শিশুরাই রত্ন, করব যত্ন স্লোগানে মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন বাংলাদেশ শিশু একাডেমি। শিশুদের প্রারম্ভিক বিকাশ,সুরক্ষা এবং সাঁতার প্রশিক্ষণ সুবিধার প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে। নীলফামারী জেলায় প্রকল্পটি বাস্তবায়নের দায়িত্বে রয়েছে বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা (লোকাল আইডিয়া ফর এম্পাওয়ারমেন্ট) লাইফ। তবে আইসিবিসি প্রকল্প নীলফামারীতে এখন বিতর্কের কেন্দ্র বিন্দুতে পরিণত হয়েছে। জেলা শিশু একাডেমির কর্মকর্তা এবং উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার প্রতিবেদন বলছে,লাইফ এনজিওর প্রায় সব কার্যক্রম অচল হয়ে পড়েছে। অন্যদিকে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের চাহিদা পূরণ করতে না পারায় এমন নেতিবাচক প্রতিবেদন বলে আখ্যায়িত করছেন এনজিও কর্মকর্তারা। প্রকল্পটি বাস্তবায়নে জেলায় সরকারের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা হলেও কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা নেই বললেন প্রকল্পটির সহকারী প্রকল্প ব্যবস্থাপক মাদুল মিয়া।
নীলফামারীর তিন উপজেলায় গড়ে ওঠা শিশু যত্ন কেন্দ্রগুলোর অস্তিত্ব শুধু কাগজে-কলমেই। সাধারণ মানুষ তো নয়ই,এমনকি দায়িত্বশীল কর্মকর্তারাও জানেন না শিশু যত্ন কেন্দ্রের খবর। হাতে গোনা কয়েকটি শিশু যত্ন কেন্দ্র ছাড়া সাঁতার প্রশিক্ষণ কার্যক্রমের অস্তিত্ব কোথাও খুঁজে পাওয়া যায়নি। প্রকল্পের আওতায় কাজ চলে জেলার ডিমলা,কিশোরগঞ্জ ও সৈয়দপুর উপজেলায়। এক থেকে পাঁচ বছরের কম বয়সি শিশুদের জন্য ৫শ টি শিশু যত্ন কেন্দ্র। পানিতে ডুবে মৃত্যু থেকে সুরক্ষায় ৬ থেকে ১০ বছর বয়সি শিশুদের জীবন রক্ষাকারী ৫০টি সাঁতার প্রশিক্ষণ কেন্দ্র। অভিভাবকদের সচেতনতা বাড়ানোর জন্য অভিভাবক সভার আয়োজন। শিশুর যত্ন,বিকাশ ও শিশু সুরক্ষার বিষয়ে তথ্য দেয়ার কথা থাকলেও বাস্তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই কার্যক্রমের কোনো অস্তিত্ব নেই।
সৈয়দপুর উপজেলার কামারপুকুর ইউনিয়ন চেয়ারম্যান আনোয়ার হোসেন বলেন,আইসিবিসি প্রকল্প সম্পর্কে আমার কাছে কোনো তথ্য নেই। এ বিষয়ে আমি কিছুই জানি। কোনো এনজিও আমার কাছে আসেনি। কিন্তু নিয়ম অনুযায়ী গ্রাম ব্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতি হিসেবে এনজিওর পক্ষ থেকে এগুলো জানানোর কথা।
কিশোরগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা প্রীতম সাহা বলেন,কিশোরগঞ্জ উপজেলার এনজিও বিষয়ক সমন্বয় সভায় লাইভ নামের কোনো এনজিওর প্রতিনিধিকে কখনোই পাওয়া যায়নি। অবাক করার বিষয় হলো,উপজেলা বাস্তবায়ন কমিটির সভাপতি হলেও তার উপজেলায় লাইফ এনজিওর কার্যক্রম সম্পর্কে তিনি কিছুই জানেন না। শিশু যত্নকারীদের বেতন না হওয়া এবং এনজিও কর্মকর্তাদের নানা অব্যবস্থাপনা,উপজেলা কর্মী নিয়োগে অর্থনৈতিক লেনদেন। প্রকল্পে নিয়োজিত কর্মীদের সঙ্গে জেলা পরিচালক সুভাষ চন্দ্র পালের বিরোধ হওয়ায় অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে প্রকল্পের ভবিষ্যৎ। অভিযোগ রয়েছে, শিশুদের জন্য খেলনা সামগ্রী সরকার এনজিওটিকে দিয়েছে। কিন্তু এনজিও কর্মীরা সেই খেলনা শিশুদের দেয়নি। সহকারী শিশু যত্নকারী জেসমিন আক্তার বলেন,আমাদের কেন্দ্রটিতে বিদ্যুৎ সংযোগ নেই। নেই কোনো ফ্যান। গরমে কষ্ট হওয়ায় অনেক বাচ্চাই যত্ন কেন্দ্রে আসতে চায় না।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে একাধিক যত্ন করি বলেন,আমাদের নামে শিশু যত্ন কেন্দ্র করে এনজিও কর্মকর্তারা টাকা নয়ছয় করছেন। আমরা এর সুষ্ঠু তদন্ত চাই।
জেলা শিশু বিষয়ক কর্মকর্তা মোস্তাক আহম্মেদ মাসিক প্রতিবেদনে লিখিত অভিযোগে বলেছেন, পরিদর্শনের জন্য নির্দিষ্ট কিছু কেন্দ্র ছাড়া বাকি প্রায় সব কেন্দ্র অচল। অন্যদিকে এনজিও কর্মকর্তার অভিযোগ মোটা অঙ্কের টাকা না দিলে অর্থ বরাদ্দপত্রে সই করা হয় না।
জানতে চাইলে অর্থ দাবির অভিযোগ অস্বীকার করে আইসিবিসি প্রকল্পের জেলা শিশু বিষয়ক কর্মকর্তা মোস্তাক আহম্মেদ বলেন,যখন ভিজিটে যাই সব ঠিকঠাক থাকে। আর ভিজিটের বাইরে অনেকাংশেই কিছুই ঠিক থাকে না।
প্রশিক্ষক ও যত্নকারীদের বেতন না দেওয়ায় এখন অনেক কেন্দ্রই বন্ধ। নানা অব্যবস্থাপনার কথা স্বীকার করে সময়মতো টাকা বরাদ্দ না পাওয়ায় এ অবস্থা বলে মনে করেন এনজিওর জেলা উপপরিচালক সুভাষ চন্দ্র পাল। তিনি বলেন,মাঠপর্যায়ে কাজ করতে গেলে কিছু ত্রুটি-বিচ্যুতি থাকবেই। শিশু বিষয়ক কর্মকর্তা বরাদ্দের প্রত্যয়নপত্রে সময় মতো স্বাক্ষর না করায় বিল তুলতে পারেননি। আর এটিই সব সমস্যার মূল কারণ।
আইসিবিসি প্রকল্পের সহকারী প্রকল্প ব্যবস্থাপক মাদুল মিয়ার সাথে মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন আমি বাইরে আছি। কিছু জানতে হলে জেলা শিশু বিষয়ক কর্মকর্তা মোস্তাক আহম্মেদ এর সাথে কথা বলুন।
এ ব্যাপারে জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ নায়িরুজ্জামান বলেন,বিষয়গুলো তদন্ত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে। উল্লেখ্য,২০২২ সালে নীলফামারীসহ দেশের ১৬ জেলায় আইসিবিসি প্রকল্পের কার্যক্রম শুরু হয়। প্রকল্পটির বাস্তবায়নে নীলফামারীতে প্রতি বছর ব্যয় হয় ৬ কোটি টাকারও বেশি।