বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির সাম্প্রতিক প্রতিবেদন এক ভয়াবহ বাস্তবতা সামনে এনেছে। গত সেপ্টেম্বর মাসে সড়ক, রেল ও নৌপথে ৫৬৭টি দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছেন ৫৬৫ জন মানুষ-অর্থাৎ প্রতিদিন গড়ে ১৯ জনের মৃত্যু। এর মধ্যে শুধু সড়কেই ৫০৪টি দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন ৫০২ জন। এই পরিসংখ্যান আমাদের দেশের পরিবহনব্যবস্থার নাজুক চিত্রই নয়, বরং মানবজীবনের প্রতি উদাসীনতার নির্মম দলিলও বটে। সবচেয়ে উদ্বেগজনক দিক হলো, মোট দুর্ঘটনার প্রায় ৩৮ শতাংশই ঘটছে মোটরসাইকেলে। তরুণ প্রজন্মের কাছে এই যানটি যেমন কর্মজীবনের সহায়ক, তেমনি বেপরোয়া গতিতে এটি এখন মৃত্যুফাঁদে পরিণত হচ্ছে। পাশাপাশি ব্যাটারিচালিত রিকশা ও ইজিবাইকের ১২ শতাংশ দুর্ঘটনায় সম্পৃক্ততা দেখাচ্ছে, যা নিয়ন্ত্রণহীন ও অনিয়ন্ত্রিত যানবাহনের প্রকোপ বাড়ার ইঙ্গিত দেয়। অথচ সরকার এখনো পর্যন্ত ব্যাটারিচালিত যানবাহনের জন্য একটি সুনির্দিষ্ট নীতিমালা বা নিবন্ধন কাঠামো দাঁড় করাতে পারেনি। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দুর্ঘটনার অর্ধেকেরও বেশি ঘটছে জাতীয় মহাসড়কে। বর্ষায় সড়কে গর্ত সৃষ্টি, অদক্ষ চালক, রোড সাইন ও আলোকসজ্জার অভাব, ফিটনেসবিহীন যানবাহন-সবকিছুই মিলিতভাবে মৃত্যুর এই মিছিলে অবদান রাখছে। শুধু প্রশাসনিক অভিযান বা মৌখিক সতর্কতায় এ অবস্থা পাল্টাবে না; দরকার ধারাবাহিক তদারকি, প্রযুক্তিনির্ভর পরিবহন ব্যবস্থাপনা এবং কঠোর আইন প্রয়োগ। একই সঙ্গে নজর দিতে হবে দক্ষ চালক তৈরির ওপর। দেশে চালকের ঘাটতি মেটাতে অপ্রশিক্ষিত যুবকরা অল্প সময়ের প্রশিক্ষণে সড়কে নামছে, যা নিজের এবং অন্যের জীবনের ঝুঁকি বাড়াচ্ছে। আবার যেসব সড়ক বৃষ্টিতে ক্ষতিগ্রস্ত, সেগুলো দ্রুত মেরামত ও নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণ ছাড়া দুর্ঘটনা রোধ সম্ভব নয়। এই পরিস্থিতিতে সরকারের দায়িত্ব শুধু পরিসংখ্যান প্রকাশ করা নয়; প্রতিরোধে দৃশ্যমান পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি। প্রতিটি বড় দুর্ঘটনার পর তদন্ত কমিটি হয়, কিন্তু তার ফলাফল বা বাস্তবায়ন কোথায়? অপরাধীদের বিচারের আওতায় না আনা এবং দায় এড়িয়ে যাওয়া সংস্কৃতি অব্যাহত থাকলে মৃত্যুর সংখ্যা কেবল বাড়তেই থাকবে। সড়ক শুধু যানবাহনের পথ নয়, এটি জীবনের পথ। সেই পথ যদি প্রতিদিন রক্তে রঞ্জিত হয়, তবে উন্নয়ন, অবকাঠামো বা স্মার্ট বাংলাদেশ-সবই অর্থহীন হয়ে পড়ে। এখন সময়, দায় এড়িয়ে না গিয়ে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়ার। সড়কে নিরাপত্তা ফিরিয়ে আনাই হবে সবচেয়ে বড় মানবিক ও জাতীয় দায়িত্ব।