বগুড়ার শেরপুর উপজেলার শাহবন্দেগী ইউনিয়নের কদিমুকুন্দ মৌজার বাগমারা গ্রামের হাটদীঘি পুকুরপাড়ের বাসিন্দারা তিন মাস ধরে গভীর আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছেন। রাত নামলেই অচেনা লোকজনের উৎপাত, টর্চলাইটের আলো ও অশালীন গালিগালাজে অন্তত ৪০টি পরিবারের ঘুম হারাম হয়ে গেছে। নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সবাই এখন ভয়ে ও উৎকণ্ঠায় রাতযাপন করছেন।
স্থানীয়দের অভিযোগ, পুকুর ও পুকুরপাড়ের মালিকানা নিয়ে চলমান বিরোধই এই ভয়-ভীতির মূল কারণ। গত ৯ সেপ্টেম্বর থেকে ৩ অক্টোবর পর্যন্ত ২৪ দিনের ব্যবধানে দুই পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষ, হামলা ও অগ্নিসংযোগের একাধিক ঘটনা ঘটেছে। এসব ঘটনায় উভয় পক্ষই চারটি পৃথক মামলা দায়ের করেছেন। হাটদীঘি পুকুরের আয়তন প্রায় ১১ একর ১৬ শতক। পুকুরের উত্তর ও দক্ষিণ পাড়ে প্রায় ৩৭ বছর ধরে বসবাস করছেন নদীভাঙনে গৃহহারা পরিবারগুলো। ১৯৮৮ সালে সিরাজগঞ্জ ও পাবনা জেলার বিভিন্ন এলাকা থেকে নদীভাঙনের শিকার হয়ে তারা এখানে আশ্রয় নেন এবং ধীরে ধীরে বসতি গড়ে তোলেন।
সরেজমিনে গিয়ে জানা যায়, পুকুরটির মালিকানা নিয়ে বিরোধ দীর্ঘদিন ধরে আদালতে বিচারাধীন। তবে গত তিন মাসে বিরোধের মাত্রা নতুন করে বেড়েছে। স্থানীয়দের দাবি, রাতের অন্ধকারে অচেনা লোকজন ধারালো অস্ত্র নিয়ে পুকুরপাড়ে মহড়া দেয়, যাতে ভয়ে স্থানীয়রা এলাকা ছেড়ে চলে যায়।
স্থানীয় শিক্ষক সুভাষ চন্দ্র মাহাতো বলেন, “এই পুকুর ও পাড় আমাদের পারিবারিক সম্পত্তি। আদালতের রায়ও আমাদের পক্ষে। কিছু লোক পুকুরটি লিজ নেওয়ার প্রস্তাব দিয়েছিল, আমি রাজি না হওয়ায় তারা জোর করে দখলের চেষ্টা শুরু করেছে। হামলা, অগ্নিসংযোগ ও ভয়ভীতি প্রদর্শনের ঘটনাগুলো সেই চেষ্টারই অংশ।”
৩ অক্টোবর দিবাগত রাতে পুকুরপাড়ের উত্তর পাশে বসবাসরত মনির হোসেনের (৬০) বাড়িতে অগ্নিসংযোগ করা হয়। তিনি এ ঘটনায় থানায় মামলা করেছেন। তার আগে, ৯ সেপ্টেম্বর একই এলাকায় সংঘর্ষে অন্তত ১৩ জন আহত হন এবং স্থানীয় শহিদুল ইসলামের বাড়িতে হামলা চালানো হয়। এসব ঘটনাতেও পৃথক মামলা দায়ের হয়েছে। হামলায় ক্ষতিগ্রস্ত শহিদুল ইসলাম বলেন, “আমি সুভাষ স্যারের পক্ষে পুকুরের দেখভাল করি। সে কারণেই প্রতিপক্ষরা আমার বাড়িতে হামলা চালিয়েছে।”
অন্যদিকে মনির হোসেনের অভিযোগ,“সুভাষ চন্দ্র মাহাতোর লোকজন আমাদের উচ্ছেদ করার উদ্দেশ্যেই আমার বাড়িতে আগুন দিয়েছে।”
পুকুরপাড়ের নারী বাসিন্দা মনোয়ারা বেগম, মঞ্জিলা বেগম ও গুলবানু বেগম বলেন, “১৯৮৮ সালে নদীভাঙনে ঘরবাড়ি হারিয়ে এখানে এসে বসতি গড়েছিলাম। স্থানীয় চেয়ারম্যান আমাদের বসবাসের ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন। কিন্তু এখন রাত নামলেই ভয়ে ঘুমাতে পারি না। অচেনা লোকজন এসে গালিগালাজ করে, টর্চলাইটের আলো ফেলে দেয় ঘরে, তাই রাতভর জেগে থাকতে হয়।”
এলাকার আবদুল হামিদ ও আনোয়ার হোসেন জানান,“পুকুরপাড়ে যাওয়ার রাস্তা সরু হওয়ায় পুলিশ দ্রুত পৌঁছাতে পারে না। এ সুযোগে দুষ্কৃতকারীরা নির্বিঘ্নে আতঙ্ক সৃষ্টি করে পালিয়ে যায়। আমরা ভূমিহীন মানুষ— চাই শুধু নিশ্চিন্তে ঘুমানোর পরিবেশ।”
শেরপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) এস. এম. মঈনুদ্দিন বলেন, “হাটদীঘি পুকুরপাড়ের ঘটনায় এখন পর্যন্ত চারটি মামলা হয়েছে। সবগুলোই তদন্তনাধীন রয়েছে। এলাকাটি বিশেষ নজরদারিতে রাখা হয়েছে।” স্থানীয়দের আশঙ্কা, পুকুরের মালিকানা ও বসতভিটার নিরাপত্তা নিয়ে বিরোধের শান্তিপূর্ণ সমাধান না হলে এ সংঘাত আরও বড় সহিংসতায় রূপ নিতে পারে।