দুদক বরাবর অভিযোগ , ব্যবস্থা নিচ্ছে না বোর্ড কর্তৃপক্ষ

কুমিল্লা শিক্ষাবোর্ডে অবৈধ নিয়োগ বাণিজ্যে, ৪০ জনের তালিকা

এফএনএস (মোঃ হাবিবুর রহমান খান; কুমিল্লা) : | প্রকাশ: ৩০ সেপ্টেম্বর, ২০২৫, ০৪:৩৭ পিএম
কুমিল্লা শিক্ষাবোর্ডে অবৈধ নিয়োগ বাণিজ্যে, ৪০ জনের তালিকা

স্বৈরাচারী দোসররা এখনো কুমিল্লা শিক্ষাবোর্ডে সক্রিয় রয়েছে। স্বৈরাচারী দোসর সাবেক কুমিল্লা শিক্ষা বোর্ডের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক মো. জামাল নাছের ও সাবেক সচিব অধ্যাপক নূর মোহাম্মদের বিরুদ্ধে  ৪০ জনকে অবৈধভাবে অর্থের বিনিময়ে নিয়োগ দেয়া হয়েছে। যারা নিয়োজ পেয়েছেন তারা সাবেক কর্মকর্তাদের কথামতো কাজ করে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। এসব কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের বিরুদ্ধে অভিযোগ দেয়া হলেও কোন ব্যবস্থা নিচ্ছেন না বোর্ড কর্তৃপক্ষ। এ নিয়ে ক্ষোভ বিরাজ করছে বোর্ডে কর্মরত সকল কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের মাঝে।

এদিকে  সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক মো. জামাল নাছের ও সাবেক সচিব অধ্যাপক নূর মোহাম্মদের বিরুদ্ধে অবৈধ সম্পদ অর্জনের প্রাথমিক অনুসন্ধান শুরু করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। তদন্তে বোর্ডের আরও ১০ কর্মকর্তা-কর্মচারীকে ১৬ ও ১৭ মার্চ দুদকের কুমিল্লা কার্যালয়ে ডাকা হয়েছে। নোটিশে তাদের সাক্ষ্যগ্রহণের কথা বলা হয়েছে। তবে তদন্ত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, তারাও জড়িত এমন প্রমাণ পেলে তাদের বিরুদ্ধেও অনুসন্ধান শুরু করেছে দুদক। এ নিয়ে বিভিন্ন পত্রিকায় সংবাদ প্রকাশিত হয়। যে ১০ কর্মকর্তা-কর্মচারীর বক্তব্য শোনা হবে তারা হলেন, উপসচিব (প্রশাসন) এ কে এম সাহাবুদ্দিন, উপসচিব (একাডেমিক) মো. সাফায়েত মিয়া, সাবেক পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক ড. মো. আসাদুজ্জামান, সাবেক উপপরিচালক (হিসাব ও নিরীক্ষা) মোহাম্মদ ছানাউল্লাহ, সাবেক হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা মো. গোলাম হোসেন, সাবেক উপপরীক্ষা নিয়ন্ত্রক (মাধ্যমিক) মো. শহিদুল ইসলাম, সিনিয়র সিস্টেম অ্যানালিস্ট (কম্পিউটার শাখা) বিকাশ চন্দ্র মল্লিক, নিরাপত্তা কর্মকর্তা কেয়া রায়, দারোয়ান মো. আক্তার হোসেন ও ঠিকাদারী কর্মচারী মো. সজিব।

তাদের বক্তব্য শোনার পর সংশ্লিষ্টতা, সাক্ষ্য, না অভিযুক্ত, তা নির্ধারণ করা হবে। তবে এদের মধ্যে একাধিক পুরোনো কর্মকর্তা যারা বোর্ডে দীর্ঘদিন বিভিন্ন পদে ছিলেন, তাদের বিরুদ্ধেও অনিয়ম, অর্থ আত্মসাৎ, লুটপাটের অভিযোগ রয়েছে। দুদকের সমন্বিত কুমিল্লা জেলা কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক মো. তারিকুর রহমান ওই ১০ কর্মকর্তা-কর্মচারীকে হাজির হতে অনুরোধ জানিয়েছেন।

