বাংলাদেশের সামগ্রিক উন্নয়নে ঢাকাকেন্দ্রিক নগরায়ণ আজ এক গুরুতর সংকট। রাজধানীকে ঘিরে অতিরিক্ত জনসংখ্যার চাপ, যানজট, দূষণ ও অবকাঠামোগত সংকটে প্রতিবছর জাতীয় উৎপাদনে (জিডিপি) ৬ থেকে ১০ শতাংশ ক্ষতি হচ্ছে বলে বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করেছেন। অর্থাৎ আমরা যতটা অর্জন করছি, তার বড় একটি অংশ হারাচ্ছি শুধু রাজধানীর অতিরিক্ত ভার বহনের কারণে। পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের আয়োজিত সাম্প্রতিক আলোচনায় বক্তারা স্পষ্টভাবে বলেছেন, বিকেন্দ্রীকরণ ছাড়া কাঙ্ক্ষিত প্রবৃদ্ধি অর্জন সম্ভব নয়। ঢাকার বোঝা ভাগ করে নিতে হলে চট্টগ্রামসহ প্রান্তিক শহরগুলোকে শক্তিশালী করতে হবে। অথচ রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাবে কার্যকর পদক্ষেপ এখনো দৃশ্যমান হয়নি। ঢাকা আজ জনসংখ্যার ভারে নুইয়ে পড়েছে। প্রায় দুই কোটি মানুষের স্থায়ী বসবাসের পাশাপাশি প্রতিদিন দেড় কোটি মানুষের যাতায়াত রাজধানীকে অচল করে দিচ্ছে। এর ফলে কর্মক্ষমতা হ্রাস পাচ্ছে, নাগরিক সেবা ভেঙে পড়ছে, পরিবেশ দূষণ মারাত্মক আকার ধারণ করছে। এমন পরিস্থিতি টেকসই উন্নয়নকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে। বিশেষজ্ঞরা যথার্থই বলেছেন, বিকেন্দ্রীকরণ শুধু প্রশাসনিক পদক্ষেপ নয়, এটি মূলত রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের ব্যাপার। নদী দখল, খাল ভরাট বা জমি ব্যবস্থাপনায় দুর্নীতি বন্ধ করা কোনো প্রকৌশলীর কাজ নয়-এটি নীতি নির্ধারণের বিষয়। অথচ পরিকল্পনার ক্ষেত্রে জমিদারি মানসিকতা এখনও বিদ্যমান, যেখানে প্রকৃত ভোক্তা বা নাগরিকের স্বার্থ উপেক্ষিত হচ্ছে। কেবল ঢাকার চাপ কমাতে নয়, জাতীয় অর্থনীতির টেকসই প্রবৃদ্ধির জন্যও বিকেন্দ্রীকরণ অপরিহার্য। ঢাকার বাইরে বিনিয়োগ করলে বেশি রিটার্ন পাওয়া যাবে-এ গবেষণার ফলও নীতি নির্ধারকদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ বার্তা বহন করে। গ্রাম ও শহরের উন্নয়নকে সমান্তরালভাবে এগিয়ে নিতে না পারলে বৈষম্য আরও বাড়বে। প্রশ্ন হচ্ছে-কখন আমরা রাজনৈতিক সদিচ্ছা দেখাব? বিকল্প শহর গড়ে তোলা, আঞ্চলিক উন্নয়ন পরিকল্পনা বাস্তবায়ন, সড়ক-রেল-যোগাযোগ জোরদার, প্রশাসনিক কার্যক্রম জেলা শহরে সরিয়ে নেওয়া-এসব এখনই শুরু করতে হবে। নইলে ঢাকাকেন্দ্রিক অচলাবস্থা জাতীয় অর্থনীতিকে ক্রমশ দুর্বল করবে। দেশের প্রবৃদ্ধি রক্ষায় বিকেন্দ্রীকরণ এখন আর বিলাসিতা নয়; এটি সময়ের দাবি। রাজধানীর ক্লান্ত কাঁধ থেকে ভার নামাতে রাজনৈতিক সাহসিকতা ও দূরদর্শী পরিকল্পনা ছাড়া কোনো পথ খোলা নেই।