সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে ১৭ হাজার ৬২৭ কোটি টাকা গ্যাস বিল বকেয়া পড়েছে। ওই বিপুল বকেয়ার কারণে আমদানি এলএনজির দাম পরিশোধে হিমশিম খাচ্ছে পেট্রোবাংলা। মূলত বিদ্যুৎ খাতেই সবচেয়ে বেশি গ্যাস বিল বকেয়া রয়েছে। আর ক্রমবর্ধমান ওই বকেয়া নিয়ে জ্বালানি ও খনিজসম্পদ বিভাগ উদ্বেগ প্রকাশ করে দ্রুত তা আদায়ের তাগিদ দিয়েছে। গ্যাসের বিপুল বকেয়ার কারণে এলএনজি সরবরাহ বাবদ পেট্রোবাংলার কাছে বিদেশি কোম্পানিগুলোর পাওনা প্রায় ৩৬৬ কোটি টাকায় পৌঁছেছিলো। তবে কিছু বকেয়া গ্যাস বিল পেয়ে তা দিয়ে গত সেপ্টেম্বরে পেট্রোবাংলা পুরো বকেয়া পরিশোধ করেছে। পেট্রোবাংলা সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, বর্তমানে এলএনজি আমদানি বাবদ কোনো বকেয়া না থাকলেও গ্যাস সরবরাহ বাবদ বকেয়ার টাকা সময়মতো না পেলে পেট্রোবাংলার এলএনজি আমদানি ব্যাহত হওয়ার শঙ্কা রয়েছে। আর এলএনজি আমদানি ব্যাহত হলে চাহিদামতো বিদ্যুৎ উৎপাদন করা দুরূহ হবে। একই সঙ্গে বাড়বে কারখানা ও অন্যান্য খাতে গ্যাস সংকট। এমন পরিস্থিতিতে বকেয়ার কারণে এলএনজি আমদানির বিল মেটানো কষ্টসাধ্য হওয়ার পাশাপাশি রাষ্ট্রায়ত্ত ৬টি গ্যাস বিতরণ কোম্পানি প্রয়োজনীয় ব্যয় মেটাতেও হিমশিম খাচ্ছে পেট্রোবাংলা।
সূত্র জানায়, দেশের বিভিন্ন বিদ্যুৎ কেন্দ্রে বেশিরভাগ গ্যাস বিলের বকেয়া পড়েছে। তার মধ্যে সরকারি বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোর কাছে ৬ হাজার ৩৯ কোটি টাকা, বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) মালিকানাধীন কেন্দ্রগুলোর কাছে পেট্রোবাংলার ২ হাজার ৩৪২.৬০ কোটি টাকা পাওনা রয়েছে। তাছাড়া বেসরকারি খাতের বিদ্যুৎ উৎপাদনকারী (আইপিপি) প্রতিষ্ঠানগুলোর বকেয়ার পরিমাণ প্রায় ৬ হাজার ৪০ কোটি টাকা। আর পেট্রোবাংলা সার কারখানাগুলোর কাছে ১,০৯৬.৫৪ কোটি টাকা পাবে। বিপুল বকেয়ার কারণে ইতিপূর্বে জ্বালানি ও খনিজসম্পদ বিভাগ বকেয়া পরিশোধে ব্যর্থ বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোর গ্যাস সরবরাহ বন্ধ করার কথা চিন্তা করছিল। তবে ভোক্তাদের জন্য নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহের গুরুত্বের কারণে ওই পদক্ষেপ স্থগিত রাখা হয়।
