গণঅভ্যুত্থানে বিগত সরকারের পতনের পর বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার নানা খাতে সংস্কারের উদ্যোগ নেয়। সেই ধারাবাহিকতায় জনপ্রশাসন সংস্কারের জন্য একটি কমিশন গঠন করা হয়। কমিশন তাদের কাজ শুরু করার পর বেশ কিছু সুনির্দিষ্ট সুপারিশমালা তৈরি করে সরকারের কাছে জমা দেয়। শুরুতে সরকার ঘোষণা দিয়েছিল, এসব সুপারিশ দ্রুত বাস্তবায়ন করা হবে। কিন্তু বাস্তবে দেখা যাচ্ছে, বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া থমকে আছে। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় ও মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সূত্র বলছে, আইনি জটিলতা, আদালতে মামলা, কর্মকর্তাদের মধ্যে অভ্যন্তরীণ কোন্দল, জাতীয় সংসদ কার্যকর না থাকা, বিদ্যমান ক্যাডার বৈষম্য, আন্তমন্ত্রণালয়ের সমন্বয়হীনতা এবং বাজেট বরাদ্দের জটিলতাসহ নানা কারণে সুপারিশগুলোর বেশিরভাগই বাস্তবায়নের পথে অগ্রসর হচ্ছে না। অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে কয়েকটি সুপারিশ দ্রুত বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেওয়া হলেও সেসব কাজও চলছে ধীরগতিতে। কমিশনের যেসব প্রস্তাব প্রশাসনিক মন্ত্রণালয় নিজ উদ্যোগে বাস্তবায়ন করতে পারে, সেগুলো দ্রুত বাস্তবায়নের জন্য প্রধান উপদেষ্টা নির্দেশনা দিয়েছিলেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ গত মে মাসে একটি চিঠি বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগে পাঠায়। কিন্তু সেই কাজও সেভাবে এগোয়নি। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে পুরো প্রশাসন এখন নির্বাচনের অনুকূলে মাঠ গোছানোর কাজে ব্যস্ত। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় ও মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ ব্যস্ত সময় পার করছে জেলা প্রশাসক, পুলিশ সুপার, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও বিভাগীয় কমিশনার পদে যোগ্য কর্মকর্তাদের পদায়নের কাজে। সমপ্রতি প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন, সরকারের মাথায় এখন একটাই টার্গেট—আগামী বছরের ফেব্রুয়ারিতে জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত করা। তিনি বলেন, কোনো শক্তি সরকারকে এই টার্গেট থেকে বিচ্যুত করতে পারবে না। এমন পরিস্থিতিতে কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়নের বিষয়টি নিয়ে এই মুহূর্তে প্রশাসনের মাথা ঘামানোর সুযোগ নেই। এদিকে, জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের দেওয়া দুই শতাধিক সুপারিশের মধ্যে অনেকগুলোই বাস্তবায়নযোগ্য নয় বলে মন্তব্য করেছেন বিশেষজ্ঞরা। তাদের মতে, পরীক্ষার মাধ্যমে প্রশাসন ও অন্য ক্যাডার বা প্রস্তাবিত সার্ভিসের কর্মকর্তাদের ফিফটি-ফিফটি পদোন্নতির বিষয়টি আদালতের রায়ের সঙ্গে সম্পৃক্ত। আবার দেশকে চারটি প্রদেশে ভাগ করে প্রাদেশিক সিস্টেম চালু করার প্রস্তাবও এসেছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এ ধরনের প্রস্তাব বাস্তবায়ন করলে বিভিন্ন গোষ্ঠীর মধ্যে স্বাধীনতা আন্দোলন মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে পারে, বিশেষ করে পাহাড়ি অঞ্চলে। এছাড়া প্রাদেশিক সিস্টেম চালু করতে কয়েক লাখ কোটি টাকার প্রয়োজন, যা রাষ্ট্রের পক্ষে বহন করা সম্ভব নয়। প্রদেশ বা সিটি গভর্নমেন্ট করলে প্রশাসন আরও মাথাভারী হয়ে উঠবে এবং সরকারের কলেবর বাড়বে। বিশেষজ্ঞদের অভিমত, স্বাধীন জনপ্রশাসন, পুলিশ, বিচার বিভাগ এবং সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর