এবার পদ্মায় মা মাছ ডিম ছেড়েছে বেশি, তবে সর্বনাশ হচ্ছে কারেন্ট জালে পোনা মাছ শিকার করায়।রাজশাহীর চারঘাট, বাঘা, মতিহার, বোয়ালিয়া, রাজপাড়া, পবা এবং গোদাগাড়ী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর এবং শিবগঞ্জ উপজেলায় প্রতিদিন কয়েক হাজার জেলে প্রতিদিন নিষিদ্ধ কারেন্ট জাল দিয়ে পদ্মা নদীতে মাছ শিকার করছেন। অধিকাংশক্ষেত্রেই এখন পোনা মাছই বেশি ধরা পড়ছে। এসব জেলের জালে একেবারে ছোট থেকে ধরা পড়ছে সর্বোচ্চ ওজনের মাছটিও। এসব পোনা মাছে রাজশাহী এবং চাঁপাইনবাবগঞ্জের বাজারও সয়লাব হয়ে গেছে। কিন্তু কারেন্ট জাল বন্ধ করা যাচ্ছে না। ফলে প্রতিদিন কোটি কোটি পোনা ধরা পড়ছে জেলেদের জালে।
সম্প্রতি রাজশাহীর গোদাগাড়ীতে এক জেলের অবৈধ কারেন্ট জালে একসঙ্গে ধরা পড়ে পাঙ্গাস মাছের ২২ কেজি ছোট ছোট পোনা। ৩-৪ ইঞ্চি পরিমাণের ওই পোনাগুলো জেলে পরে মাত্র ৫০ টাকা কেজি দরে বিক্রি করে দেন। অথচ এই পোনাগুলো তিনমাস পরেও ধরা পড়লে একেকটির ওজন হতো অন্তত ৫০০ গ্রাম করে। যা কমপক্ষে ১০০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হতো। আর মাছগুলোর দাম পাওয়া যেত কমপক্ষে ৫০ হাজার টাকা। কিন্তু অকালেই ধরা পড়ার কারণে ২২ কেজি ওই পোনা মাছ গুলো মাত্র ১১শ টাকায় বিক্রি করতে বাধ্য হোন গোদাগাড়ীর পিরিজপুর এলাকার ওই জেলে।
পদ্মায় সরেজমিন গিয়ে জেলে ও স্থানীদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, এবার পদ্মায় বেশি সময় ধরে পানি স্থির ছিল। ফলে মা মাছ এবার বিপুল পরিমাণ ডিম ছেড়েছে। এতে করে গত কয়েক বছরের মধ্যে এবার সর্বোচ্চ পোনার দেখা মিলছে পদ্মায়। কিন্তু নিষিদ্ধ কারেন্ট জালের কারণে সর্বনাশ হচ্ছে সেসব পোনা মাছের। অধিকাংশ জেলেই নিষিদ্ধ কারেন্ট জাল দিয়ে মাছ শিকার করছেন। ফলে পোনাসহ সব ধরনের মাছই ধরা পড়ছে জালে। জেলের জালে যে পরিমাণ মাছ আসছে তার নব্বই ভাগই পোনা মাছ। যা আগামী তিন থেকে ছয় মাসের মধ্যেই এসব মাছ পরিপক্ক হতে পারত। কিন্তু কারেন্ট জালের কারণে প্রতিদিন কোটি কোটি পোনা নির্বিচারে ধরা পড়ছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক গোদাগাড়ীর রেলবাজার এলাকার এক জেলেদের একজন সর্দার বলেন, আমরা কোনোভাবেই কারেন্ট জালকে নিরুতসাহিত করতে পারছি না। বরং দিনের পর দিন এ জালের সংখ্যা বেড়েই চলে পদ্মায়। এখন অন্তত ৯০ ভাগ জেলেই কারেন্ট জালে মাছ শিকার করছেন। এতে করে এবার বিপুল পরিমাণ পোনা মাছ দেখা গেলেও সেই মাছই ধরা পড়ছে বেশি।
ওই জেলে সর্দার আরও বলেন, বেশি না যদি তিন মাস আমরা পোনা মাছ ধরা বন্ধ রাখতে পারি, তাহলে এবার প্রতিটি জেলেই তিন মাস পরে একেকদিন অন্তত ১০ হাজার টাকার করে মাছ ধরতে পারবে। কিন্তু জেলেদের লোভের কারণে কারেন্ট জালে এখনোই জালে আটকা পড়ছে বিপুল পরিমাণ পোনা মাছ। ফলে এবার যে পরিমাণ পোনা নদীতে দেখা যাচ্ছে তিন মাস সেই সুযোগটি আমরা হাতছাড়া করে ফেলছি। দেশের সম্পদও নষ্ট করছি।’