বোর্ডের সাবেক সচিব অধ্যাপক মো. নূর মোহাম্মদ ১৪ বছর ধরে এখানেই কর্মরত ছিলেন। তিনি প্রথমে উপসচিব ও পরে সচিব হন। ৫ আগস্টের পটপরিবর্তনের পর তাকে নোয়াখালী সরকারি কলেজে বদলি করা হয়। তিনি ওই কলেজে গণিতের বিভাগীয় প্রধান। কুমিল্লা শিক্ষা বোর্ড স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান। প্রেষণে কর্মকর্তার তিন বছরের বেশি থাকার নিয়ম নেই। ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় বাড়ি হওয়ায় সাবেক আইনমন্ত্রী আনিসুল হকের তদবিরে এত দীর্ঘসময় এখানেই ছিলেন। অধ্যাপক মো. জামাল নাছের চাকরি শেষের প্রায় দুই বছর বোর্ডের চেয়ারম্যান ছিলেন। তিনি এখান থেকেই অবসরে যান। তার আগে বিরতি দিয়ে তিনি বোর্ডের কলেজ পরিদর্শকও ছিলেন।

জামাল নাছের শিক্ষা বোর্ড চেয়ারম্যান হিসেবে যোগদানের পর ২০২৩ সালের ২১ সেপ্টেম্বর ৪১টি শূন্য পদে লোক নিয়োগে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করেন। ওই সার্কুলারে প্রথম থেকে চতুর্থ শ্রেণি পর্যন্ত প্রোগ্রামার, সহকারী প্রোগ্রামার, উপসহকারী প্রকৌশলী, নিরাপত্তা কর্মকর্তা, মসজিদের ইমামসহ বিভিন্ন পদে নিয়োগ আহ্বান করা হয়। শিক্ষা বোর্ডের সাবেক চেয়ারম্যান জামাল নাছের শ্বশুর বাড়ির মাহমুদুল হাসান ও মাজহারুল ইসলামকে অবৈধভাবে নিয়োগ দেয়া হয়। অভিযোগ উঠেছে, চেয়ারম্যান জামাল নাছের অবসরে যাওয়ার আগের দিন তড়িঘড়ি করে ৩৯ পদে নিয়োগ চূড়ান্ত করে যান। যাদের ওই সময় ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকারের মন্ত্রী, এমপিরা সুপারিশ করেছিলেন। এসব নিয়োগে অবৈধ লেনদেনেরও অভিযোগ রয়েছে। পোষ্য কোটা ১০ ভাগ থাকলেও কাউকে নিয়োগ দেওয়া হয়নি। এ নিয়ে চাকরিজীবীদের ক্ষোভ রয়েছে। আবেদনে বয়সও সঠিকভাবে মানা হয়নি।

অভিযোগ উঠেছে, মসজিদের ইমাম নিয়োগ দেওয়া হয়েছে চেয়ারম্যানের শ্বশুরবাড়ি কিশোরগঞ্জ এলাকার একজনকে। প্রতিবন্ধী কোটায় যাকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে তিনি কেমন প্রতিবন্ধী, তা দেখে বোঝার উপায় নেই। মুক্তিযোদ্ধা কোটায় নিয়োগ দেওয়া ব্যক্তিকে নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। আনসার-ভিডিপি সদস্য নিয়োগ পাওয়ার পর প্রশিক্ষণ নিয়ে সার্টিফিকেট জমা দিয়েছেন। অভিযোগ উঠেছে, তারা আগে প্রশিক্ষণ নেননি।

