দেশজুড়ে নদীভাঙনে ভিটেমাটি হারিয়ে বাড়ছে দিশেহারা মানুষের সংখ্যা

এফএনএস এক্সক্লুসিভ | প্রকাশ: ১০ অক্টোবর, ২০২৫, ০৮:১৮ এএম
দেশজুড়ে নদীভাঙনে ভিটেমাটি হারিয়ে বাড়ছে দিশেহারা মানুষের সংখ্যা

নদীভাঙনে ভিটেমাটি হারিয়ে দিশেহারা দেশের বিপুলসংখ্যক মানুষ। চোখের সামনে নদী জমিজমা, বসতবাড়ি, স্কুল, মাদরাসা, মসজিদ, বাজারসহ বিভিন্ন স্থাপনা কেড়ে নিচ্ছে। ফলে অনেক মানুষই সব হারিয়ে নিঃস্ব এলাকা ছাড়তে বাধ্য হচ্ছেন। কেউবা অন্যের জমি ইজারা নিয়ে যাযাবরের মতো অস্থায়ী ঘর তুলে সেখানে থাকছেন। কিন্তু নদী ভাঙনের শিকার ওসব নিঃস্ব মানুষের সহায়তায় খুবই অপ্রতুল সরকারি সহায়তা। এমনকি নদী ভাঙন রোধে তেমন কোনো সরকারি উদ্যোগও নেই। পানি উন্নয়ন বোর্ডের পক্ষ থেকে ভাঙন রোধে জিও ব্যাগ (বালু ভর্তি ব্যাগ) ফেলানোর কর্মসূচি নেয়া হলেও সেখানেও ব্যাপক দুর্নীতি চলে। নদীভাঙন রোধে সমন্বিত পরিকল্পনার অভাব, ভুল নীতি ও পশ্চিমা পদ্ধতি অনুসরণ, আন্তর্জাতিক সংস্থার উপর অতিরিক্ত নির্ভরতা এবং দখলদারদের পৃষ্ঠপোষকতা রোধে ব্যর্থতার কারণে ভাঙন সমস্যার সমাধান হচ্ছে না। ভুক্তভোগী এবং পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।

সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, নদী থেকে অপরিকল্পিতভাবে বালু এবং পাথর উত্তোলন ভাঙনের অন্যতম একটি কারণ। নদীভাঙনে নিঃস্ব মানুষের সামাজিক বন্ধন নষ্ট হচ্ছে। পরিবারের লোকজন ঠিকানা বদল করে ভিন্ন ভিন্ন জায়গায় চলে যেতে বাধ্য হচ্ছে।  প্রতি বছরই বর্ষা এলেই দেশে শুরু হয় ভাঙন। ইতিমধ্যে দেশজুড়ে বিপুলসংখ্যক মানুষ নদীভাঙনে নিঃস্ব হয়ে পড়েছে। আতঙ্কিত হয়ে অনেকে ভাঙন আতঙ্কে নদী পাড় থেকে ঘরবাড়িসহ বহু স্থাপনা সরিয়ে নেয়া নিয়েছে। আর ভাঙন রোধে জিও ব্যাগ ও জিও টিউব ডাম্পিং করেছে পানি উন্নয়ন বোর্ড। তবে দ্রুত পুনর্বাসন ও ভাঙন রোধে কার্যকর ব্যবস্থা না নিলে পরিস্থিতি আরো ভয়াবহ হওয়ার শঙ্কা রয়েছে। সরকারিভাবে ভাঙনকবলিতদের আর্থিক ও খাদ্য সহায়তা প্রদান করা হলেও তা প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল। তাছাড়া গৃহহীনদের পুনর্বাসনের জন্য সরকারিভাবে কোনো কার্যকর ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে না বলেও অভিযোগ রয়েছে।