পিরিজপুর এলাকার এক জেলে নজরুল ইসলাম বলেন, শুধু গোদাগাড়ীতেই আছে অন্তত ৫ হাজার জেলে। এই জেলেদের অধিকাংশই প্রতিদিন কারেন্ট জালে মাছ শিকার করছেন। প্রশাসনকে ম্যানেজ করেই জেলেরা নির্বিঘ্নে কারেন্ট জালে মাছ ধরছেন। ফলে প্রতিদিন কোটি কোটি পোনা মাছ মারা পড়ছে। যার কারণে আমরা যারা সাধারণ জাল দিয়ে মাছ শিকার করছি, তারা হচ্ছি ক্ষতিগ্রস্থ। আমাদের জালে তেমন মাছ আসছে না। কিন্তু কারেন্ট জালওয়ালারা পোনা মাছ মেরে সাবাড় করে দিচ্ছে।
রাজশাহীর পবার নবগঙ্গা এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, ৩০-৪০ জন জেলে নৌকাতে করে মাছ ধরছেন। তাদের প্রত্যেকেই কারেন্ট জাল ব্যবহার করছেন। প্রতিদিন সন্ধার পর থেকে পরদিন সকাল পর্যন্ত জাল ফেলে অন্তত ৩-৪ হাজার টাকার মাছ ধরা হয়।
ওই এলাকার নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক জেলে বলেন, কারেন্ট জাল সবাই ব্যবহার করছে। বাধ্য হয়ে আমিও এ জাল ফেলেছি। তবে পোনা মাছই বেশি আসছে। মাঝে মাঝে প্রশাসনের লোকজন আসে। আমরা তখন সতর্ক থাকি।
ওই এলাকায় বড়শি দিয়ে মাছ শিকার করছিলেন গনেশ নামের একজন জেলে। তিনি নৌকায় বসে ঘেড় মাছ ধরছিলেন। তিনি বলেন, কারেন্ট জালে পোনা মাছের সর্বনাশ করে দিচ্ছে। এবার মা মাছ ডিম ছেড়েছে বেশি। পোনাও হচ্ছে বেশি। সেই পোনা কারেন্ট জাল দিয়ে জেলেরা ধরে ফেলছে। আমরা একটু সতর্ক হলে এই পোনাগুলো রক্ষা করতে পারতাম। তাতে আমাদের জেলে ভাইদেরই লাভ হত। তিন-চার মাস পরে এবার প্রতিটি জেলেই বিপুল পরিমাণ মাছ পেতেন জালে।
রাজশাহী জেলা মৎস্য কর্মকর্তা জাহাঙ্গীর আলম বলেন, যেসকল উপজেলার মধ্যে পদ্মা নদী রয়েছে, প্রতিটি উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তাদের বলা হয়েছে, জেলেদেরকে সচেতন করার জন্য। তারপরেও যদি পোনা মাছ শিকার করলে অভিযানের নির্দেশ প্রদান করা হয়েছে।
রাজশাহী জেলার গোদাগাড়ী উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা ওহিদুজ্জামান বলেন, এবার পদ্মায় পানি প্রায় দুই মাস ধরে স্থির ছিল। এতে করে সব ধরনের মা মাছ ডিম পাড়ার সুযোগ পেয়েছে। এর আগে গত কয়েক বছর ১৫-২০ দিনের বেশি পানি স্থির থাকেনি পদ্মায়। তবে গত ১০-১২ দিন ধরে পানি নামতে শুরু করেছে। এতে করে মাছও ধরা পড়ছে বেশি। বিশেষ করে কারেন্ট জালে পোনা মাছই বেশি ধরা পড়ছে। আমরা অভিযান করছি। কিন্তু নিয়ন্ত্রণ করতে পারছি না। একদিকে গেলে আরেকদিকে কারেন্ট জাল পড়ছে। রাতদিন তো নদীতে পাহারা দেওয়া সম্ভব না আমাদের। এর জন্য জেলেদের সচেতন হওয়া দরকার। তিনি আরও বলেন, পোনা মাছ ধরে রাজশাহী ও চাঁপাইনবাগঞ্জ জেলার জেলেরা নিজেদের সর্বনাশ নিজেরা করছে।