আমদানি এলএনজিতে গ্যাসের ঘাটতি মেটাতে পেট্রোবাংলার বিপুল পরিমাণ দেনা বাড়ছে

এফএনএস এক্সক্লুসিভ | প্রকাশ: ১ অক্টোবর, ২০২৫, ০৮:১০ এএম
আমদানি এলএনজিতে গ্যাসের ঘাটতি মেটাতে পেট্রোবাংলার বিপুল পরিমাণ দেনা বাড়ছে

আমদানি এলএনজিতে দেশের গ্যাসের চাহিদা মেটাতে গিয়ে পেট্রোবাংলার বিপুল পরিমাণ দেনা বাড়ছে। গ্যাস সংকট মেটাতে পেট্রোবাংলা ২০২৫-২৬ অর্থবছরে মোট ১১৫টি তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাসের (এলএনজি) কার্গো আমদানির পরিকল্পনা করেছে। আর ওই পরিমাণ কার্গো আমদানিতে অর্থবছরে প্রায় ৫৮ হাজার কোটি টাকা মোট ব্যয় প্রাক্কলন করা হয়েছে। অথচ স্থানীয় গ্যাস অনুসন্ধান জরিপ এবং কূপ খননে চলতি ও নতুন প্রকল্পে এডিপিতে মোট ১ হাজার ১২৯ কোটি টাকা বরাদ্দ রয়েছে। ওই হিসাবে চলতি অর্থবছরে এলএনজি আমদানিতে ব্যয় স্থানীয় গ্যাস অনুসন্ধান জরিপ ও কূপ খননে বরাদ্দের ৫১ গুণ। তবে দেশে গভীর কূপ খনন ও দ্বীপ জেলা ভোলায় গ্যাস কূপ খননে আরো ভিন্ন দুটি প্রকল্প অনুমোদন হয়েছে। সেখানে মোট ব্যয় ধরা হয়েছে ২ হাজার ১৫০ কোটি টাকা। আর সংশোধিত এডিপিতে ওসব হিসাব অন্তর্ভুক্ত হলে অর্থবছরে ওই খাতে বরাদ্দ আরো বাড়বে। জ্বালানি বিভাগ সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।

সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, বর্তমানে দেশে গ্যাসের চাহিদা ও সরবরাহে ঘাটতি রয়েছে অন্তত ১ হাজার মিলিয়ন ঘনফুট। তাই সারসহ বিভিন্ন গ্রাহকের গ্যাস সরবরাহে রেশনিং করতে হচ্ছে। গ্যাস ঘাটতি কমিয়ে আনতে পেট্রোবাংলা চলতি অর্থবছরে দীর্ঘমেয়াদি উৎস কাতার-ওমানসহ স্পট মার্কেট থেকে ১১৫টি এলএনজি কার্গো কিনবে। আর ওসব কার্গো আমদানি করা গেলে অর্থবছরে প্রতি মাসে সর্বনিম্ন ৮০০ মিলিয়ন থেকে সর্বোচ্চ ৯৭০ মিলিয়ন ঘনফুট এলএনজি গ্রিডে সরবরাহ করা যাবে। স্থানীয় ও আমদানীকৃত এলএনজি সরবরাহে গ্যাসের প্রতি ঘনমিটারে ২৭ টাকা ৫৯ পয়সা মোট মিশ্রিত ব্যয় হবে। আর চলতি অর্থবছরে গ্যাস বিক্রি করে ১০ হাজার ৫৭৮ কোটি টাকা ঘাটতি থাকবে। ওই ঘাটতির অর্থ মেটাতে এবং গ্যাসের সরবরাহ বাড়াতে ইতিমধ্যে পেট্রোবাংলার গ্যাস বিতরণ কোম্পানিগুলো গ্রাহকের গ্যাসের দাম বাড়ানোর জন্য বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনে (বিইআরসি) প্রস্তাব দিয়েছে এবং ওসব প্রস্তাব বর্তমানে মূল্যায়ন করছে কমিশন।

সূত্র জানায়, বিগত ২০১৮-১৯ অর্থবছর থেকে দেশের গ্যাসের ঘাটতি মেটাতে এলএনজি আমদানি করা হচ্ছে। ওই অর্থবছরে মোট ১৮ হাজার ৮১৩ কোটি টাকার এলএনজি আমদানি করা হয়। পর্যায়ক্রমে এলএনজি আমদানি বৃদ্ধির কারণে ২০২০-২১ অর্থবছরে আমদানি ব্যয় ছাড়িয়ে যায় ৪০ হাজার কোটি টাকা। ২০২৪-২৫ অর্থবছরে এলএনজি আমদানি ব্যয় ৪০ হাজার কোটি টাকার ওপরে ছিল। আর ২০২৫-২৬ অর্থবছরে পণ্যটি কিনতে ৫৭ হাজার ৯২৯ কোটি টাকা ব্যয়ের পরিকল্পনা করেছে পেট্রোবাংলা। এলএনজি আমদানির শুরুর অর্থবছরে আড়াই হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি থাকলেও শেষ হওয়া অর্থবছরে এলএনজিতে ৮ হাজার ৯০০ কোটি টাকা সরকার ভর্তুকি দিয়েছে।