সূত্র জানায়, পদ্মা ও মেঘনার ভাঙনে শরীয়তপুরের জাজিরার নাওডোবা ও গোসাইরহাটের আলাওলপুরের নদীপাড়ের মানুষ দিশাহারা। গত ছয় মাসে গৃহহীন হয়েছে সহস্রাধিক মানুষ। পদ্মা নদীতে প্রবল স্রোতের কারণে ইতোমধ্যে জাজিরা উপজেলার নাওডোবায় পদ্মা সেতুর কন্সট্রাকশন ইয়ার্ড রক্ষা বাঁধের পূর্ব দিক দিয়ে প্রায় অর্ধ-কিলোমিটার এলাকা নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। তাতে হারিয়ে গেছে ঘরবাড়ি, দোকানপাট, রাস্তা, মসজিদ, ফসলি জমিসহ অর্ধশত স্থাপনা। কুড়িগ্রামের ১৬টি নদীর মধ্যে তিস্তা, ব্রহ্মপুত্র, ধরলা, দুধকুমার নদের ৩৩টি পয়েন্টে নদীভাঙন চলছে। ভাঙনে প্রতিদিন বসতভিটা হারিয়ে শত শত নদীভাঙা মানুষ নিঃস্বের তালিকায় শামিল হচ্ছেন। কুড়িগ্রাম জেলায় ৩৩টি পয়েন্টে প্রায় ৪৩১৫ কি.মি.জুড়ে নদীভাঙন দেখা দিয়েছে। চলমান ভাঙন ঠেকাতে কাজ শুরু করেছে পাউবো। তবে ইমারজেন্সি ভাঙন প্রতিরোধে ২৫০ কেজি ওজনের বালুভর্তি জিও ব্যাগ ভাঙনকবলিত স্থানগুলোতে ফেলা হচ্ছে। তাছাড়া টাঙ্গাইলের যমুনা ও ধলেশ্বরী নদীতে বর্ষার শুরুতেই সদর উপজেলার যমুনা নদীর তীব্র ভাঙনের কবলে পড়েছে কয়েকটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ পাঁচ শতাধিক পরিবার। প্রতি বর্ষার দেড়-দুই মাস নদীপাড়ের মানুষ ভাঙনের আতঙ্কে দিন কাটায়। তবে নদীতে পানি বাড়তে থাকার চেয়ে কমার সময় ভাঙনের তীব্রতা বেশি থাকে। ইতিমধ্যে যমুনার ভাঙন বেড়েছে। কাকুয়া ইউনিয়নে ঝাউগাছা থেকে ওমরপুর দক্ষিণপাড়া পর্যন্ত প্রায় পাঁচ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে ভাঙন আতঙ্কে অনেকেই বাড়িঘর সরিয়ে নিচ্ছে। 

সূত্র আরো জানায়, নদীর ভাঙনে বিলীন হচ্ছে ভোলা। আর নদীর ভাঙনের মূল কারণ অপরিকল্পিতভাবে বালু উত্তোলন। ভোলার মেঘনা ও তেঁতুলিয়া নদীর ভয়াবহ ভাঙনের কবলে পড়ে অসহায় ভোলার মানুষ। নদীভাঙনের ফলে গৃহহীন হয়ে পড়েছে প্রায় শতাধিক পরিবার। ভেঙে গেছে একটি বাজার, মসজিদ, দুটি মক্তব, হিফজ মাদরাসাসহ বেশ কিছু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। ভাঙনের তীব্রতায় অনেক পরিবার তাদের ঘর সরিয়ে অন্যত্র নেয়ার সময়ও পাচ্ছে না। চোখের পলকেই মেঘনা নদীতে বাড়িঘর ও ফসলি জমি বিলীন হয়ে যাচ্ছে।  একইভাবে গাইবান্ধার মধ্য দিয়ে প্রবাহিত তিস্তা, ব্রহ্মপুত্র, যমুনা ও করোতোয়া নদীর তীরবর্তী এলাকাতেও ভাঙন অব্যাহত রয়েছে। পাউবো ওসব ভাঙন এলাকায় প্রতিরক্ষামূলক কাজ গ্রহণ করলেও ব্যাপক অনিয়ম-দুর্নীতির কারণে প্রকল্পের কাজ যথাসময়ে সম্পন্ন না হওয়ায় ভাঙনে তীব্রতা রয়েছে। আরো বহু পরিবার নতুন করে হুমকির মুখে রয়েছে। তাছাড়া উত্তরবঙ্গের তিস্তা নদীবিধৌত নীলফামারী জেলার ডিমলা উপজেলায় দেশের সর্ববৃহৎ ও অন্যতম বৃহৎ সেচ প্রকল্প তিস্তা সেচ প্রকল্প, যার মূল অংশ তিস্তা ব্যারাজ। ওই উপজেলার সীমান্ত দিয়ে ভারত থেকে বয়ে আসে তিস্তা নদীর পানি। কিন্তু তিস্তা নদী এখন এক ভয়াবহ সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। নীলফামারীর ডিমলা উপজেলার সীমান্তবর্তী এলাকায় দিন-রাত চলছে অবৈধভাবে পাথর উত্তোলন। শত শত ইঞ্জিনচালিত নৌকা ব্যবহার করে নদী থেকে অবাধে হাজার হাজার ঘনফুট পাথর তুলে নেয়া যাচ্ছে। ফলে একদিকে যেমন নদীর স্বাভাবিক প্রবাহ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে, তেমনি ভাঙনের কবলে পড়ে ভিটেমাটি হারাচ্ছে হাজার হাজার মানুষ। মুন্সীগঞ্জে পদ্মা নদী ভাঙনের মুখে পরেছে সদর উপজেলার বাংলা বাজার ইউনিয়নের শম্বুকান্দি এবং লৌহজং উপজেলার গাওদিয়া ইউনিয়নের হাঁড়িদিয়া টংগিবাড়ী উপজেলার দীঘিরপাড় বাজার। গত কয়েক দিনের ভাঙনে দোকানপাট, কৃষিজমিসহ ২০টি বসতঘর ও ফসলি জমি নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। নদীভাঙন রোধে পানি উন্নয়ন বোর্ডের অর্থ ব্যয় কোনো কাজে আসছে না। ভাঙন রোধে গত বছর নদীতে জিও ব্যাগ ফেলা হয়েছে। কিন্তু তীব্র স্রোতে নদীর তলদেশ থেকে সরে গেছে জিও ব্যাগ। আর শেরপুরে ভাঙন আতঙ্কে রয়েছে পুরাতন ব্রহ্মপুত্র নদ পাড়ের মানুষ। শেরপুরের নকলা উপজেলার পুরাতন ব্রহ্মপুত্র নদের ভাঙনে সর্বস্ব হারিয়েছেন চর অষ্টধর ইউনিয়নের শতাধিক পরিবার। উপজেলার পুরাতন ব্রহ্মপুত্র নদের পাড়ঘেঁষা নারায়ণখোলা দক্ষিণ, রায় অষ্টধর ও ভেবুয়ারচর গ্রামে গত কয়েক বছরে বাড়িঘর ও ফসলি জমি হারিয়ে ভুক্তভোগীরা দিশাহারা হয়ে পড়েছে। সরকারি সাহায্য-সহযোগিতা না পেয়ে নদীভাঙনের শিকার পরিবারগুলো ক্রমেই নিঃস্ব হয়ে পড়ছে। তাছাড়া ফরিদপুর জেলায় বিভিন্ন উপজেলায় আবারো শুরু হয়েছে নদীভাঙন। নদীভাঙনে ফরিদপুর সদর, আলফাডাঙ্গা, বোয়ালমারী, সদরপুর চরভদ্রাসন, ভাঙ্গা উপজেলার কমপক্ষে ২০-২৫ হাজার মানুষ বিপন্ন হওয়ার পথে। মধুখালি উপজেলার বীরশ্রেষ্ঠ আব্দুর রউফ ডিগ্রি কলেজ এলাকার কমপক্ষে ২০০ বিঘা জমিসহ মধুমতী গর্ভে এক বছর আগে বিলীন হয়ে গেছে। তাছাড়া মানিকগঞ্জ জেলার পদ্মা, যমুনা, কালিগঙ্গা ও ধলেশ্বরী নদীর অব্যাহত ভাঙনে এ বছর নতুন করে সর্বস্বান্ত হয়েছে প্রায় আড়াই হাজার পরিবার।  একই সঙ্গে নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে দুই শতাধিক হেক্টর আবাদি জমি। 

