সাংবাদিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করাটাও সংস্কার

মোমিন মেহেদী | প্রকাশ: ৮ অক্টোবর, ২০২৫, ০২:৫৪ এএম
সাংবাদিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করাটাও সংস্কার
মোমিন মেহেদী

‘তুই কোন হাত দিয়ে লিখিস, একটু দেখা’ বলেই কোপানো শুরু করে ঘাতকরা। আর এভাবেই ছাত্র-যুব-জনতার রক্তের উপর দাঁড়িয়ে একের পর এক খুন করছে ছাত্র-যুব-জনতার পাশাপাশি সাংবাদিক-কৃষক-শ্রমিকসহ বিভিন্ন শ্রেণি পেশার মানুষকে। কেবল এখানেই শেষ নয়; আমাদের মা- বোনদেরকে কখনো ধর্ষণ, কখনো নিপীড়ন-নির্যাতন আবার কখনো খুন করে ফেলে দিচ্ছে ছাত্র-যুব-জনতা বিরোধী- দেশ-সমাজবিরোধী চক্রটি। এদের কাছে গত ষোলো বছরও নিরাপদ ছিলো না বাংলাদেশ, এখনো নেই। কিন্তু অতীতের সরকার ফ্যাসিজম প্রতিষ্ঠায় ব্যস্ত থাকায় এদেরকে প্রতিহত করতে পারেনি, চলমান সরকার কি করছে। তাদের কাজই তো নীতি-আদর্শ-সংস্কার নিয়ে কাজ করা; তারা কি সেখানে ব্যর্থ? এমন প্রশ্ন সামনে চলে আসছে বারবার। প্রশ্ন ওঠারও যথেষ্ট কারণ আছে। অন্যতম কারণ হলো- আগেও পুলিশ মামলা নিতো না; এখনো নিচ্ছে না। যে কারণেই হয়ত সাংবাদিক এ এস এম হায়াত উদ্দিন হত্যাকাণ্ডের দুই দিন পর থানায় মামলা হয়েছে। তাঁর মা হাসিনা বেগম বাদী হয়ে সদর থানায় হত্যা মামলা করেছেন। এতে মো. ইসরাইল মোল্লাকে প্রধান আসামি করে সাতজনের নাম উল্লেখ করা হয়। অজ্ঞাতপরিচয় আসামি করা হয়েছে আরও ১০-১২ জনকে।

কি এক ভয়ংকর সময় এসেছে দেশে, যে সন্ধ্যার সময়ও মানুষকে খুন করছে ঘাতকরা। যতদূর জেনেছি- শুক্রবার সন্ধ্যায় হায়াত নিজ বাড়ির কাছেই সিদ্দিকের চায়ের দোকানে বসে চা পান করছিলেন। হঠাৎ তিনটি মোটরসাইকেলে করে ছয়-সাতজন সন্ত্রাসী এসে তাঁকে ঘিরে ধরে। তাদের একজন তাঁকে জিজ্ঞেস করে, ‘তুই কোন হাত দিয়ে লিখিস, সেই হাতটা একটু দেখা।’ বলেই দুর্বৃত্তরা এলোপাতাড়ি কোপাতে শুরু করে হায়াত উদ্দিনকে। হায়াত উদ্দিনের ওপর ধারালো অস্ত্র ও হাতুড়ি নিয়ে হামলা করে দুর্বৃত্তরা। স্থানীয় লোকজন তাঁকে উদ্ধার করে বাগেরহাট ২৫০ শয্যা জেলা হাসপাতালে নিয়ে যায়। অবস্থার অবনতি হলে খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হলে চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন। ধারালো অস্ত্রের কোপে মুহূর্তেই রক্তাক্ত হয়ে পড়েন হায়াত উদ্দিন। প্রাণভিক্ষার আকুতি জানানোর পরও থামেনি হামলাকারীরা। এক পর্যায়ে তিনি দৌড়ে পালানোর চেষ্টা করলেও মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। আতঙ্কিত লোকজন এগিয়ে আসারও সাহস পাননি। কি কারণে এমন নির্মম মৃত্যুর মুখোমুখি হয়ে হায়াত তাঁর জীবন হারালো? এলাকার মাদকের কারবার, ঠিকাদারি কাজের মান, রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়নসহ বিভিন্ন বিষয়ে সামাজিক মাধ্যমে প্রতিবাদী ছিলেন হায়াত উদ্দিন। এ জন্য কয়েক মাস আগেও তাঁর ওপর হামলা চালায় দুর্বৃত্তরা। 

