ক গাফফার তালুকদার এই ঘটনায় কীভাবে জড়িত? জানা গেছে, ফারুক সরদারের ছোট ভাই রাসেল সরদার যিনি জমি বিক্রির বায়নানামা চুক্তি করেছিলেন, তিনি গাফফার তালুকদারের বড় ভাইয়ের ছেলে সাদ্দাম তালুকদারের ভায়রা ভাই। সাদ্দাম তালুকদার পুরো বিষয়টি সমন্বয় করেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে এছাড়াও যেখানে তার ভাগিনা শাহীন খান, রিপন খান ঘটনাস্থলে উপস্থিত থেকে সালিসিতে দলীয় প্রভাব বিস্তার করেছিলেন স্পষ্ট ভাবে । ২. গাফফার তালুকদার অপর এক ভাগিনা উপজেলা সেচ্ছাসেবক দলের আহবায়ক  আসাদুজ্জামান খান সজল সরাসরি কীভাবে এই ষড়যন্ত্রের সঙ্গে যুক্ত? যদিও তিনি প্রকাশ্য শালিসিতে কখনো উপস্থিত  ছিলেন না, তবে সাদ্দাম তালুকদারের বাসায় এসআই আরাফাতের সঙ্গে তার গোপন বৈঠক ও পরিকল্পনার মুল হোতা তাকেই ধরা হয়েছে কারন সেখানে জমি সংক্রান্ত বিষয় নিয়ে আলোচনার অভিযোগ তার ভূমিকা নিয়ে সন্দেহ তৈরি করেছে।

এই ঘটনা প্রমাণ করে যে, একটি পরিবার রাজনৈতিক ক্ষমতা ব্যবহার করে কীভাবে ভিন্নমতের মানুষের ব্যক্তিগত জীবন ও সম্পত্তি নিয়ে ষড়যন্ত্র করতে পারে। তাদের এই দখলদারিত্বের রাজনীতি শুধু দলকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে না, বরং সাধারণ মানুষের আইনি অধিকারকেও পদদলিত করছে।

আপনার জেলার সংবাদ পড়তে