এদিকে নদীভাঙন প্রসঙ্গে পানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. আইনুন নিশাত জানান, নদীভাঙন প্রতিরোধ ও নদী-ব্যবস্থাপনার সাথে জড়িত বিভিন্ন সরকারি সংস্থা এবং বেসরকারি উদ্যোগের মধ্যে পর্যাপ্ত সমন্বয় নেই। শুধু কঠোর বাঁধ নির্মাণ বা পশ্চিমা পদ্ধতির ‘কর্ডন অ্যাপ্রোচ’ অনুসরণ করা হচ্ছে, যা কার্যকর না হয়ে বরং সমস্যা আরো বাড়িয়ে তুলেছে। অনেক গুরুত্বপূর্ণ পরিকল্পনা, যেমন- ডেল্টা প্ল্যান বিদেশি সংস্থার দ্বারা তৈরি হচ্ছে, যা স্থানীয় বাস্তবতার সাথে পুরোপুরি সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। তাছাড়া নদী দখলের বিরুদ্ধে কার্যকর পদক্ষেপ এবং তদারকির অভাবে প্রভাবশালী ব্যক্তিরা নদী দখল করে রাখছে, যা ভাঙন বাড়াচ্ছে। নদীভাঙন রোধে একটি জাতীয় নীতি প্রণয়ন ও তার যথাযথ বাস্তবায়ন না হওয়ায় সমস্যাটি দীর্ঘস্থায়ী হচ্ছে। নদীভাঙনের কারণগুলো চিহ্নিত করে একটি সমন্বিত ও টেকসই জাতীয় নদী-নীতি প্রণয়ন করা জরুরি। প্রাকৃতিক উপায়, যেমন- গাছ লাগানো, নদীর তীরকে শক্তিশালী করতে পারে এবং ভাঙন রোধে সাহায্য করতে পারে। নদী দখল ও দূষণ বন্ধে কঠোর আইন প্রয়োগ ও তদারকি নিশ্চিত করতে হবে।