দুই শত বছরের ঐতিহ্য বীরগঞ্জের আদিবাসী মিলন মেলা

এফএনএস (আবুল হাসান জুয়েল; বীরগঞ্জ, দিনাজপুর) :
| আপডেট: ৩ অক্টোবর, ২০২৫, ০৫:৪৯ পিএম | প্রকাশ: ৩ অক্টোবর, ২০২৫, ০৫:৪৯ পিএম
দুই শত বছরের ঐতিহ্য বীরগঞ্জের আদিবাসী মিলন মেলা

দুপুর গড়িয়ে বিকেল। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ছুটে আসা মানুষের পদচারণায় মুখরিত দিনাজপুরের বীরগঞ্জ উপজেলার গোলাপগঞ্জ উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে তখন। কাঁচের চুড়ির টুংটাং শব্দ, ঢাক-ঢোলের বাজনা আর মাইক থেকে ভেসে আসা আদিবাসীদের গানের সুরের মুর্চনায় মেতেছে পুরো এলাকা। এ দৃশ্য যেন  দুইশত বছর হতে আসা অনন্ত এক উৎসব যা সকলের কাছে ‘বাসিয়া হাটি নামে বেশ পরিচিত। প্রতিবছর দুর্গা পূজার বিজয়া দশমীর পর দিন এ মেলায় দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে হাজার হাজার আদিবাসী ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর মানুষ ছুটে আসেন। মেলায় সবচেয়ে বেশি নজর কাড়ে তরুণ-তরুণীদের সাজসজ্জা। রঙিন শাড়ি, মাথায় ফুল, হাতে কাঁচের চুড়ি, ঠোঁটে লাল লিপস্টিক একেক জন যেন রঙের উৎসবে হারিয়ে যান তাদের নিজস্ব সংস্কৃতির ভেলায়। মেলার মাঠে দোকানের পসরা চোখে পড়ার মতো। কাঁচের চুড়ি, রঙিন ফিতা, ঝিনুক, মাটির পাত্র থেকে শুরু করে গৃহস্থালির দা-কুড়াল, হাঁড়ি-পাতিল সবই মেলে একসঙ্গে। 

এই মেলা শুধু কেনাকাটার আয়োজন নয় এ যেন ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর মানুষদের এক সামাজিক উৎসব ও মিলনমেলা। দিনভর চলে নাচ-গান, বাজনার তালে দলগত পরিবেশনা আর তরুণ-তরুণীদের আড্ডা। শুধু সাঁওতাল নয়, হিন্দু-মুসলিমসহ বিভিন্ন সমপ্রদায়ের মানুষও মেতে ওঠেন এই উৎসবে। মেলায় এত ভিড় হয় যে, মোবাইল নেটওয়ার্কও কাজ করতে হিমশিম খায়।

প্রতিবছরের মতো শুক্রবার বিকেল ৪টায় পর থেকে দিনাজপুর, ঠাকুরগাঁও, রাজশাহী, বগুড়া, পঞ্চগড় ও নীলফামারী হতে আসা সাঁওতাল সমপ্রদায়ের হাজারো নারী-পুরুষ ভিড় জমিয়েছেন উপজেলার গোলাপগঞ্জ উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে। সঙ্গে এসেছে অন্য সমপ্রদায়ের মানুষও। শতবর্ষের ঐতিহ্য ধরে চলে আসা এই মেলা ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর আত্মীয়-স্বজনদের মিলনমেলায় পরিণত হলেও এর বিশেষ আকর্ষণ হলো যুবকদের পছন্দের জীবনসঙ্গী খুঁজে নেওয়ার সুযোগ। এখানে যুবক যুবতীরা একে অপরকে পছন্দ হলে পরিবারের মাধ্যমে আলোচনার পরে বিয়ে হয় বলে এমন প্রচলন আছে এই মেলাকে ঘিরে।

মেলায় আসা আদিবাসী তরুনী এঞ্জিলিনা মার্ডি জানান, একটা সময় এই মেলায় জীবনসঙ্গী খুঁজে নেওয়ার প্রচলন ছিল বলে শুনেছি। তবে আধুনিকতার ছোঁয়ায় সব বদলে গেছে। এখন এই রীতিতে ভাটা পড়েছে।

সময়ের সঙ্গে আদিবাসীদের জীবনযাত্রার মান এখন অনেক পরিবর্তন হয়েছে। বেশিরভাগ আদিবাসী ছেলে-মেয়ে এখন স্কুলমুখী হয়েছে। কালের বিবর্তনে পুরোনো ঐতিহ্যগুলো অনেকটাই মুছে যেতে বসেছে। 

আদিবাসী সমাজ উন্নয়ন সমিতির আহ্বায়ক জোসেফ হেমরম বলেন,পুর্ব পুরুষেরা এই মেলা শুরু করে। আমরা শুধু ধারাবাহিকতা রক্ষা করে যাচ্ছি। তবে কবে থেকে এ মেলার প্রচলন শুরু হয়েছে সেটি সঠিক ভাবে বলা যাবে না। আনুমানিক ভাবে কয়েক শত বছর পুর্ব থেকে এ মেলা অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে এটি বাপ-দাদার কাছে শুনেছি। তবে বিয়ের বিষয়টি আগের মতো করে এখন আর হয় না। মেলা অনুষ্ঠিত হওয়ার ব্যাপারে এলাকার সকল ধর্ম ও বর্ণের মানুষ সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেয়।

এ ব্যাপারে অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি বিশিষ্ট সমাজ সেবক কেন্দ্রিয় কৃষক দলের নির্বাহী কমিটির সদস্য আলহাজ্ব মনজুরুল ইসলাম মনজু বলেন, এই মেলা আমাদের দীর্ঘ দিনের সম্প্রীতির নিদর্শন। এই মেলায় সকল ধর্ম ও বর্ণের মানুষ ছুটে আসে। এখানে আসা মানুষ খুঁজে পায় তাদের সংস্কৃতি ও সম্প্রীতির বন্ধন। কয়েক শত বছরের পুরনো এই মেলা যেন আমাদের আত্মার পরম আত্মীয় হয়ে উঠেছে। যেখানে শুধু স্নেহ ও ভালবাসার বন্ধনে আবদ্ধ থাকে আমাদের বিবেকবোধ।

আপনার জেলার সংবাদ পড়তে