বোর্ড সূত্রে জানা যায়- অবৈধভাবে অর্থের বিনিময়ে ৪০ জনকে নিয়োগ দেয়া হয়েছে। তাদের মধ্যে সাবেক সচিব প্রফেসর নুর মোহাম্মদ নিজ জেলার প্রতিবন্ধী কোটায় অফিস সহকারী ইমরান হোসেনকে নিয়োগ দেয়া হয়। কিন্তু ইমরান হোসেন কোন প্রতিবন্ধী না এবং চাকুরীরও বয়স পেরিয়ে গেছে। এছাড়াও নিয়োগ কমিটির আহবায়ক ও পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক ড. আসাদুজ্জামান নিজ উপজেলা দেবিদ্বারের শাকিল আহমেদকে অফিস সহকারী হিসেবে নিয়োগ দেন।  জাবিবুল ইউসুফ সাবরী অফিস সহকারী হিসেবে তাকে নিয়োগ দেন।  কিন্তু জাবিবুল ইউসুফ সাবরীর প্রয়োজনীয় কাগজপত্র না থাকায় চাকুরী যোগদান করতে দেয়া হয়নি। পরবর্তীতে সাবেক মন্ত্রী দীপু ও চাঁদপুর জেলার পুরান বাজার কলেজের অধ্যক্ষ রতন কুমার এর সুপারিশে দুই মাস পর তাকে নিয়োগ দেয়া হয়। উপপরিচালক (হিসাব ও নিরীক্ষা) ও নিয়োগ কমিটির সদস্য মো: সানাউল্লাহ তিনি নিজ জেলা নোয়াখালীর হাতিয়ার সাব্বির হোসেনকে অফিস সহকারী পদে নিয়োগ দেন। উপ-সচিব (প্রশাসন) ও নিয়োগ কমিটির সদস্য একেএম সাহাব উদ্দিন তিনি সোহাগ চন্দ্র দাস ও শামীম হোসেনসহ দুইজনকে অফিস সহকারী হিসেবে নিয়োগ দেন।  উপ-কলেজ পরিদর্শক ও নিয়োগ কমিটির সদস্য বিজন কুমার চক্রবর্তী বিপ্লব শেখকে গাড়ী চালক নিয়োগ দেয়া হয়। অফিস অষ্টম শ্রেণীর পাশ চাওয়া হলে তিনি আইএস পাশ। কলেজ পরিদর্শক প্রফেসর জহিরুল ইসলাম পাটোয়ারী নিজ উপজেলা চৌদ্দগ্রামের জাকির হোসেনকে ইলেকট্রনিক্স পদে নিয়োগ দেন। উপ-পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক ও নিয়োগ কমিটির সদস্য শহিদুল ইসলাম  তিনি চন্দ্র মজুমদার ও  কেয়া রায়সহ প্রায় ৪০ জনকে অবৈধভাবে নিয়োগ দেয়া হয়। উল্লেখিত ৪০ জনের নিয়োগ পত্র পুলিশ তদন্তের কাগজপত্র ডাক এর মাধ্যমে আসার নিয়ম থাকলেও তারা নিজেরাই হাতে হাতে এসব কাগজপত্র নিয়ে আসেন।  নিয়োগ দেয়ার পূর্বে পরীক্ষার দিন প্রত্যেক নিয়োগ প্রাপ্তীদের কাছ থেকে ৫ লাখ টাকা থেকে শুরু করে প্রায় ২০ লাখ টাকা পর্যন্ত নিয়ে নিয়োগ প্রদান করেন। নিয়োগ দেয়ার পর এসব কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা সাবেক চেয়ারম্যান, সচিব, পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক, উপসচিবসহ তাদের যোগসাজসে এখনো অবৈধ নিয়োগ প্রাপ্ত কর্মকর্তা কর্মচারীরা তাদের কথামতো কর্মকান্ড চালিয়ে যাচ্ছেন। অবৈধ ৪০ জন কর্মকর্তা ও কর্মচারীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার জন্য আলমগীর হোসেন ও বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সদস্য আবির হোসেন সম্প্রতি কুমিল্লা দুর্নীতি দমন কমিশন, সমন্বিত জেলা কার্যালয়ে একটি অভিযোগ প্রেরণ করেন। অভিযোগ প্রেরনের পরও কুমিল্লা শিক্ষাবোর্ডের চেয়ারম্যান প্রফেসর মো: সামছুল ইসলাম  ও সচিব প্রফেসর মোহাম্মদ খন্দকার সাদেকুর রহমান কোন ব্যবস্থা নিচ্ছে না বলে অভিযোগ উঠেছে। 

এ নিয়ে কুমিল্লা শিক্ষাবোর্ডের কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের মধ্যে ক্ষোভ বিরাজ করছে। 

এ বিষয়ে বোর্ডের সাবেক চেয়ারম্যান জামাল নাছের বলেন, যেসব অভিযোগ উঠেছে তা ভিত্তিহীন ও হাস্যকর। জনবল সংকটে নিয়মিত কাজে সমস্যা হতো। অনেক দৌড়াদৌড়ি করে বোর্ডের কাজে গতিশীলতা আনতে নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করি। এটা এক ধরনের হয়রানি ছাড়া আর কিছুই নয়।

সাবেক সচিব নূর মোহাম্মদ বলেন- সুনামের সঙ্গে চাকরি করেছি। দুর্নীতি করিনি। কিছু লোক ইচ্ছাকৃতভাবে আমাদের বিরুদ্ধে কোনো প্রমাণ ছাড়াই এসব মিথ্যা অভিযোগ করেছে।

আপনার জেলার সংবাদ পড়তে