বিগত তিন দশকে প্রায় ২০০ জলবায়ুজনিত দুর্যোগে বাংলাদেশ হারিয়েছে এক লাখ ৭৪ হাজার কোটি টাকার বেশি সম্পদ। কিন্তু অর্থনৈতিক ক্ষতির চেয়েও গভীর আঘাত লেগেছে মানুষের জীবনে, জীবিকায় এবং মানসিক জগতে। খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. আতিকুল ইসলামের সাম্প্রতিক গবেষণার ফলাফল স্পষ্ট করে জানাচ্ছে-জলবায়ু পরিবর্তন এখন আর ভবিষ্যতের আশঙ্কা নয়, এটি বর্তমানের বাস্তবতা। দেশের দক্ষিণ-পশ্চিম উপকূলীয় অঞ্চল ইতিমধ্যেই ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস, লবণাক্ততা ও বন্যায় সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় পরিণত হয়েছে। গবেষণায় দেখা গেছে, দুর্যোগে আক্রান্ত ৮৭ শতাংশ মানুষ অবকাঠামো ক্ষতির শিকার হয়েছেন, ৮৪ শতাংশের আয় কমেছে, আর ৬৬ শতাংশ মানুষ হারিয়েছেন তাদের সম্পত্তি। এই পরিসংখ্যান শুধু ক্ষতির নয়, টেকসই উন্নয়ন যাত্রার জন্য এক সতর্ক বার্তাও। আরও উদ্বেগজনক তথ্য হলো-জলবায়ুজনিত বিপর্যয়ে ২০৫০ সালের মধ্যে এক কোটি ৩৩ লাখ মানুষ উদ্বাস্তু হয়ে পড়তে পারেন। বাস্তুচ্যুত মানুষের এই স্রোত দেশের শহরগুলোতে নতুন সামাজিক ও অর্থনৈতিক চাপ তৈরি করবে, বাড়াবে দারিদ্র্য, বেকারত্ব ও অনানুষ্ঠানিক শ্রম নির্ভরতা। পাশাপাশি দেখা দিয়েছে মানসিক স্বাস্থ্য সংকট-গবেষণায় দেখা যায়, ৫৭ শতাংশ মানুষ কোনো না কোনোভাবে মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যায় ভুগছেন। এ বাস্তবতায় “লস অ্যান্ড ড্যামেজ”অর্থাৎ ক্ষতি ও ক্ষতিপূরণের বিষয়টি এখন বৈশ্বিক জলবায়ু আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে। উন্নত দেশগুলোর কার্বন নিঃসরণে সৃষ্ট এই বিপর্যয়ের দায় তাদেরই বহন করা উচিত। তবে শুধু আন্তর্জাতিক সহায়তার আশায় বসে থাকা বাংলাদেশের পক্ষে যথেষ্ট নয়। আমাদের জাতীয় নীতি, বাজেট ও পরিকল্পনায় জলবায়ু অভিযোজন ও পুনর্বাসনকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। উপকূলীয় অঞ্চলে টেকসই অবকাঠামো নির্মাণ, লবণাক্ততা সহনশীল ফসল উদ্ভাবন, বিকল্প জীবিকা ও মানসিক স্বাস্থ্য সহায়তা-এসব ক্ষেত্রেই সমন্বিত উদ্যোগ প্রয়োজন। জলবায়ুর ক্ষয়ক্ষতি শুধু প্রাকৃতিক দুর্যোগের ফল নয়, এটি উন্নয়ন ব্যবস্থাপনারও এক পরীক্ষা। তাই “দুর্যোগ-পরবর্তী সহায়তা”নয়, বরং “দুর্যোগ-পূর্ব প্রস্তুতি”কে কেন্দ্র করে পরিকল্পনা নেওয়াই এখন সময়ের দাবি। জলবায়ু পরিবর্তনের এই ক্রমবর্ধমান সংকট মোকাবিলায় বিজ্ঞানভিত্তিক তথ্য, স্থানীয় অভিজ্ঞতা ও ন্যায্য আন্তর্জাতিক সহযোগিতা-এই তিন স্তম্ভের সমন্বয়েই গড়ে উঠতে পারে সহনশীল বাংলাদেশ।