সত্য-সুন্দর-সমৃদ্ধির প্রত্যাশায় শত শত মানুষ জীবন দিয়ে আজ যে পরিবর্তন এনেছে, সেই পরিবর্তনের পরও ফ্যাসিস্টদের আমলের মতই যদি দেশে সাংবাদিক খুন হতে থাকে, সাংবাদিকদের লাশ নদীতে ভাসতে থাকে; তাহলে বুঝে নিতে হবে বাংলাদেশ-সাংবাদিক বা বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ কেউ ভালো নেই। হয়ত এ কারণেই নিজেদের আমলে ঘটে যাওয়া ৮ সাংবাদিকের অপমৃত্যুর ঘটনা না দেখে কেবল অতীতের ফ্যাসিস্ট নিয়ে পরে আছে নতুন অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা-সচিব-নতুন দলের নেতারা। যে কারণে তাদের চোখে দেশে ২০০৯ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত ১৫ বছরে ৬১ সাংবাদিককে হত্যার তথ্য পরলেও মাত্র ১৩ মাসে ৮ সাংবাদিকের অপমৃত্যু বা ৬ শতাধিক সাংবাদিকের উপর হামলা আর ৪ শতাধিক সাংবাদিকের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক মিথ্যে মামলার তথ্য পরেনি। একই সময়ে হত্যা এবং নিপীড়নের শিকার হয়েছেন ৩ হাজার ৫৮৮ সাংবাদিক। হামলা-মামলা ও নির্যাতনের ৬৭ শতাংশ ঘটনায় তৎকালীন শাসক দলের নেতা-কর্মীরা জড়িত ছিলেন। 

সাংবাদিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত না করে, বেতন বাড়ানো বা কর্মসংস্থান বৃদ্ধির ব্যবস্থা না করে এক অনুষ্ঠানে তথ্য উপদেষ্টা বরং সংবাদমাধ্যম ও সাংবাদিকদেরকে এক রকমের ধমক দিয়ে বলেছেন- ‘আপনারা লেখেন, জনগণ আপনাদের দেখে নিবে। শহীদ ফ্যামিলি আপনাদের দেখে নিবে।...আপনারা ফ্যাসিবাদের পক্ষে সম্মতি উৎপাদন কইরেন না। আপনারা ফ্যাসিবাদের পক্ষে সম্মতি উৎপাদন কইরেন না।’ হয়ত এভাবে বাংলাদেশে সাংবাদিক ও সংবাদমাধ্যমকে সরকারের পক্ষ থেকে ধমক দেয়া হচ্ছে বলেই নতুন করে শত শত সাংবাদিককে হামলা করার ঘটনা ঘটছে। 

আমি মনে করি সংবাদমাধ্যম ও সাংবাদিকতা যেমন কোনো আলু-তরকারির ব্যাবসার মতো নয়; কিংবা সিমেন্ট বা টিস্যুেপপার বানানোর ব্যাবসা নয় যে এটা অতিমাত্রায় লাভজনক হতে হবে। তবে টিকে থাকার মতো আয় করতে হবে। এ জন্য টেকসই বিজনেস মডেল দরকার। সে জন্য সংস্কার কমিশন নীতিসহায়তার কথা বলেছে। গণমাধ্যম যদি পৃষ্ঠপোষকতার ওপর নির্ভর থাকে, তাহলে স্বাধীন গণমাধ্যমের চেহারা কখনো দেখা যাবে না।

একথা তো সত্য যে, গত ১৫-১৬ বছরের হত্যার ঘটনায় ৪৫ শতাংশ ক্ষেত্রে তৎকালীন ক্ষমতাসীন দলের নেতা বা ক্যাডারদের সংশ্লিষ্টতা পাওয়া গেছে। ৩২ শতাংশ ক্ষেত্রে হত্যাকারীরা ধরা পড়েনি। ১৫ শতাংশ ঘটনায় পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী জড়িত এবং ২৩ শতাংশ ক্ষেত্রে মাদক কারবারি ও সামাজিক অপরাধীরা জড়িত। 

