নীলফামারীর সৈয়দপুরে অবস্থিত দেশের বৃহৎ রেলওয়ে কারখানা। এর আদলে গড়ে তোলা হয় সেতু কারখানা নামে আরেকটি কারখানা। আর ওই সেতু কারখানাটি বিলুপ্তির পথে। রেলওয়ে ব্রিজ ওয়ার্কশপ বা সেতু কারখানাটি বর্তমানে ১১ বছর ধরে বন্ধ রয়েছে। ফলে অচল হয়ে পড়েছে এ কারখানার সকল কার্যক্রম। কারখানাটি অচল হয়ে পড়ায় অযত্ন-অবহেলায় খোলা আকাশের নিচে নষ্ট হচ্ছে এখানকার হাজার কোটি টাকার যন্ত্রপাতি। শ্রমিক-কর্মচারীদের পদচারণা না থাকায় কারখানার পুরো চত্বর ঢেকে গেছে ঝোপঝাড় আর আগাছায়। তবে কয়েক মাস পুর্বে আগাছা পরিস্কার করা হলেও মুল্যবান যন্ত্রপাতি পড়ে আছে যত্রতত্র। সম্প্রতি ওই সেতু কারখানায় গিয়ে দেখা যায়, প্রধান ফটক বন্ধ। সাইটে খোলা রয়েছে অপ্রসস্ত একটি ছোট গেট। ওই গেটে নিরাপত্তা বাহিনী না থাকায় ভেতরে প্রবেশ করে এ প্রতিবেদক। তারপর একটু সামনে দেখা হল আনসার বাহিনীর দুই সদস্য। কেউ আছেন কিনা জানতে চাইলে তারা বললো অফিসে কেউ নেই। তবে একজন কর্মকর্তা থাকেন তিনি ছুটিতে আছেন।
১৮৭০ সালে ব্রিটিশ-ভারতের আসাম-বেঙ্গল রেলওয়ের ব্রডগেজ ও মিটারগেজ কোচ ওয়াগন মেরামতের জন্য সৈয়দপুরে প্রতিষ্ঠিত হয় ভারতীয় উপমহাদেশের অন্যতম বৃহৎ রেলওয়ে কারখানা। প্রায় একই সময়ে রেলওয়ে কারখানার উত্তর-পশ্চিমাংশ ঘেঁষে ১৮ একর জমিতে গড়ে তোলা হয় সৈয়দপুর রেলওয়ে ব্রিজ ওয়ার্কশপ। মেশিন শপ, পয়েন্টস অ্যান্ড ক্রসিং শপ ও গার্ডায় ইয়ার্ড শপ-এ তিনটি উপকারখানা নিয়ে সৈয়দপুর রেলওয়ের ব্রিজ ওয়ার্কশপ না সেতু কারখানা গড়ে ওঠে। সম্পূর্ণ ভিন্ন ব্যবস্থাপনায় একজন নির্বাহী প্রকৌশলীর তত্ত্বাবধানে পরিচালিত হয়েছে সৈয়দপুর রেলওয়ে ব্রিজ ওয়ার্কশপ। প্রতিষ্ঠার পর থেকে নকব্বই দশক পর্যন্ত প্রায় এক হাজার শ্রমিক-কর্মচারী নিযুক্ত ছিলেন ওই সেতু কারখানায়।
সেতু কারখানার অবসরপ্রাপ্ত এক কর্মচারী জানান, পশ্চিমাঞ্চল রেলস্টেশনগুলোর প্ল্যাটফর্মের শেড নির্মাণ ও রক্ষণাবেক্ষণ,রেললাইনের পয়েন্ট অ্যান্ট ক্রসিং,সেতুর গার্ডার, ট্রলি,মোটর-ট্রলি মেরামত,রেলওয়ে এলাকায় লোহার তৈরি ওভার হেড ওয়াটার ট্যাংক তৈরি,মেরামত,স্টেশন ফুটওভার ব্রিজের অ্যাঙ্গেল ফিটিংসহ ২৫ ধরনের যন্ত্রাংশ তৈরি হতো এ কারখানায়। কিন্তু ১৯৯২ সালে তৎকালীন বিএনপি সরকারের সময় রেলওয়ে সংকোচন-নীতির আওতায় গোল্ডেন হ্যান্ডশেকের ঘোষণা দেওয়া হয়। এর ফলে সুবিধা নিয়ে অনেক শ্রমিক-কর্মচারী চাকরি ছেড়ে দেন। এ ছাড়া নিয়মিত অবসর গ্রহণের কারণে তৎকালীন মঞ্জুরি পদ ১২৭ জনের বিপরীতে মাত্র ৬ জন শ্রমিক-কর্মচারী নিযুক্ত ছিলেন সেতু কারখানায়। তবে ধারাবাহিক অবসরের কারণে ২০২০ সাল থেকে একজন স্টোর মুন্সী,একজন খালাসি ও একজন পরিচ্ছন্নতা