সূত্র আরো জানায়, বিগত সরকারের আমলে দেশে গ্যাসের স্থানীয় উৎপাদন বাড়াতে ৫০টি কূপ খননের উদ্যোগ নেয়া হয়েছিলো। ওসব প্রকল্প এখনো চলমান। স্থানীয় গ্যাসের উৎপাদন ও অনুসন্ধানসংক্রান্ত জরিপ কার্যক্রমে চলতি ২০২৫-২৬ অর্থবছরে ৩টি প্রকল্পের আওতায় এডিপিতে ৩৪১ কোটি ৬৩ লাখ টাকা মোট বরাদ্দ রাখা হয়েছে। যদিও ওই তিন প্রকল্পে সরকার মোট ১ হাজার ৯৬৪ কোটি ৫০ লাখ টাকা ব্যয়ের প্রাক্কলন করেছে। হবিগঞ্জ-বাখরাবাদ ও মেঘনা গ্যাস ফিল্ডে থ্রিডি সিসমিক জরিপ প্রকল্পে মোট ব্যয় ধরা হয়েছে ৪৫৪ কোটি ২৫ লাখ টাকা। কিন্তু ২০২৫-২৬ অর্থবছরে এডিপিতে বরাদ্দ দেয়া হয়েছে ১২২ কোটি ৯৯ লাখ টাকা। প্রকল্পটি ২০২৫ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২৭ সালের জুন মেয়াদে বাস্তবায়িত হবে। তাছাড়া তিতাস ও কামতা গ্যাস ফিল্ডে চারটি মূল্যায়ন কাম উন্নয়ন কূপ খনন প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে পেট্রোবাংলা। ওই প্রকল্পে মোট ব্যয় হবে ১ হাজার ২৫৫ কোটি টাকা। ২০২৫-২৬ অর্থবছরে এডিপিতে ওই প্রকল্পের জন্য বরাদ্দ রাখা হয়েছে ২১৬ কোটি ৫০ লাখ টাকা এবং প্রকল্পটি ২০২৭ সালের সেপ্টেম্বরে শেষ করার লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে। তাছাড়া পেট্রোবাংলার কোম্পানি সিলেট গ্যাস ফিল্ডস লিমিটেড (এসজিএফএল) চলতি অর্থবছরে সিলেট ১২ নম্বর তেল কূপ খননের উদ্যোগ নিয়েছে। ওই কূপ খননে মোট ২৫৫ কোটি ২৫ লাখ টাকা ব্যয় হবে। কিন্তু ২০২৫-২৬ অর্থবছরে এডিপিতে ওই কূপ খননে ২ কোটি ১৪ লাখ টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে। প্রকল্পটির চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে ২০২৬ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত মেয়াদ ধরা হয়েছে। পাশাপাশি দেশে স্থানীয় গ্যাসের উত্তোলন বাড়াতে চলমান আরো চারটি প্রকল্প বাস্তবায়িত হচ্ছে। ওসব প্রকল্পে চলতি অর্থবছরে বরাদ্দ দেয়া হয়েছে ৭৮৭ কোটি টাকা। তার মধ্যে রয়েছে সুন্দলপুর-৪ ও শ্রীকাইল-৫ এবং দুটি অনুসন্ধান কূপ খনন। চলতি অর্থবছরে ওই প্রকল্পে বরাদ্দ দেয়া হয়েছে ৪২১ কোটি ৪২ লাখ টাকা। যেখানে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করতে মোট ব্যয় ধরা হয়েছে ৫৮৮ কোটি ৪০ লাখ টাকা। ব্লক ৭ ও ৯ নম্বরে টুডি সিসমিক সার্ভে প্রকল্পে চলতি অর্থবছরে বরাদ্দ দেয়া হয়েছে ১১২ কোটি ৭৩ লাখ টাকা। অথচ প্রকল্পটিতে মোট ব্যয় ধরা হয়েছে ২৩৪ কোটি ৯৮ লাখ টাকা। রশিদপুর ১১ নম্বর কূপ খননে চলতি অর্থবছরে বরাদ্দ দেয়া হয়েছে ৮৩ কোটি ৮৪ লাখ টাকা। কিন্তু ওই প্রকল্পে মোট ব্যয় হবে ২৭১ কোটি ৮৭ লাখ টাকা। তাছাড়া ডুপিটিলা-১ ও কৈলাসটিলা ৯ নম্বর অনুসন্ধান কূপ খনন প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে পেট্রোবাংলা। ওই প্রকল্পে চলতি অর্থবছরে মোট এডিপিতে বরাদ্দ দেয়া হয়েছে ১৬৮ কোটি ৮৭ লাখ টাকা কিন্তু প্রকল্পটির মোট ব্যয় ধরা হয়েছে ৬৪৬ কোটি ৪৮ লাখ টাকা। তার বাইরে চলতি বছরের ৭ আগস্ট তিতাস ও বাখরাবাদ গ্যাস ক্ষেত্রে দুটি গভীর অনুসন্ধান গ্যাস কূপ খননের জন্য চীনা প্রতিষ্ঠান সিএনপিসি ছুয়াংচিং ড্রিলিং ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানি লিমিটেডের (সিসিডিসি) সঙ্গে ৫৯৪ কোটি ২৫ লাখ টাকার একটি চুক্তি করেছে পেট্রোবাংলার কোম্পানি বাংলাদেশ গ্যাস ফিল্ডস কোম্পানি লিমিটেড (বিজিএফসিএল)। তাছাড়া চলতি মাসে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটিতে (একনেক) ভোলায় পাঁচটি কূপ খনন প্রকল্পের অনুমোদন দেয়া হয়। মোট ১ হাজার ৫৫৫ কোটি ৬৬ লাখ টাকায় ওসব কূপ খনন করবে পেট্রোবাংলার সাবসিডিয়ারি বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম এক্সপে­ারেশন অ্যান্ড প্রডাকশন কোম্পানি লিমিটেড (বাপেক্স)।