অতীতের মত চলমান ড. ইউনূস সরকারের আমলেও সাংবাদিক খুন বা আহত করার ঘটনার কারণগুলোর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে গণতন্ত্রহীনতা, ভিন্নমত দমন, ক্ষমতা পাকাপোক্ত করার অপচেষ্টা, বিচারহীনতা, পেশাগত অবক্ষয়, সম্পাদকীয় প্রতিষ্ঠা ধসে পড়া, কতিপয় সাংবাদিকের দলবাজি, সাংবাদিক সংগঠনগুলোর মধ্যে বিভক্তি এবং মামলা হলে প্রতিষ্ঠানের অসহযোগিতা। পরিস্থিতি উত্তরণের জন্য গণতান্ত্রিক পরিবেশ নিশ্চিত করা, সাংবাদিক সংগঠনগুলোর মধ্যে ঐক্য গড়ে তোলা, সম্পাদকীয় প্রতিষ্ঠানগুলো শক্তিশালী করা, তৃণমূল সাংবাদিকতায় শৃঙ্খলা ফেরানো এবং সংবাদমাধ্যমকে সরকারের পক্ষ থেকে নীতিসহায়তা ও সুরক্ষা দেওয়ার মত সুচেষ্টা সমাধান করতে পারে অনেক সংকট। ১৫ বছরে বিশ্ব মুক্ত গণমাধ্যম সূচকে বাংলাদেশের ৪৪ ধাপ অবনমনের পর গত ১৩ মাসে সেই অবনমন থেকে কি বাংলাদেশ সামান্যও উত্তরণ ঘটাতে পেরেছে। পারেনি, কারণ একটাই এই দেশে সততার উদাহরণ টানতে পারে এমন কোনো মন্ত্রণালয় বা দপ্তর আর অবশিষ্ট নেই। যে কারণে আজ জাতির সামনে তিনটি ভুয়া নির্বাচনকে সংবাদ মাধ্যমগুলো চ্যালেঞ্জ না করে উৎসাহের সঙ্গে স্বীকৃতি দেয়ার মত করে অসাংবিধানিক একটি সরকারকে ক্ষমতায় রেখে বছরের পর বছর অগণতান্ত্রিক ক্ষমতা লিপ্সুদেরকে উৎসাহিত করছে। সেই সাথে অতীতের মত এখনো বিরোধী রাজনীতি নির্মূলে নিষ্ঠুরতম নিপীড়ন চললেও সংবাদমাধ্যম পেশাদার ভূমিকা রাখতে ব্যর্থ হচ্ছে। দুর্নীতি-লুটপাটের বিরুদ্ধে সাহসী সাংবাদিকতার পরিবর্তে অনেক ক্ষেত্রে সংবাদ প্রতিষ্ঠানগুলো সহযোগী ও অংশীদার হয়ে উঠছে আগের মতই। এমতাবস্থায় একটি সুষ্ঠু নির্বাচন যেমন জরুরি, তেমনই জরুরি গণমাধ্যমের টুটি চেপে না ধরে, সাংবাদিকদেরকে একের পর এক হত্যায় উৎসাহিত না করে কঠোর পদক্ষেপের মাধ্যমে অবাধ সুষ্ঠু সংবাদপ্রবাহ অব্যাহত রাখা। তা না হলে হয়ত বিশ্ববাসীও বলে উঠবে- পট পরিবর্তনেও বদলায়নি সাংবাদিকদের ভাগ্য। 