কর্মী মিলিয়ে মাত্র তিনজন সেতু কারখানা দেখাশোনা করছেন। দেখা যায় কারখানার তিনটি শপের (উপ-কারখানা) মধ্যে প্র্যাটফর্ম শেড বা নকশাঘরটি তালাবদ্ধ। ভেতরে আবর্জনার স্তূপ। পাশে মেশিন শেডটির চিত্রও একই রকম। এ ছাড়া খোলা আকাশের নিচে মাটির ওপরে অ্যাঙ্গেল,রড,স্কয়ার রড,কভার প্লেট,মিটার ও ব্রডগেজ লাইনের সেতুর স্পেয়ার গার্ডার,তিস্তা ও পাকশী হার্ডিঞ্জ ব্রিজের পরিত্যক্ত লোহা-লক্কড়,রেললাইনের পাত,একটি বিকল স্টিম ক্রেনসহ বিভিন্ন ধরনের লোহার মালামাল বিক্ষিপ্তভাবে ফেলে রাখা হয়েছে। এর ফাঁকে ফাঁকে জন্ম নিয়েছে গাছপালা। পুরো চত্বরজুড়ে ক্রা প্লেট ও কভার প্লেট ফেলে রাখায় সেগুলো মাটির আন্তর পড়ে ঢেকে গেছে।
সেতু কারখানার একজন অবসরপ্রাপ্ত উপসহকারী প্রকৌশলী জানান,এসব মালামালের আনুমানিক মূল্য হবে ৮শ থেকে হাজার কোটি টাকা।
এ ছাড়া জরাজীর্ণ অফিস ঘর ও বিশাল উচ্চতার শেডের মেঝেতে সারিবদ্ধভাবে পাঁচটি বড় এয়ার কম্প্রেসার মেশিন,তিনটি ওয়েল্ডিং প্লান্ট,উইন্স ক্রাব,তিনটি ডাইস মেশিন,দুটি লেদ মেশিন, বিদ্যুৎচালিত বেল্ড ড্রাইভিং তিনটি,একটি প্লেট কাটিং বা সেয়ারিং মেশিন,দুটি বড় হেমার মেশিন পরিত্যক্ত অবস্থায় নষ্ট হচ্ছে।
সৈয়দপুর রেলওয়ে সেতু কারখানার অবসরপ্রাপ্ত একজন সহকারী ব্রিজ ইঞ্জিনিয়ার বলেন,জনবল সঙ্কট ও কাঁচামালের অভাবে ১১ বছর ধরে এ সেতু কারখানাটি বন্ধ রয়েছে। এ ছাড়া কারখানার মেশিনপত্র অধিকাংশই মেয়াদোত্তীর্ণ ও নষ্ট হয়ে গেছে। নতুন মেশিন এনে কারখানাটিকে পূর্ণাঙ্গ রূপে চালু করতে গেলে চার হাজার কোটি টাকা প্রয়োজন। উর্ধ্বতন মহলে কারখানার বর্তমান অবস্থা জানিয়ে একাধিকবার চিঠি দেওয়া হয়েছে, কিন্তু তাতে কোনো সাড়া মেলেনি।
বাংলাদেশ রেলওয়ে জাতীয়তাবাদী শ্রমিক দল সৈয়দপুর কারখানা ওপেন লাইন শাখার সভাপতি আব্দুল করিম বলেন, এখানকার শ্রমিক-কর্মচারীদের রেলওয়ের অন্যান্য বিভাগে আত্তীকরণ করা হয়েছে। রেলওয়ের কিছু কর্মকর্তার মধ্যে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে কাজ করে পকেট ভরার প্রবণতার কারণে অস্তিত্ব সঙ্কটে পড়ে সৈয়দপুর রেলওয়ে সেতু কারখানা। এটি চালু করা অতীব প্রয়োজন। বেশি দামে বিভিন্ন যন্ত্রাংশ বিদেশ থেকে নিয়ে আসতে হয় অথচ এটি চালু হলে ওই সকল জিনিসপত্র এখানেই তৈরি করা যেত। এতে অনেক অর্থ সাশ্রয় হত।
বর্তমানে সেতু কারখানার তদারকির দায়িত্বে আছেন আইওডব্লিউ মোঃ শরিফুল ইসলাম। তিনি বলেন, প্রায় ১১ বছর থেকে কারখানাটি বন্ধ আছে। মধ্যখানে চালু করা হয়েছিল কিন্তু আবার বন্ধ হয়ে যায়। জনবল সংকট, মেশিন পত্রের মেয়াদ শেষ। নতুন ক্রয় করতে অনেক টাকার প্রয়োজন। উদ্ধতন কতৃপক্ষের অনুমতি ছাড়া চালু করা সম্ভব নয়।