সূত্র আরো জানায়, দেশে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের আগে বিগত সরকারের আমলে দেশের গ্যাস খাতে প্রায় ৭৫ কোটি ডলার বকেয়া ছিল। তার মধ্যে এলএনজি আমদানি বাবদ ৪৩ কোটি ডলারের বকেয়া ছিল। দীর্ঘদিনের জমিয়ে রাখা ওই বকেয়ার কারণে বিপুল পরিমাণ বিলম্ব মাশুল দিতে হয়েছে। আবার বিল পরিশোধে দেরি হবে ভেবে সরবরাহকারীরাও দরপত্রে বেশি দর দিতো। এমনকি বকেয়ার ভয়ে বেশি প্রতিষ্ঠানও দরপত্রে অংশ নিতো না। তাতে জ্বালানির খরচও বেড়েছে। কিন্তু বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব নেয়ার পর এলএনজি আমদানি বাড়িয়েছে। পাশাপাশি নিয়মিত বিল পরিশোধের পাশাপাশি পুরনো বকেয়া পরিশোধে ব্যবস্থা নিয়েছে।
এদিকে বিগত ২০২২ সালে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর দেশে বাড়তে থাকে ডলার-সংকট। আর জমতে থাকে গ্যাসের বকেয়া বিল। তখন সরবরাহকারীরা চাপ তৈরি করায় এলএনজি আমদানি ব্যাহত হচ্ছিল। সংকট এড়াতে তৎকালীন সরকার ওই বছরের জুলাই থেকে টানা সাত মাস খোলাবাজার থেকে এলএনজি আমদানি বন্ধ রাখে। তাতে গ্যাসের সংকট বেড়ে যায়। ভয়াবহ গ্যাসের সংকটের মুখে ওই বছরের সেপ্টেম্বর থেকে ঘোষণা দিয়ে লোডশেডিং শুরু করা হয়। একই সঙ্গে বকেয়া বিলও বাড়তে থাকে। পরে নিরবচ্ছিন্ন সরবরাহের নামে অস্বাভাবিকহারে গ্যাসের দাম বাড়ানো হলেও তৎকালীন সরকার গ্যাস দিতে পারেনি। বরং দেশীয় গ্যাসের পাশাপাশি কাতার ও ওমান থেকে নিয়মিত এলএনজি আমদানি করে সরকার। তাছাড়া খোলাবাজার থেকে এলএনজি সরবরাহ করে কয়েকটি বিদেশি কোম্পানি। আমদানি করা এলএনজি গ্যাসে রূপান্তরের জন্য বাংলাদেশের ব্যবহৃত দুটি টার্মিনালকেও প্রতি মাসে ডলারে বিল পরিশোধ করতে হয়।
অন্যদিকে এ প্রসঙ্গে পেট্রোবাংলার পরিচালক (অর্থ) এ কে এম মিজানুর রহমান জানান, বিভিন্ন বিদ্যুৎকেন্দ্রে গ্যাস সরবরাহ বাবদ ১৬ হাজার ৫৩১ কোটি টাকা পাবে পেট্রোবাংলা। আর সার-কারখানায় বকেয়া গ্যাস বিলের পরিমাণ ১ হাজার ৯৬ কোটি টাকা।
এ প্রসঙ্গে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান জানান, জ্বালানি খাতে বিপুল পরিমাণ বকেয়া ছিলো। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান সরকারের কাছে টাকা পেতো। ফলে জ্বালানি সরবরাহকারীরা বেশি দাম নিতো। তখন আমদানির ক্ষেত্রে প্রতিযোগিতা নির্বাসন দেয়া হয়েছিল। তাছাড়া বকেয়া পরিশোধে দেরি হওয়ায় সরকারকে বছরে ৫০ থেকে ৬০ মিলিয়ন ডলার জরিমানা গুনতে হতো। তাতে জ্বালানির ব্যয় অনেক বেড়ে গিয়েছিল। তবে বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ব্যয় সাশ্রয়সহ নানা উদ্যোগের ফলে পুরনো সব বকেয়া পরিশোধ করা সম্ভব হয়েছে। ফলে দর কষাকষি করে জ্বালানি কেনার সুযোগ তৈরি হয়েছে। আগে যেখানে ১৬-১৭ ডলারে এলএনজি আমদানি করা হতো। এখন তা ১২-১৩ ডলারে নেমেছে। আর দিতে হচ্ছে না কোনো জরিমানাও।