এদিকে পেট্রোবাংলা সংশ্লিষ্টদের মতে, স্থানীয় গ্যাসের অনুসন্ধান ও উত্তোলন বাড়াতে সরকার প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। এডিপিতে যে পরিমাণ কূপ খননের প্রকল্প দেখানো হয়েছে, তার বাইরে নতুন কূপ খনন প্রকল্প নেয়া হয়েছে। এরই মধ্যে তা একনেকে অনুমোদন দেয়া হয়েছে। তবে আরডিপিতে ওসব প্রকল্প যুক্ত হয়নি। সেগুলো যুক্ত করা হলে সেখানে বরাদ্দের পরিমাণ আরো বেড়ে যাবে। দেশে চলমান ৫০টি কূপ খনন প্রকল্পের পাশাপাশি সরকার আরো ১০০টি কূপ খননের উদ্যোগ নিয়েছে। ওসব কূপ খনন জ্বালানি বিভাগ আগামী বছর শুরু করে ২০২৮ সালের মধ্যে শেষ করতে চায়। ওই প্রকল্পে মোট ব্যয় হবে প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকা। পেট্রোবাংলার নিজস্ব অর্থায়ন ও গ্যাস উন্নয়ন তহবিল (জিডিএফ) অর্থ ওসব কূপ খনন ব্যয় করে করা হবে।

অন্যদিকে দেশে এলএনজি আমদানি করে গ্যাসের ঘাটতি মেটাতে এরই মধ্যে পেট্রোবাংলার বিপুল পরিমাণ দেনা তৈরি হয়েছে। বৈদেশিক ও স্থানীয় জ্বালানি খাতের কোম্পানিগুলোর কাছ থেকে ঋণ নিয়ে পেট্রোবাংলা আর্থিক ব্যয় মেটাচ্ছে। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর), অর্থ বিভাগ, বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি), ইন্টারন্যাশনাল ইসলামিক ট্রেড করপোরেশন (আইটিএফসি), বড়পুকুরিয়া কোল মাইনিং কোম্পানি লিমিটেড (বিসিএমসিএল), বাংলাদেশ গ্যাস ফিল্ডস কোম্পানি লিমিটেডের (বিজিএফসিএল) কাছে পেট্রোবাংলার মোট ২৮ হাজার ১৬ কোটি টাকার দেনা রয়েছে। তাছাড়া জিডিএফ থেকে কোম্পানিটি এলএনজি আমদানি করতে বড় অংকের ঋণ নিয়েছে।

এ বিষয়ে জ্বালানি সচিব মোহাম্মদ সাইফুল ইসলাম জানান, স্থানীয় গ্যাসের মজুদ ও উত্তোলন বাড়াতে আগের চেয়ে অনুসন্ধান কার্যক্রম জোরদার করা হয়েছে। কূপ খননে জিডিএফের অর্থও যেমন ব্যবহার করা হচ্ছে, তেমনি সরকার থেকে অর্থ বরাদ্দ বাড়ানো হচ্ছে। ফলে সামনের দিনগুলোয় যেহেতু কূপ খনন কার্যক্রম আরো বাড়বে, অর্থায়নও আরো বাড়ানোর চেষ্টা রয়েছে।