সরকারের খবরদারি শূন্যের কোঠায় নিয়ে আসতে পারলেই অনেক সমস্যার সমাধান হবে। ক্যাডারগুলো ভেঙে ছোট করা হলে জনপ্রশাসনে বিশৃঙ্খলা ছড়িয়ে পড়তে পারে। পরীক্ষার মাধ্যমে পদোন্নতি পদ্ধতি চালু হলে কর্মকর্তারা পরীক্ষার পেছনে সময় ব্যয় করবেন, ফলে জনসেবা মারাত্মকভাবে বিঘ্নিত হবে। এছাড়া সব সুবিধাসহ মাত্র ১৫ বছর চাকরি করার পর অবসরের প্রস্তাবও অনেকের কাছে অগ্রহণযোগ্য। এ অবস্থায় কবে নাগাদ এসব সুপারিশ বাস্তবায়ন করা সম্ভব হবে, তা কেউই নিশ্চিত করে বলতে পারছেন না। এদিকে, কমিশনের আরেকটি আলোচিত প্রস্তাব হলো জেলা প্রশাসক ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার পদবি পরিবর্তন। সুপারিশে বলা হয়েছে, জনপ্রশাসনের কার্যকারিতা ও স্বচ্ছতা বৃদ্ধি, দুর্নীতি দমন, সুশাসন প্রতিষ্ঠা, জনগণের সেবাপ্রাপ্তি সহজ করা, স্থানীয় সরকারগুলোর ক্ষমতা বৃদ্ধি এবং প্রশাসনে দক্ষতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করতে ডিসি ও ইউএনও’র পদবি পরিবর্তন করা উচিত। প্রস্তাব অনুযায়ী, ডিসি’র নতুন পদবি হবে জেলা ম্যাজিস্ট্রেট বা জেলা কমিশনার এবং ইউএনও’র নতুন পদবি হবে উপজেলা কমিশনার। অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব)-এর পদবি পরিবর্তন করে অতিরিক্ত জেলা কমিশনার (ভূমি ব্যবস্থাপনা) করার প্রস্তাবও এসেছে। তবে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা মনে করেন, শুধু পদবি পরিবর্তন করে জনসেবা নিশ্চিত করা যায় না। কমিশনের ১৮টি সংস্কার প্রস্তাবকে আশু বাস্তবায়নযোগ্য হিসেবে বাছাই করা হয়েছিল। গত ১৬ জুন প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত সভায় এগুলো বাছাই করা হয়। এর মধ্যে ৮টি অপেক্ষাকৃত সহজে বাস্তবায়নযোগ্য বলে ধরা হয়েছিল। এগুলো হলো- মহাসড়কের পেট্রল পাম্পগুলোতে স্বাস্থ্যসম্মত টয়লেট স্থাপন, মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটকে ডায়নামিক করা, কলেজ ও মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ম্যানেজিং কমিটি গঠন, কমিউনিটি স্বাস্থ্যকেন্দ্র পরিচালনা, গণশুনানি, তথ্য অধিকার আইন সংশোধন, বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো পুনর্গঠন এবং ডিজিটাল রূপান্তর ও ই-সেবা। কিন্তু এই ৮টি সুপারিশও বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে সন্তোষজনক অগ্রগতি হয়নি। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোকে ‘বাংলাদেশ পরিসংখ্যান কমিশন’ হিসেবে রূপান্তরের প্রস্তাবও বাস্তবায়ন হয়নি। বিশ্বব্যাংকের সহায়তায় চলমান সংস্কার কার্যক্রমের সঙ্গে কমিশনের সুপারিশ সমন্বয় করার কথা থাকলেও এ বিষয়ে কোনো কাজ শুরু হয়নি। ডিজিটাল রূপান্তর ও ই-গভর্নমেন্ট ব্যবস্থা শক্তিশালী করার কাজও এগোয়নি। সাবেক এক কেবিনেট সচিব নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানিয়েছেন, কমিশনের অনেক সুপারিশই গায়েবি সুপারিশের মতো মনে হয়। এগুলোর বেশিরভাগ বাস্তবায়ন সম্ভব নয়। বিষয়গুলো সময়সাপেক্ষ এবং ব্যয়বহুল। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের মেয়াদ সাধারণত কম হয়, তাই এত অল্প সময়ে এসব বাস্তবায়ন সম্ভব নয়। অনেক সুপারিশ বাস্তবায়নের জন্য সংসদের অনুমোদন প্রয়োজন, কিন্তু সংসদ না থাকায় তা অসম্ভব। সংস্কার কমিশনের প্রধান আব্দুল মুয়ীদ চৌধুরী বলেছেন, আমরা সরকারের কাছে সুপারিশ জমা দিয়েছি। এগুলো বাস্তবায়নের কাজ সরকারের। সরকার তার সাধ্য, সামর্থ্য ও সময় অনুযায়ী সুপারিশগুলো বাস্তবায়ন করবে। সব যে একসঙ্গে বাস্তবায়ন করতে হবে, তেমন কোনো নির্দেশনা আমাদের পক্ষ থেকে নেই।