২০২৪ সালের ৫ আগস্টের পর থেকে গত এক বছরে দেশে অন্তত ৫ শতাধিক সাংবাদিক হয়রানির শিকার হয়েছেন সরকারের পক্ষ থেকে সাংবাদিক ও সংবাদমাধ্যম বিষয়ে দায়সারা পদক্ষেপ নেয়ার কারণে। সর্বশেষ সীতাকুণ্ডের জঙ্গল সলিমপুরে সংবাদ সংগ্রহ করতে গিয়ে দুর্বৃত্তদের হামলায় আহত হয়েছেন এখন টিভির চট্টগ্রাম ব্যুরো প্রধান হোসাইন জিয়াদ ও ক্যামেরাপারসন পারভেজ রহমান। তাঁদের চমেক হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। হামলাকারীদের ২৪ ঘণ্টার মধ্যে গ্রেপ্তারের দাবি জানিয়েছেন চট্টগ্রাম প্রেস ক্লাব ও সিএমইউজেসহ বিভিন্ন সাংবাদিক সংগঠনের নেতারা। আহত সাংবাদিক হোসাইন জিয়াদ গণমাধ্যমকে বলেন, ‘শনিবার দুই পক্ষের সংঘর্ষ হয়েছে সলিমপুরে। এই ঘটনার ফলোআপ সংবাদ করতে গিয়েছিলাম। এই সময় দুর্বৃত্তরা আমাদের ওপর হামলা করে। আমাদের কোনো কথাই তারা শুনতে চাইনি। তারা লাঠিসোঁটা ও গাছের ডাল দিয়ে আঘাত করেছে। হামলাকারীরা ক্যামেরা ভেঙে দিয়েছে। আমাদের মোবাইল ও মানিব্যাগ ছিনিয়ে নিয়েছে।’ এসব কেন হচ্ছে জানেন! একশ্রেণির ব্যক্তি নিজেরা অপসাংবাদিকতা করতে গিয়ে মামলার শিকার হয়ে বিদেশ গিয়ে নিজেদেরকে নিপীড়িত সাংবাদিক পরিচয় দিয়ে আশ্রয় নিয়ে এখন সারাদেশে সাংবাদিকতার নামে অপসাংবাদিকতাকে ছড়িয়ে দিচ্ছেন। বিশেষ করে শেখ হাসিনার সরকারের পতনের পর তারা সেই অপসাংবাদিকতাকে পুঁজি করে গড়ে তুলেছেন একের পর এক বিভিন্ন সংবাদমাধ্যম প্রতিষ্ঠান। যে সকল প্রতিষ্ঠানে সাংবাদিকতা হয় যতটা; তার চেয়ে বেশি হয় এক্টিভিজম। আর এসবের কারণেও ‘সাংবাদিক’ মানেই ‘সাংঘাতিক’ ধারণ নির্মিত হচ্ছে ছাত্র-যুব-জনতার একটি অংশের ভেতর-বাহিরে। সেই সাথে ফ্যান্সে বসা সাংবাদিক-রাজনীতিকদের মহাগুরু দাবিকারী ব্যক্তির অশ্লীল বাক্যবাণের এটিভিজমও যথেষ্ট ক্ষতি করেছে সাংবাদিক ও সংবাদমাধ্যমের। এখন যে কেউ চাইলেই আমেরিকা, ইউকে বা ফ্যান্সে বসা অ্যাক্টিভিস্টদের মত করে নেমে যাচ্ছে সাংবাদিক-সংবাদমাধ্যমের চৌদ্দগোষ্ঠি উদ্ধার করতে। তাতেই সমাজে নেমেছে চরম বিশৃঙ্খলা। তাদের উদ্দেশ্যে বলতে চাই- দেশকে ভালোবাসুন। আমি মৃত্যূঘর থেকে ফিরে এসেছি। আমি জানি দেশকে ভালোবাসলে ইতিহাস হবেন, তা না হলে হারিয়ে যাবেন; যতই জনপ্রিয় হোন না কেন...

একটা সময় ছিলো সাংবাদিক ও সংবাদমাধ্যমকে মানুষ শ্রদ্ধা করতো। আর এখন নির্যাতন করে-নিপীড়ন করে আবার কখনো সখনো খুনও করে। রাষ্ট্রের উসকানিতে অতীতেও এমন ঘটনা ঘটেছে, এখনো ঘটছে। অতএব, বরাবরের মত সবার আগে চতুর্থ স্তম্ভকে ঠিক রাখতে রাষ্ট্রকেই নিতে হবে দায়িত্ব। তাহলে হয়ত পুরানো সেই সম্মান ফিরে পাবে বাংলাদেশে সংবাদমাধ্যম ও সাংবাদিকগণ। যারা রক্ত-শ্রম- মেধা দিয়ে দেশকে এগিয়ে নিতে চান প্রতিনিয়ত...

লেখক: মোমিন মেহেদী

আপনার জেলার সংবাদ পড়তে